‘পুতুল নাচের ইতিকথা’

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের প্রথম সার্থক চিত্রায়ণ। এ উপন্যাসে পুতুল প্রতীক বারবার নানা চরিত্রের বিশ্লেষণে এসেছে। সমগ্র উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনের যে চিত্র উপস্থাপন করেছেন তাতে স্পষ্ট যে, মানুষের সমস্ত চেষ্টা এক সময় নিষ্ক্রিয়তায় গিয়ে উপস্থিত হয়, ব্যর্থ হয়। এ কথা শশী, কুসুম, গোপাল, বিন্দু, দিদি, যামিনী, যাদব প্রভৃতি চরিত্রের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। চরিত্রগুলো কেউ নিজের জীবনকে নিজের মতো করে গড়ে তুলতে পারেনি। পুতুলের যেমন নিজের উপর কর্তৃত্ব নেই, তেমনি মানুষেরও।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র শশী পেশায় ডাক্তার। আবেগ আর কামনায় কুসুম বারবার নিজেকে শশীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শশী নির্বিকার থেকেছে নৈতিকতা, রুচিশীলতা, অন্যমনস্কতা এবং সামাজিক মর্যাদার কারণে। কুসুম যখন চিরকালের মতো পিতৃগৃহ ত্যাগ করে যাওয়া স্থির করলো- তখন শশী তার আত্মনিবেদনের প্রতিদান দিতে ব্যগ্র হয়েছে। কিন্তু কুসুমের উৎসাহে তখন ভাটা পড়েছে। তাই সে বলে-

“লাল টকটকে করে তাতানো লোহা ফেলে রাখলে তাও আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে যায়, যায় না?… কাকে ডাকছেন ছোটোবাবু? কে যাবে আপনার সঙ্গে? কুসুম কি বেঁচে আছে? সে মরে গেছে।”

উপন্যাসের চরিত্রগুলো নিজেরাই নিজেদের নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। তাদের ব্যর্থতার পেছনে অন্য মানুষদের ভূমিকা কম। গোপালকে কাশীবাসী করেছে শশী, আবার শশীর কলকাতা যাওয়ার পথ রুদ্ধ করেছে গোপাল। যাদব তার মৃত্যুর জন্য নিজেই দায়ী। শশী কুসুমের প্রেমপূর্ণ আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেছে, কুসুমও একসময় শশীকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের কাহিনী বৃহৎ পরিসরে পরিব্যাপ্ত। গাওদিয়া গ্রামে প্রবেশ পথে উপন্যাসের শুরু এবং সেই গ্রাম পরিক্রমায় উপন্যাসের পরিসমাপ্তি। উপন্যাসে অসংখ্য চরিত্র এসে ভিড় করেছে। মানুষে মানুষে বিশ্বাস- অবিশ্বাস, বিরোধ-সংঘাত এ উপন্যাসের মূল উপজীব্য।

পরিশেষে বলা যায়, কাহিনি, চরিত্র, প্লট, নির্মাণশৈলী ও বিষয় নির্বাচনে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ শুধু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়েরই নয়, বাংলা সাহিত্যেরও অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।