ভূমিকাঃ সুখবাদীরা সুখকে এবং বুদ্ধিবাদীরা বুদ্ধিকে নৈতিকতার মানদণ্ড বলে মনে করে। কিন্তু এ দুটি মতবাদ এককভাবে নৈতিকতার কোনাে সন্তোষজনক মানদণ্ড হতে পারে না। নৈতিকতার মানদণ্ড হিসেবে একটা মতবাদ তখনই সন্তোষজনক হতে পারে, যখন সেই মতবাদ মানব স্বভাবের সাথে জড়িত এবং বিচার বিবেচনার ব্যাপার থাকে।
গ্রিনের পূর্ণতাবাদঃ টি এইচ গ্রীন মূলত হেগেলের অনুসারী। তিনি তত্ত্ববিদ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত নৈতিক মতবাদকে একদিকে যেমন পূর্ণতাবাদ, অপরদিকে তেমনি নৈতিক ভাববাদী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তার মতে, মানব প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অংশ হচ্ছে ‘আধ্যাত্মিক নীতি’, যে নীতির জন্য মানুষ প্রকৃতি জগৎ থেকে পৃথক। অবশ্য, নিম্নতর প্রাণীর মতাে যদিও মানুষের মধ্যে জৈবিক বেদনা, প্রেরণা, অনুভূতি ইত্যাদি রয়েছে। তথাপি মানুষ এসব ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তিকে বুদ্ধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। মানুষ যেহেতু আত্মসচেতন জীব, সেহেতু সে তার কামনা-বাসনা জাতীয় ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তিগুলােকে নিয়ন্ত্রিত করে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। তিনি মনে করেন, যা ভালাে তা নিছক জীববৃত্তিমূলক প্রবৃত্তির তুষ্টি সাধন নয়, বরং; তা সামগ্রিক আত্মসচেতন ব্যক্তিত্বের উপলব্ধি। মানুষের লক্ষ্যের দিকে তাকানাে এবং লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার শক্তি হচ্ছে আধ্যাত্মিক শক্তি। তার মতে, আত্মােপলব্ধি হচ্ছে নৈতিক কল্যাণ। গ্রীন হেগেলের সঙ্গে এ বিষয়ে এক মত পােষণ করেন যে, নৈতিক আদর্শ সামাজিক জীবনে অপরাপর আত্মসচেতন সত্তার মধ্য দিয়ে ধারাবাহিকভাবে অর্জিত হতে পারে। গ্রীনের মতানুসারে, সচেতনতার নীতি প্রাণবন্ত ও প্রাণহীন, উভয় ধরনের বস্তুর মধ্যে রয়েছে।
পূর্ণতা বা কল্যাণ বনাম সমাজঃ গ্রীনের মতানুসারে, মানুষের পূর্ণতা লাভের প্রচেষ্টা অবশ্যই সমাজ জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। সমাজ জীবনেই এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির সংস্পর্শে আসতে পারে এবং একে অপরের ভালাে মন্দের বিচার-বিবেচনা করতে পারে। মানুষের কল্যাণ লাভের জন্য সমাজ হচ্ছে উপযুক্ত স্থান। ব্যক্তির পূর্ণতা লাভ বা কল্যাণ ব্যক্তির কল্যাণের জন্য বিশেষভাবে প্রয়ােজনীয়। সমাজবদ্ধ ব্যক্তি কেবল তার নিজের কল্যাণের দিকে তাকায় না, বরং সমাজের অপরাপর ব্যক্তির কল্যাণের দিকেও তাকায়। মানুষ যতই আত্মসচেতনতায় উন্নত হয়, ততই তার নৈতিকতা অভ্যন্তরীণ দিক থেকে বৃদ্ধি পায় এবং সে কেবল তার অন্তর্দর্শনের মাধ্যমে যেসব উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় নিরীক্ষণ করে, সেগুলাে নিছক বাইরের দৈহিক গতিবিধির চেয়ে নৈতিকতার জন্য যে অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ, তা অধিক থেকে অধিকতররূপ উপলব্ধি করে। এদিক থেকে পূর্ণতাবাদ আত্মবাদ ও পরার্থদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, গ্রীন মূলত প্রকৃত ব্যক্তি তার মধ্যে ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তিমূলক ও বৌদ্ধিক নীতিকে সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করেন। একজন মানুষ তার ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তিকে বিচার বুদ্ধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করতে পারে এবং এর মাধ্যমে সত্যিকার পূর্ণতা লাভ করতে পারে। গ্রীন পূর্ণতা লাভের ক্ষেত্রেই ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি এই উভয় বৃত্তির অস্তি ত্বকে স্বীকার করে।
Leave a comment