উপন্যাস মানবজীবনের চিত্ররূপ। মানবজীবনের সমস্ত গতিবিধির কেন্দ্রে যেহেতু মনের ক্রিয়াই প্রধান, তাই উপন্যাসে মানবমনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বর্ণিত হয়। আদিপর্বে উপন্যাস ছিল ঘটনাপ্রধান, কাহিনীপ্রধান নয়। কিন্তু ক্রমশ সাহিত্যিক, ঘটনার অন্তবিষয় প্রকটনে যত্নবান হয়ে ওঠেন। তাই মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসে মানুষের মন ও মনন মুখ্যস্থান অধিকার করে। উপন্যাসিক মানবমনের গহন প্রদেশে অবগাহন করেন, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ও সন্ধিৎসায় সেখান থেকে নিয়ে আসেন নানা মনস্তাত্ত্বিক বৈচিত্র্য। আধুনিক উপন্যাসে তাই মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যই প্রাধান্য লাভ করেছে। শিল্পদৃষ্টির অভিনত্বে এই শাখার উপন্যাস রসিকজনকে তৃপ্ত করে। মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস সেই শ্রেণির উপন্যাস যার মধ্যে নায়ক-নায়িকার মনের নানা গতি, নানা আলো-ছায়া উপন্যাসে একটি রস পরিণাম সৃষ্টি করে। ভার্জিনিয়া উল্ফ বলেছেন: “Life is a semi-transparent envelope surrrounding us from the beginning of consciousness to the end. The thoughts, feelings and impression are the stuff of life. The reality and it is the task of the novelist to discover this reality:” মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে এই ‘reality’-র আবিষ্কারে।

বাংলা মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের সূত্রপাত ‘চোখের বালি’ থেকে। ‘নামতে হল মনের কারখানাঘরে’—এই বলে তিনি যে ‘আঁতের কথা’ উপন্যাসে প্রকাশ করেছেন তা অসাধারণ। এই ধারার পরিণত রূপ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘দিবারাত্রির কাব্য’ থেকে তাঁর উপন্যাসে এই মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা দৃঢ় পদক্ষেপে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই উপন্যাসে তিনি বলেছেন “মানুষের এক এক টুকরো তার মানসিক অংশ।” এই উক্তি তাঁর মনস্তাত্ত্বিক ঔপন্যাসিক সত্তার জীবনবীক্ষা। পরবর্তী উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় এই মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা গভীরভাবে ধরা পড়েছে। প্রথম জীবনে তিনি ফ্রয়েডীয় যৌনচেতনা সম্ভৃত মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার কথা তাঁর উপন্যাসে বর্ণনা করেছেন। ফ্রয়েডীয় মনোবিকলনসুলভ দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি জীবনকে দেখলেন। এই জীবনদৃষ্টির মূলে ছিল জীবনরহস্যের বোধ। এই জীবন-রহস্যকে তিনি প্রেম-যৌনতা-কামনা-বাসনার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছেন। মানবমনের গভীরে ডুব দিয়ে লেখক দেখেছেন এক তমোগভীর দৃশ্য-পরম্পরা। মানিকের জিজ্ঞাসা ছিল। তাঁর বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টি থেকে এই জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল জাগ্রত হয়েছিল। মানবমনের রহস্যকে অনুভব করা ছিল তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়। বঙ্কিমচন্দ্র যে ধারা তাঁর’রজনী’, ‘কৃথ্বকান্তের উইলে’ সঞ্চারিত করেছেন, সেই ‘অস্তবিষয় প্রকটনে যত্নবান’ হওয়ার দায়বদ্ধতা, মানিক এসে যেন শশী-কুসুমের আখ্যায়িকায় নতুন করে তুলে ধরেছেন। গ্রামজীবনের পরিচিত পট ও পরিবেশের মধ্য দিয়ে নানা মানুষের চলাফেরা, গতিবিধি, আশা-নিরাশার কাহিনীকে লেখক তুলে ধরেছেন। প্রতিটি ঘটনার পশ্চাতে লেখকের জীবন-সন্ধানী মন যেমন উৎসুক হয়ে অঙ্কিত হয়েছে, তেমনি ফুটে উঠেছে ব্যক্তির অন্তর্লোকের রূপায়ণ। চেনাজগতের রূপায়ণের মধ্যে দিয়ে মানবমনের দর্পণে, নায়কের জীবন অন্বেষণের অনুষঙ্গে ফুটে উঠেছে ব্যক্তির গভীর আত্মজিজ্ঞাসা বা জীবন-জিজ্ঞাসার কাহিনী। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র নতুন প্রকরণ ও আঙ্গিক সম্পর্কে মানিকবাবু ‘শুভাশুভ’ উপন্যাসের ভূমিকায় লিখেছেন : “উপন্যাস লেখার পুরনো রীতি আজও অনেকে আঁকড়ে আছেন—সেটা এই যে উপন্যাসে কোনো চরিত্র আনলে তার একটা গতি ও পরিপূর্ণতার সম্পূর্ণতা দিতেই হবে। শেষ পর্যন্ত মানুষটার কি হল। আমার প্রথম উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-য় আমি প্রথম এই নিয়ম ভঙ্গ করি।”

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে নানা ‘এপিসোড’, একাধিক বৃত্ত। প্রত্যেকটি বৃত্তের নায়ক-নায়িকার সম্পর্কের মধ্য দিয়ে জীবনের নানা রূপ, নানা বৈচিত্র্য ফুটে উঠেছে। প্রত্যেকটি বৃত্ত-কেন্দ্রিক ঘটনায় যে সব নরনারীর কথা বা চরিত্র ফুটে উঠেছে, তা তাদের মনস্তত্ত্বকে তুলে ধরেছে। প্রত্যেকের জীবনের নিয়তির ট্র্যাজেডি নানা রূপে দেখা দিয়েছে। উপন্যাসে মুখ্য আখ্যান শশী-কুসুম আখ্যান; তার পাশে কেন্দ্রীয় ঘটনার টানে এসেছে মতি-কুমুদ আখ্যান, বিন্দু-নন্দলাল আখ্যান, সোনাদিদি-যামিনী- কবিরাজ আখ্যান। শশীর আত্মউম্মোচনের কাহিনী ধীরে ধীরে উপন্যাসে নাটকীয় বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। মতি-কুমুদ বৃত্ত শেষ হয়েছে অসম্পূর্ণতার রেশ সৃষ্টি করে। এই বৃত্তকে তিনি পূর্ণতা দেননি।

‘পুতুল নাচের ইতিকথার’ প্রধান চরিত্র শশী ও কুসুম ; শশী এই উপন্যাসের নায়ক। এই নায়ক চরিত্রের বিবর্তনের ক্ষেত্রে বিচিত্র অন্তৰ্দ্ধন্দু ফুটে উঠেছে। কারণ শশী চরিত্রের মধ্যে লেখক মনের চেতন-অবচেতনের দ্বন্দ্বকে পরিস্ফুট করেছেন। একদিকে শশী সমাজ ও সংসারের প্রতি কল্যাণকৃৎ মানুষ, দায়িত্বশীল কর্মী ও গ্রাম-সমাজের নেতা, দুঃখী বিপন্ন মানুষের আশ্রয়, কর্তব্যে অবিচল। অন্যদিকে নিজের নিভৃত প্রণয় যন্ত্রণায় অন্তর্দ্বন্দ্বে আকুল এক চরিত্র। দুটো মানুষের সমন্বয়ে যে শশী, সেই শশীকে প্রথম থেকেই আমরা দেখতে পাই। কর্ম ও প্রণয়তৃয়ার মধ্যে দ্বন্দ্বকে শশী প্রথম দিকে বুঝতে পারে না। কুসুম তাকে বার বার তালবনে ডাক দিয়েও যখন শেষে গভীর অভিমানে দূরে চলে যায় তখন সে বেদনার সঙ্গেই নিজেকে বুঝতে পারে। এই আত্মজ্ঞান তার অন্তরে নিয়ে আসে ট্র্যাজেডি। শরীর অন্তরের সুপ্ত প্রণয় তটিনীর বেগে আত্মপ্রকাশ করে। শশী আস্তবিস্মৃত হয়ে কর্তব্যবিস্মৃত হয়ে নিজের জীবনের কেন্দ্রকে হারিয়ে ফেলে। এই দ্বন্দ্ব তার মধ্যে সুপ্ত ছিল অনেকদিন। শেষে তা বেরিয়ে পড়ে দুর্বার গতিতে।

শশী চিকিৎসক। তাই গাওদিয়া ছেড়ে সে বেশি দিন বাইরে থাকতে চায় না। মতি-কুমুদের খোঁজে সে কলকাতায় আসে, গাওদিয়ার জন্য তার মন কেমন করে। কিন্তু কেন? এ-রহস্যই শশীর জীবনরহস্য। অনেক রোগী ফেলিয়া আসিয়াছে। বেশি দিন কলিকাতায় বসিয়া থাকিবার উপায় শশীর ছিল না। পরদিন সে গাওদিয়া ফিরিয়া যাইবে ঠিক করিল। বাকি জীবনটা কলিকাতায় বসিয়া মতির খোঁজ করিলে তো আর চলিবে না। গ্রামে ফিরিবার এই আভ্যন্তরিক তাগিদ সেদিন রাত্রে শশীকে একটু অবাক করিয়া দিল। শশীর ঘরখানা রাস্তার উপরে ছিল। অনেক রাত্রে চৌকির প্রান্তে জানালার ধারে সে বসিয়া ছিল। পথে তখন লোক চলাচল কমিয়াছে, দোকানপাট বন্ধ হইয়াছে। কাল তাহাকে গ্রামে ফিরিতে হইবে। একদিন গ্রাম ছাড়িয়া আসিয়া বিস্তৃততর জীবন গঠনের কল্পনা করিয়া সে দিন কাটায়, আর ইতিমধ্যেই এমন অবস্থা দাঁড়াইয়াছে যে এক সপ্তাহ বাহিরে আসিয়া তাহার থাকা চলে না। রোগীদের কথা ভাবতে বসে শশীর মনের ভেতর আর এক চিন্তাস্রোত বইতে থাকে, সে আবার নিজেকে প্রশ্ন করে “এ কি বন্ধন, এ কি দাসত্ব?” এই প্রশ্ন তার চরিত্রের সমাজ-সত্তা Social ego সম্পর্কে। এই দ্বন্দ্বই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব–“শশীর রাগ হয়। এ দায়িত্ব সে মানিবে না, এতে কিসের নীতিবিজ্ঞান? গ্রামে তো সে ফিরিবে না এক মাসের মধ্যে।—সে কি মানুষের জীবন-মরণের মালিক? যতদিন গ্রামে ছিল, যে ডাকিয়াছে চিকিৎসা করিয়া আসিয়াছে। এখন যদি রোগীরা তার চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। মরুক। তিন বছর আগে সে যখন ডাক্তারী পাশ করে নাই, তখন কি করিয়াছিল গাঁয়ের লোক? এখনো তাই করুক। শশী কিছু জানে না।” শশীর অন্তর্দ্বন্দ্বের স্বরূপটা এখানে বোঝা যায়। কিন্তু গ্রামে ফিরেও শশীর মনে আনন্দ নেই–“কিছু ভাল লাগে না শশীর, না গ্রাম, না গ্রামের মানুষ। শেষ রাত্রে ঢেকির শব্দে ঘুম ভাঙিয়া যায়। তখন হইতে সন্ধ্যার নীরবতা আসিবার আগে কায়েত পাড়ার পথের ধারে বটগাছটার শাখায় জমায়েত পাখির কলরব শুরু হওয়া পর্যন্ত বন্য ও গৃহস্থ জীবনের মতো বিচিত্র শব্দ শশীর কানে আসে, সব যেন ঢাকিয়া যায় যামিনীর হামানদিস্তার ঠুকঠুক শব্দে আর গোপালের গম্ভীর কাসির আওয়াজে।” এই দ্বন্দ্ব শশীকে গতিশীল করে তোলে। শশীর স্বভাবে Social ego তীব্র আকার ধারণ করে। শশী ব্যক্তিগত জীবনে বিপ্লব আনতে চায়। “জীবনে যে বিপুল ও মনোরম সমারোহ সে আনিতে চায় তাহা সম্ভব করিতে হইলে শুধু গ্রাম ছাড়িয়া গেলেই তাহার চলিবে না। আত্মীয়বন্ধু সকলের সঙ্গে মনের সম্পর্কও ভুলিতে হইবে। সে আবেষ্টনীতে যেভাবে সে বাঁচিতে চায় তার ব্যক্তিগত জীবনে তাহা বিপ্লবের সমান। এ বিপ্লব তাহাকে আনিতে হইবে একা, তারপর নবসৃষ্ট জগতে বাস করিতে হইবে একা—সেখানে তো ওদের স্থান নেই।” এই যে “নিজের জীবনকে গুছাইবে কখন” এর আহ্বান, এই আহ্বান শশী চরিত্রের এক অসাধারণ দিক। জীবনের সার্থকতা আনতে হলে, মন থেকে সব সম্পর্কের বাঁধনকে ছিন্ন করতে হবে। এই একাকিত্ব, এই জীবনের বিপ্লব সাধনের প্রক্রিয়া শশীর মনে কোন প্রেরণায় সম্ভব হয়েছে? শশীর মনে নানা স্তর লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। যাদবের কাছে এসে শশী যেমন মনে করে যে জগতে হয়তো “বাঁধা যুক্তির অতিরিক্ত কিছু আছে।” যাদব আর যাদবের মতো মানুষ তাদের সন্ধান রাখেন। বিজ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে যে শশী জীবনকে দেখে, সেই শশীর মধ্যে এই রহস্যময় অনুভূতির প্রতি আনুগত্য তার মনস্তাত্ত্বিক অস্থিরতার আর এক প্রমাণ।

কুসুমকে কেন্দ্র করে শশীর বিস্ময়ের শেষ নেই। কুসুমের হাস্য লাস্য ও নারীর লীলাময়ী রূপ যেমন শশীকে আবিষ্ট করে, তেমনি কুসুমের ব্যবহারও শশীকে অবাক করে। কুসুম রহস্যময়ী—তাই তার বাবা তাকে নিতে এলে সে তালপুকুরের ধারে পড়ে গিয়ে কোমরে চোট লাগে, হাত ভেঙে যায়। পরদিন কুসুম আকাশ-ছাওয়া মেঘান্ধকারের মধ্যে শশীর কাছে আসে। কোমর যার পড়ে ভেঙে গেছে, সে শশী ডাক্তারের কাছে ওষুধ নিতে আসে কি করে? দীর্ঘদিন ধরে শশী কাজের অছিলায় কুসুমের কাছে তার ভীরু নীরবতাকে উপহার দিয়ে এসেছে। শশীর মধ্যে তখন এল নতুন বোধ—“দীর্ঘকাল ধরিয়া কুসুমের প্রতি নিজের অন্যায় ব্যবহার মনে করিয়া শশীর লজ্জা বোধ হইল।” কিন্তু শশীর অন্তর্দ্বন্দ্ব, তার মানস-যন্ত্রণার কথা সে কুসুমের কাছে প্রকাশ করে—“আমরা ছেলেমানুষ নই। ইচ্ছে হলেই একটা কাজ কি আমরা করতে পারি? বুঝেসুঝে কাজ করা দরকার। এই তো দ্যাখো পরান আমার বন্ধু, উপকার করতে গিয়ে চিরকাল শুধু অপকারই করেছি। তবু, তাও আমি গ্রাহ্য করতাম না বৌ। এই বৃষ্টিতে তুমি এলে, তোমার কাছে সরে বসতে না পেরে আমার যা কষ্ট হচ্ছে, কারো মুখ চেয়ে আমি তা সইতাম না। এই উক্তি শশীর অবদমিত” আকাঙ্ক্ষার প্রমাণ। কিন্তু পরক্ষণেই কুসুম বলে—“হাতে ব্যথা ওষুধ নিতে এলাম এসব আমাকে কি শোনাচ্ছেন। কুসুমকে শশীর দুর্বোধ্য বলে মনে হল। শশী আশা করেছিল বোঝাপড়া হবে, শেষে নিবিড় সহানুভূতিতে গভীর অন্তরঙ্গতায় সম্পর্ক মধুর হয়ে উঠবে। পরে নৌকায় উঠে কুসুম যখন বলে বাপের বাড়ি গিয়ে ক’মাস থাকবে ভেবেছিল, কিন্তু তা আর হবে না। এই দোলাচলতা কেবল নারী চরিত্রের রহস্য নয়, শশী-কুসুমের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বও বটে। পরকীয়া প্রেমের দ্বন্দ্বকে লেখক আলো-ছায়ার মধ্যে রেখেই প্রকাশ করেছেন। তাই তার সাহিত্যিক মাধুর্য এতখানি আবেদন সৃষ্টি করেছে। শশী সংযত পুরুষ। তার সামাজিক সত্তা যথেষ্ট প্রবল। “ঝোঁকের মাথায় কাজ করার অভ্যাস শশীর কোনদিন ছিল না।” তাই হঠাৎ-জাগা ইচ্ছার টানে শশী একদিন তালবনে ডাক দেয় কুসুমকে। কুসুম এতে অবাক হয়ে যায়। কুসুম গ্রাম ছেড়ে চিরকালের জন্যে বিদায় নিতে চায়। শশীর অন্তরে বহ্নিদীপ্ত প্রকাশিত হয়ে পড়ে। কুসুমকে সে বুঝতে পারে না, শশীর স্নেহসঞ্চিত অবজ্ঞায় সাত বছর ধরে যার পাগলামীকে সে প্রশ্রয় দিয়েছিল, কেউ কুসুমের অভাবে শশীর জীবনে, চেতনায় ভূমিকম্প শুরু হয়। উপন্যাসের শেষে কুসুমের বিরহাক্রান্ত শশীর উন্মাদনা ও উত্তরণের দৃশ্য এক মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা সৃষ্টি করেছে। শশী স্বীকার করে নিজের মনকে মানুষ বুঝতে পারে না। “নিজের মন কি মানুষ সবসময় বুঝতে পারে বৌ? অনেকদিন অবহেলা করে কষ্ট দিয়েছি বলে আজ রাগ করে তার শোধ নিতে চলেছ, এমন তো হতে পারে আমি না বুঝে তোমায় কষ্ট দিয়েছি, তোমার’ পরে কতটা মায়া পড়েছে জানতে পারিনি?” এই সব প্রশ্ন অসহায় পরাক্রান্ত মানুষের ট্র্যাজেডির মুখোমুখি এক আত্মসাক্ষাৎকার। কুসুমও প্রতিশোধ নেয়, সে বলে “এ কি বলছেন ছোটোবাবু? আমার জন্য আপনার মন কাঁদবে?” এবং পরে বলে “কাকে ডাকছেন ছোটোবাবু, কে যাবে আপনার সঙ্গে? কুসুম কি বেঁচে আছে? সে মরে গেছে।” শশী আবিষ্কার করে “এক একটি ঘটনা চাবির মত, মনের এক একটা দুয়ার খুলিয়া দেয়। যে দুয়ার ছিল বলিয়াও মানুষ জানিত না।” এই আত্ম আবিষ্কার শশীর মনস্তাত্ত্বিক পর্যায়-যাত্রার পরিণতি। কুসুমের উন্মাদ ভালোবাসা কেমনভাবে নির্জীব হয়ে গেল, তার ইতিহাস কুসুম-শশী আখ্যানে তাদের সংলাপে পাওয়া যায়। কুসুমের যে পরিবর্তনের চিত্র উপন্যাসে লক্ষ্যগোচর হয়েছে, সেই পরিবর্তন মনস্তাত্ত্বিক। তাই “কুসুমের পরিবর্তনে আশ্চর্য শশী তাই হয় না।” শশীর জীবনে আছে শুধু আত্মধিক্কার, আফশোষ ও গ্লানি। তাই কর্তব্যশীল শশী মরণাপন্ন রোগীকে ধমক দিয়ে কথা বলে, হাসপাতালের কাজে আসে যান্ত্রিকতা। শেষ দৃশ্যে শশীর দৈন্য কাঙালপনা কুসুমকে বিস্মিত করে, বিচলিত করে। শশীর মনস্তত্ত্বে আছে বিবেচনার তীব্রতা তাই ‘impulse’-এর কাছে সে আত্মসমর্পণ করেনি বলেই তার ট্র্যাজেডি এত গভীর।

“পুতুল নাচের ইতিকথা’-য় মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা কেবল কুসুম-শশীর আখ্যানে নয়। সেনদিদি-গোপাল ও যামিনী কবিরাজের সম্পর্কের মধ্যেও ধরা পড়েছে। সেনদিদির প্রতি শশীর আত্যন্তিক যত্নকে কেন্দ্র করে পিতা-পুত্রের যে দ্বন্দ্ব, যে জটিলতা তাও এক সূক্ষ্ম ও অবচেতন মনস্তত্ত্বের পরিচায়ক। শেষ পরিচ্ছেদে সেনদিদির পুত্রবর্তী হবার ঘটনার মধ্যে দিয়ে এই মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের শেষ হয়ে গেল। কিন্তু সেনদিদির জীবনের মূল্য গোপালের কাছে কত বেশি যার ফলে সে নিজেই পুত্রের কাছে অনুরোধ করতে এসেছে। এ ভাবনা শশীকে ভাবিত করে। অথচ একদিন গোপালই সেনদিদির চিকিৎসার ব্যাপারে শশীকে সর্বাধিক বাধাদান করেছিল। এই মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাকে মানিক এই আখ্যানের মধ্যে নিহিত করে রেখেছেন। “শশী ও গোপালের জগৎ যে দুই স্বতন্ত্র পৃথক জগৎ, গোপালের চরিত্রের বেমানান দিকটা সবচেয়ে বিস্ময়কর মনে হয়।” পিতাপুত্রের এই দ্বন্দ্ব মনস্তাত্ত্বিক কারণসঞ্জাত। শশীকে গোপাল ছাড়তে পারে না, সেনদিদির ছেলেকেও ফেলতে পারে না। তাই পাকা রাজনীতিকের মতো গোপাল কুন্দকে রাজাতলায় পাঠিয়ে দেয়। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে গোপালের অবচেতন মনের নানা আকাঙ্ক্ষা ও জটিলতাই ফুটে উঠেছে।

মতি-জয়া-কুমুদ-বনবিহারী বৃত্তের গতি প্রকৃতিতে দুই নারীর অহং-এর সংঘাত কেমন করে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যে বিপর্যয়ের রেশ নিয়ে আসে, কেমন করে ঘর ভাঙে, তার চিত্র লেখক দেখিয়েছেন। এ-সবই মনস্তত্ত্বগত বিপর্যয়।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’—মানিকের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। মানবমনের অতল রহস্যকে লেখক নানা বৃত্তের নানা চরিত্রের মধ্যে সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। পাগলদিদি যাদবের সমাধির ঘটনায় যে লৌকিক-অলৌকিক জগৎ পরিস্ফুট হয়েছে তাও এই মনস্তাত্ত্বিক চিত্রেরই একটা দিক। কুমুদ-মতির সম্পর্কের মধ্যেও নরনারীর এক জটিল মনস্তত্ত্ব ধরা পড়েছে। বিন্দু-নন্দলালও একই মনস্তত্ত্বের প্রকাশ। সবদিক থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ একটি সার্থক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস।