প্রশ্নঃ পূর্ণতাবাদ কিভাবে সুখবাদ ও বুদ্ধিবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে?

ভূমিকাঃ সুখবাদীরা সুখকেই নৈতিকতার মানদণ্ড এবং বুদ্ধিবাদীরা বুদ্ধিকেই নৈতিকতার মানদণ্ড বলে মনে করে। কিন্তু এ দু’টি মতবাদ এককভাবে নৈতিকতার কোনো সন্তোষজনক মতবাদ দিতে পারে না। নৈতিকতার মানদণ্ড হিসেবে একটা মতই সন্তোষজনক হতে পারে যখন সেই মতবাদ মানব স্বভাবের সাথে জাড়িত হয় এবং সর্বদিকের বিবেচনা করে ৷

পূর্ণতাবাদঃ পূর্ণতাবাদ বা কল্যাণবাদ অনুসারে পূর্ণতা লাভ বা আত্মোপলব্ধিই মানব জীবনের পরম কল্যাণ। অর্থাৎ পূর্ণতা লাভ বা আত্মেপলব্ধিই নৈতিকতার মানদণ্ড। প্লেটোর মতে, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার দ্বারা কামনা বাসনা জাতীয় প্রবৃত্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার ফলেই মানুষের পূর্ণতা বা কল্যাণ আসে। এরিস্টটলের মতে, সদগুণ অনুযায়ী মানুষের অন্ত নিহিত শক্তিগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন করার ফলেই পূর্ণতা আসে। তিনি মনে করেন, মানব জীবনের উৎকর্ষতা ইন্দ্রিয়জ অনুভূতির পরিবর্তে বুদ্ধির উপর নির্ভর করে।

সুখবাদ ও বুদ্ধিবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধনঃ পূর্ণতাবাদের মতে, পূর্ণতালাভ বা আত্মোপলব্ধিই নৈতিকতার মানদণ্ড। এ মতবাদ অনুসারে আত্মোপলব্ধি বলতে মানুষের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশকেই বোঝানো হয়ে থাকে। পূর্ণ বিকাশ বলতে বোঝায় মানুষের মধ্যে একপ্রকার অন্তর্নিহিত শক্তি আছে সেই শক্তিসমূহের পূর্ণ বাস্তবায়ন। মানুষ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন জীব হওয়ায় মানুষের পূর্ণতা লাভ বা আত্মোপলব্ধির ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তি ও বিচারবুদ্ধি এই উভয় দিকের বিচার বিবেচনা করতে হয়। এ কথা ঘোষণা করার সাথে সাথে পূর্ণতাবাদ, সুখবাদ ও বুদ্ধিবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে।

বুদ্ধিবাদ একটি চরম মতবাদঃ অন্যদিকে বুদ্ধিবাদ বা বিচারবাদ বিচার বুদ্ধির পূর্ণতা লাভকে মানব জীবনের পরম লক্ষ্য বলে মনে করে। তার মানে হলো বিচার বুদ্ধিই নৈতিকতার মানদণ্ড। এ মতবাদ বিচার-বুদ্ধিকে নৈতিকতার মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করতে গিয়ে কেবল মানুষের বিচার-বুদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ করে। এ কারণে এ মতবাদ মানব জীবনের অনুভূতিশীল দিককে উপেক্ষা করেছে।

পূর্ণাঙ্গ জীবন গঠনঃ পূর্ণতাবাদ অনুসারে, ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির সমন্বয়ে মানব স্বরূপের পূর্ণাঙ্গরূপ গঠিত হয়ে থাকে। মানব স্বরূপের পূর্ণাঙ্গ রূপের পূর্ণতা লাভের মধ্য দিয়েই আত্মোপলব্ধি ঘটে। মানুষের মধ্যে যেমন রয়েছে ইন্দ্ৰিয় প্রবৃত্তি তেমনি রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তি। ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তিহীন মানব জীবন অপূর্ণাঙ্গ জীবন। তেমনিভাবে বিচারবুদ্ধিহীন জীবন অপূর্ণাঙ্গ জীবন। আসলে মানব জীবন নিছক মানবেতর জীবনও নয় আবার দেবতার জীবনও নয়।

আত্মার পূর্ণ বিকাশ সাধনঃ পূর্ণতাবাদীদের মতে, আত্মোপলব্ধিই হচ্ছে বিচার বুদ্ধির দ্বারা কামনা বাসনার নিয়ন্ত্রণ। আর বিচার বুদ্ধির এই নিয়ন্ত্রণের অর্থই হচ্ছে কামনা বাসনাকে বিনা বিচারে পরিবর্জন করাও নয়। আবার সেগুলোকে বিনা বিচারে চরিতার্থ করাও নয়। পূর্ণতাবাদের মতে, জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির সুষম সমন্বয়ের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। এ থেকে এটা বোঝা যায় যে, পূর্ণতাবাদ সুস্থ এবং নৈতিক জীবনের জন্য ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তিকে উপাদান বা আধেয় এবং বিচার বুদ্ধিকে আকার বা রূপ হিসেবে মনে করে এদের মধ্যে সুষম সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করে। আর এভাবেই পূর্ণতাবাদ সুখবাদ ও বুদ্ধিবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করে।

উপসংহারঃ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সুখবাদীরা যেমন ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তি বা কামনা বাসনার উপর এবং বুদ্ধিবাদীরা বিচার বুদ্ধির উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। পূর্ণতাবাদ সুখবাদ ও বুদ্ধিবাদ উভয়েরই প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে। যার ফলে এ দুই মতবাদের সুষম সমন্বয়ের মাধ্যমেই ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। 

প্রশ্নঃ প্লেটোর পূর্ণতাবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর ৷

ভূমিকাঃ নৈতিকতার মানদণ্ড হিসেবে একটি মতবাদ তখনই সন্তোষজনক হতে পারে, যখন সেই মতবাদ মানব স্বভাবের সাথে জড়িত। এসব দিকেরও বিবেচনা করে একটা ভারসাম্যরূপ বজায় রাখে। মানব স্বভাবের সাথে জড়িত এসব দিকের সুষ্ঠু বিবেচনা করে বলে নৈতিকতার মানদণ্ড হিসেবে পূর্ণতাবাদ একটা সন্তোষজনক মতবাদ হিসেবে নিজেকে দায়ী করতে পারে।

প্লেটোর পূর্ণতাবাদঃ প্লেটোর নীতিবিদ্যা আত্মার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের উপর স্থাপিত। তার মতে, আত্মার তিনটি অংশ রয়েছে এবং এগুলো বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাংশ তেজ বা বীর্যাংশ এবং কামনাংশ। আত্মার প্রজ্ঞাংশের নির্দেশ মোতাবেক বীর্যাংশ কামনাংশকে নিয়ন্ত্রিত করে। এই তিন অংশের পারস্পরিক পূর্ণ সঙ্গতির মধ্য দিয়ে আত্মা যখন ক্রিয়া করে তখন সে আত্মা সুস্থ। অন্যদিকে আত্মার এই অংশগুলো যখন বিচ্ছিন্নভাবে ক্রিয়া করে, তখন সে আত্মা অসুস্থ। প্লেটো মনে করেন যে, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যেমন তিন শ্রেণির নাগরিক রয়েছে, তেমনি আত্মারও তিনটি অংশ রয়েছে। রাষ্ট্রের এই তিন শ্রেণির নাগরিকেরা যখন একের কাজে অপরে হস্তক্ষেপ না করে নিজ নিজ কাজ সুস্থভাবে সমাধান করে, তখন তাদের কাজের পূর্ণ সঙ্গতিকে ন্যায়পরায়নতা বলা হয়। একইভাবে আত্মার তিনটি অংশ যখন অপরের কাজে হস্তক্ষেপ না করে নিজ নিজ কাজ সুস্থভাবে সমাধান করে, তখন তাদের এই ধরনের পূর্ণ সঙ্গতিকে ন্যায়পরতা বলা হয়।

বুদ্ধি হলো স্বর্গীয় নীতিঃ প্লেটোর মতে, বুদ্ধি হলো স্বর্গীয় নীতি বা সূত্র এবং আত্মার রাজ্যে বুদ্ধির কর্তৃত্বই প্রধান। আত্মার উচ্চতর স্তরে রয়েছে বুদ্ধি এবং নিম্নতর স্তরে রয়েছে কামনা। কামনা আত্মার জীববৃত্তির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় এ অনেক সময় ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তি বা হীনতার প্রবণতাকে চরিতার্থ করতে চায়। তাই আত্মার এই নিম্নতর স্তবকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। আত্মার বীর্যাংশ আত্মার কামনাংশ এসব নিম্নতর বা হীনতর প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদেরকে সঠিক পথে চালিত করে। কামনা হচ্ছে বুদ্ধির বিরোধী এবং এ সঠিকতর অর্থে বুদ্ধি বিবর্জিত। অন্যদিকে, তেজ বা বীর্য হচ্ছে বুদ্ধির সহায়ক এবং এ বুদ্ধির নির্দেশে কামনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ন্যায়পরায়ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে আত্মার এ তিনটি অংশ সুসংহতরূপে কাজ করে এবং ফলে ব্যক্তির কল্যাণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখে।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, প্লেটো বুদ্ধির কর্তৃত্বকে স্বীকার করে মানব জীবনের কামনা বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তাই দেখা যায়, তেজ ও কামনার মধ্যে একটি সঙ্গতি স্থাপনের মধ্য দিয়েই ন্যায়পরতা তথা কল্যাণের কথা বলেন।