মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক। আধুনিকতার নানা স্বরুপলক্ষণে মণ্ডিত হয়ে উপন্যাসগুণের নানা বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত হয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এক যুগান্তকারী মর্যাদা লাভ করেছে। ১৯৩৬ সালে মানিকের দুখানি উপন্যাস প্রকাশিত হয় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ ও ‘পদ্মানদীর মাঝি’। এই দুখানি উপন্যাস প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থান এক স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দুটি উপন্যাস মানিকের উপন্যাস-জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি।

ঔপন্যাসিক জীবনের রূপকার। জীবনের ও সমাজের নানা সমস্যাকে ঔপন্যাসিক রূপ দেন। মধ্যবিত্ত জীবনের সমস্যাকে, গ্রামবাংলার নানা সমস্যাকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যে রূপ দিয়েছেন। এই দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় উপন্যাসে বাস্তবধর্মিতার যে দাবী অগ্রাধিকার লাভ করে সেই দাবীকে তাঁর রচিত শ্রেষ্ঠ উপন্যাসে রূপ দিয়েছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসে বাস্তবতার প্রতিষ্ঠাতা। এই বাস্তবতার গুণেই ঔপন্যাসিকের মাহাত্ম্য নির্ণীত হয়।

‘দিবারাত্রির কাব্য’ মানিকের প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসটিকে মানিক রূপক বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এই প্রথম উপন্যাসেই মানিক বৈজ্ঞানিক মনের পরিচয় দিয়েছেন। ‘কল্লোল’ যুগের সাহিত্যিকদের মতই মানিক তাঁর উপন্যাসজীবনের প্রথম পর্বে ‘রিরংসাবাদ’কে প্রথম ভাবপ্রেরণা বলে মনে করেছেন। ফ্রয়েড-ব্যাখ্যা ও মগ্নচৈতন্যের রূপকে মানিক তাঁর প্রথম যুগের উপন্যাসে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ঔপন্যাসিক প্রকরণে সমৃদ্ধ হয়ে উপন্যাসটি বিশিষ্টতায় মণ্ডিত হয়েছে। অবদমিত কামনা-বাসনার গূঢ়-গভীর প্রকাশ মানিকের উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য। তাই ‘দিবারাত্রির কাব্য’ বা ‘চতুষ্কোণ’-এ এই অবদমিত কামনার চিত্র ফুটে উঠেছে। ‘হেরম্ব’ চরিত্রের বিচ্ছিন্নতার সমস্যা, হতাশা ও ব্যর্থতা আসলে যুদ্ধোত্তর বাঙালী জীবনের বাস্তব চিত্র। যুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় উপন্যাসে যে বিচ্ছিন্নতাবোধ লক্ষ্য করা যায়, এই উপন্যাসে তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। যুদ্ধোত্তর জীবনে মানুষের বাস্তব চিত্র, মানুষের বিচ্ছিন্নতা, হতাশা ও যন্ত্রণার চিত্র ফুটে উঠেছে। ‘কল্লোলীয়’ উপন্যাসে এই যুগযন্ত্রণার অবক্ষয় ফুটে উঠেছে। এই ধারার উত্তরসাধক ‘হেরম্ব’ চরিত্রের মধ্যে মানিক আধুনিক ঔপন্যাসিক কাফকার রীতি-প্রকরণকে প্রকাশিত করেছেন। কাফকার উপন্যাসে আধুনিকতার মাত্রা প্রযুক্ত হয়েছে নায়ক-নায়িকার আপাত অসংলগ্ন, আপাত অস্পষ্ট কাহিনী ও চরিত্র বিন্যাসকে কেন্দ্র করে। ‘হেরম্ব’ আধুনিকতার ‘প্রটাগনিষ্ট’ চরিত্র।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র বক্তব্য ও আঙ্গিক স্বতন্ত্র। এই উপন্যাসে শশী চরিত্রের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক কেবল আধুনিক জীবনের বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতাকে ফুটিয়ে তোলেননি, তাকে এক বাস্তবধর্মী রূপ দিয়েছেন। এই উপন্যাসের রচনারীতি, বর্ণনাভঙ্গী, আঙ্গিক বিন্যাস ও ঘটনা সম্পাদনা-বৈশিষ্ট্য, চরিত্রনির্মাণ সবই স্বতন্ত্র মর্যাদা লাভ করেছে। এই দিক থেকে উপন্যাসটি আধুনিকতার লক্ষণাক্রান্ত।

একজন সমালোচক বলেছেন “আধুনিকতার নানা স্বরূপলক্ষণ যে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র আগেই বাংলা উপন্যাসে আত্মপ্রকাশ করেছে, রবীন্দ্রনাথ থেকে ‘অন্তঃশীলা’র (১৯৩৫) স্রষ্টা ধূর্জটিপ্রসাদ পর্যন্ত বিভিন্ন লেখকের রচনায় তার সাক্ষ্য মিলবে। বাংলা উপন্যাসের আধুনিক জটিল জীবন-জিজ্ঞাসার সেই বহমান ধারায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ এক গূঢ় তরঙ্গবেগ সঞ্চার করেছে। আর জীবনে সেই গভীর স্বরূপ সন্ধানের অনন্যতায় উপন্যাসটি এই অর্থে মহৎ উপন্যাসের দুর্লভ মহিমাকেও যেন স্পর্শ করেছে। বস্তুত তিরিশের দশকের এই উপন্যাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বের আধুনিকতর প্রত্যাশিত মৌলিক লক্ষণগুলি নিহিত থাকলেও পাঠকমনে এর সংবেদন কিন্তু গভীরতর এক বোধের দিকে। শেষ পর্যন্ত আধুনিকতা অনাধুনিকতার সীমিত লক্ষণ পার হয়ে জীবনের গভীরতর উপলব্ধির আভাস এনে দেয় উপন্যাসটি। আপন অস্তিত্বকে ঘিরে ব্যক্তির যে যন্ত্রণা ও সংকট, জীবনের সঙ্গে মৃত্যুকে মিলিয়ে সত্তার যে অনিঃশেষ জিজ্ঞাসা, আধুনিক ব্যক্তিমানুষের চেতনার দর্পণে জীবনরহস্যের সেই চিরায়ত অনুভবগুলি এক অভিনব শিল্পরূপ পেয়েছে আলোচ্য উপন্যাসে। উপন্যাস হয়ে উঠেছে ব্যক্তিসত্তার এক অপরূপ ওডিসি–জটিল অথচ গভীর চেতনলোকের আলোছায়ার ব্যক্তিমানুষের পথচলার এক আশ্চর্য ইতিকথা।”

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-য় শশীর জীবনবোধের ও জীবনসন্ধানের চিত্র ধরা পড়েছে। শশী তার গাওদিয়া গ্রামের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে। গাওদিয়া গ্রামের সুখদুঃখের সঙ্গে জড়িত হয়ে, তার মরণ-বাঁচনের সঙ্গে জড়িত হয়ে শশী যে দুঃখ ও যন্ত্রণা লাভ করেছে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে শশীর জীবনকাহিনীর মধ্যে তা রূপলাভ করেছে। শশীর মধ্যে যে আদর্শবাদ, যে মানবদরদ, যে মূল্যবোধ ফুটে উঠেছে, তা মানিক-সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র শশী মানিক-সাহিত্যের এক positive চরিত্র। এই চরিত্রে একদিকে যেমন বয়স্ক মনন ও আদর্শ ফুটে উঠেছে, অন্যদিকে তেমনি ফুটে উঠেছে শশী চরিত্রের অর্ন্তদ্বন্দ্ব। পরিবেশের সঙ্গে সংঘাতের ফলে শশী যে পরিণতি অর্জন করেছে, সেই পরিণতি বাংলা সাহিত্যের এক সার্থক নায়ক চরিত্রের পরিণতি। শশীর অর্ন্তদ্বন্দ্বের শ্রেষ্ঠ পরিচয় কুসুমের সঙ্গে সম্পর্কে। পরকীয়া প্রেমের এই সূক্ষ্ম সৌকুমার্য যে অপ্রকাশ্য ইঙ্গিতে ও প্রাপ্তিতে ফুটে উঠেছে, তা অতুলনীয়। কুসুম চরিত্রের খামখেয়ালীপনা, তার অসঙ্গতি, তার চরিত্রের অপরিণত লাবণ্য এক অপূর্ব সুষমায় আত্মপ্রকাশ করেছে। শেষে কুসুম যখন দেশত্যাগ করে গাওদিয়া ছেড়ে পিতা অনন্তের সঙ্গে পিত্রালয়ে যাত্রা করেছে, তখন থেকেই শশী চরিত্রের আসল রূপটি আত্মপ্রকাশ করেছে। এই সময় থেকেই শশীর যে আত্মহারা কাতর ও করুণ মূর্তি লক্ষ্য করা যায় তা তার চরিত্রের ট্র্যাজিক ভাবটি প্রকাশ করেছে। শশী চরিত্রের ট্র্যাজেড়ি তখন হয়ে উঠেছে অসংবরণীয়। সমগ্র উপন্যাস ব্যাপি শশীকে লেখক যেভাবে অঙ্কিত করেছেন, এখানে সেভাবে তাকে দেখা যায় না। এখানে শশী যেন এক অসহায় মানুষ যে তার জীবনের হিসেব নিকেশ করে এই চূড়ান্ত অপব্যয়কে শেষ সম্বল বলে মনে করেছে। শশীর শেষ উপলব্ধি শুধু মানিকের গভীর জীবনদর্শন নয়, শশীর জীবনের এক অত্যাশ্চর্য উপলব্ধি। জীবনের স্রোতে মানুষ যেন অজানা শক্তির ক্রীড়নক, এই উপলব্ধি এই চরিত্রের মধ্য দিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। চরিত্রের মধ্যে জীবনদর্শনকে ওতপ্রোতভাবে মিশিয়ে দিয়ে লেখক এক অসামান্য উপলব্ধিকে সত্য করে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে চরিত্র নির্মাণের দক্ষতার ওপর। শশী চরিত্রকে লেখক আদ্যোপান্ত যেভাবে নির্মাণ করেছেন, তা অসাধারণ। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শশী যেন বিতর্কিত মানবাত্মার এক অখণ্ড কাহিনী। মানুষের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে, মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে, শেষ পর্যন্ত শশী যখন তার মনের মতো করে জীবনকে ধরতে পারল না, তখন তার জীবন সত্যই ব্যর্থ মনে হল। যে শশী কাজ আর দায়িত্ব দিয়ে নিজের সত্তাকে ভরিয়ে তুলেছিল, সেই কর্মপ্রিয় দায়িত্বশীল যোগ্য নায়ক জীবনকে তার প্রত্যাশিত রূপের অতীত ভাবে দেখতে পায়। “নদীর মতো নিজের খুশিতে গড়া পথে কি মানুষের জীবনের স্রোত বহিতে পারে? মানুষের হাতে কাটা খালে তার গতি, এক অজানা শক্তির অনিবার্য ইঙ্গিত। মাধ্যাকর্ষণের মতো যা চিরন্তন অপরিবর্তনীয়।”—এই ‘চিরন্তন’, ‘অপরিবর্তনীয়’ নিয়তির আঘাতে শশী আজ অসহায়। ‘Who can control his fate’ শেক্সপীয়রের এই অমর বাণী শশীর জীবনেও সত্য হয়ে উঠেছে। তবু শশীর জীবনের শেষ অপচয়িত আত্মক্ষয়ে নয়, তার সার্থকতা লক্ষ্য করা যায় কর্মে আর দায়িত্বে—“কাজ আর দায়িত্ব ছিল জীবনে, কাজ আর দায়িত্বে জীবনটা আবার ভরপুর হইয়া উঠিল।” এই পরিণাম বাস্তবধর্মী ঔপন্যাসিকের অঙ্কিত চরিত্রের ট্র্যাজিক পরিণাম। আধুনিক ঔপন্যাসিকের জীবনদৃষ্টিতে ট্র্যাজেডির স্থান মৃত্যুতে নয়, শোচনীয় আত্মক্ষয়ে নয়, তার সার্থকতা জীবনের গভীর কোন সূত্রকে হারিয়ে ফেলার মধ্যে। তাই শশী যে “তালবনে আর কখনো যায় না”, কেন, তা আমরা বুঝতে পারি। কারণ “মাটির টিলাটির উপর সূর্যাস্ত দেখিবার শখ এ জীবনে আর একবারও শশীর আসিবে না।”—এই উক্তি শশী চরিত্রকে আমাদের কাছে বেদনাকরুণ করে তোলে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রনির্মাণ কৌশলের দক্ষতা এই যে চরিত্রকে তিনি বাঞ্ছিত পরিণতি দান করেন। গাওদিয়া গ্রামের ডাক্তার শশী চরিত্রের মধ্যে যে পরহিতৈষণা, কর্তব্যনিষ্ঠা প্রভৃতি লক্ষ্য করা যায়, তার পরিণতি দায়িত্বগ্রহণে। “কী আর করিবে শশী, এ ভার তো ফেলিবার নয়।” – এই উক্তি শশী চরিত্রের মর্মসত্যকে প্রকাশ করে।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র মত ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের সৃষ্ট চরিত্রগুলিও জীবন্ত মানুষের, রূপক নয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জীবন্ত বাস্তবকে চরিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন বলে আমাদের কাছে তাঁর চরিত্রগুলি পরিচিত জীবনের সীমাতে গতিশীল মানুষ। শশী চরিত্র এইরকমই এক জীবন্ত চরিত্র।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র চরিত্রগুলি সু-অঙ্কিত। কেবল শশী নয়, কুসুম, বিন্দু, মতি, নন্দ, যাদব, গোপাল, কুমুদ সবাই জীবনাভিজ্ঞতার নানা স্তর থেকে আহৃত চরিত্র। প্রত্যেকটি চরিত্রসৃষ্টির মধ্যে ঔপন্যাসিকের জীবনদৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণ-নৈপুণ্য চোখে পড়ে।

কুসুম মানিক-সাহিত্যে এক অসাধারণ চরিত্র। এই ধরনের চরিত্র বাংলা সাহিত্যেও প্রায় দুর্লভ। পরানের বৌ হিসেবে তার যে অস্তিত্বের বেদনা, তা তাকে পূর্ণতা দেয়নি। শশীর প্রতি তার অভিমুখিতা সরলভাবে প্রকাশিত হয়নি। তা প্রকাশিত হয়েছে নানা ছলায়, রোযে, অভিমানে ও উগ্র বাক্যে। তাই মতিকে কেন্দ্র করেই হোক অথবা কর্মব্যস্ত শশীর তাদের প্রতি অমনোযোগের জন্যই হোক, কুসুম বার বার শশীকে আঘাত করেছে। কুসুম শশীর ঘরে নির্জনে এসেছে, ভোরবেলা জানালা দিয়ে তাকে ডেকে তুলেছে, গোলাপের চারাকে কুসুম পায়ে দলিত করেই এসেছে শশীর কাছে। কুসুম তাকে তালপুকুরে ডেকে এনেছে, কিন্তু শশী তফাতে বসেছে বলে কুসুম অবাক হয়ে গেছে। শশী অবাক হয়ে যায় যে বিন্দুর কাহিনী শোনাবার জন্য শশীকে তালপুকুরে ডেকে নিয়ে আসা ত স্বাভাবিক নয়। শশী কুসুমের মধ্যে একটা বালিকাকে আবিষ্কার করেছে, সংসারে কুসুমের আড়ালে এই বালিকাটি বাস করে। কুসুম আপাতদৃষ্টিতে শান্ত, সহিষু ও গম্ভীর। কিন্তু অন্তরালে আছে এক চঞ্চল, খেয়ালী, রহস্যপ্রিয় নারীসত্তা। কুসুম চরিত্রের রহস্যকে লেখক অসাধারণ নৈপুণ্যে প্রকাশ করেছেন। কুসুমের সংস্রবে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিয়েও কি শশী জানতে পেরেছিল কুসুম কি চায়? “একটা নারী মন ভুলাইতে চাহিতেছে এটুকু বুঝিতে কি সাত বছর সময় লাগে মানুষের? এই কুসুমের মধ্যে যে কুসুম কিশোর বয়সী, সে শুধু খেলা করিত শশীর সঙ্গে। শশী তো চিনিল না, তাই ভাবিত, এ বয়সে পাগলামী গেল না কুসুমের?”—এই সব উক্তির মধ্যে, বর্ণনার মধ্যে কুসুম চরিত্রের রহস্যকে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন।

বিন্দুর মধ্যে যে যন্ত্রণা, তা যে কতখানি গূঢ়ার্থবাহী তা ফুটে উঠেছে। নন্দর বৈভব ও সাফল্য বিন্দুকে কিভাবে লিপ্ত করেছে, কিভাবে আবিষ্ট করেছে, অথচ নাগিনীর আলিঙ্গনের মধ্যে যে জ্বালা সেই জ্বালা বিন্দু চরিত্রের মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে। নন্দ নিজেকে ব্যস্ত, কাজের মানুষ মনে করে, তাই সে গাওদিয়ার সরলা মেয়েকে নিজের জৌলুসপূর্ণ জীবনের মঞ্চে নিয়ে গিয়ে তাকে রূপান্তরিত করে তোলে। কিন্তু সেই রূপান্তরিত বিন্দু নন্দকে শেষ আঘাত ফিরিয়ে দেয়। নন্দ স্বীকার করেছে “শেষের দিকে ওই আমাকে চালিয়ে নিয়ে এসেছে, থামতে দেয় নি।” —এই পরিবর্তনসূত্রটি বিন্দু চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। মতি চরিত্রটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রসৃষ্টির নৈপুণ্য বহন করেছে। মতি-কুমুদ উপকাহিনী এই উপন্যাসের মুখ্য বৈশিষ্ট্য। কুমুদের মত “বোহেমিয়ান’ চরিত্র মানিক সাহিত্যে দুর্লভ। কুমুদ চরিত্রের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক অখণ্ডতা রূপায়ণে মানিক তৎপর হয়েছিলেন। গাওদিয়ার বালিকা কন্যা মতির পরিবর্তনকে মানিকবাবু কুমুদের জীবনধারার সঙ্গে যুক্ত করে রূপায়িত করেছেন। এই দিক থেকে বিচার করলে মানিকবাবু মতি-কুমুদ আখ্যানের মধ্যে এক ‘বোহেমিয়ান’ জীবনকে ফুটিয়ে তোলেন নি, একে এক স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর-চিহ্নিত করে রেখেছেন। মতি ও কুমুদ এই দুই চরিত্রচিত্রণে মানিক যে অনন্য বৈশিষ্ট্য সন্ধান করেছেন, তার তুলনা বাংলা সাহিত্যে বেশি নেই। গাওদিয়ায় কুমুদের প্রথম আসা, যাত্রাদলে প্রবীর সেজে গ্রামবাসীদের মন জয় করা, মতির হৃদয়রাজ্যে রাজা হয়ে বসা ও তালবনে মতির সঙ্গে দেখা করা, ও শশীর সঙ্গে বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে মতিকে বিবাহ করার প্রস্তাবকে সার্থক করে তোলা এবং বিবাহোত্তর জীবনের ‘হোটেল’-এ পারিবারিক জীবনযাপন, আকস্মিকভাবে কাজ ছেড়ে দেওয়া, জয়া-বনবিহারীর সঙ্গে সম্পর্কের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এই দায়িত্বহীন মানুষের ‘চলতি হাওয়ার পন্থী’ হয়ে জীবনকে নিরুদ্দেশের পথে চালিত করা এসব ঘটনা মিলিয়ে যে অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে তা রোমান্স রাগ-রঞ্জিত। বাস্তবধর্মী উপন্যাসে এ-এক নব রোমান্সের স্পর্শলেখে উপকাহিনীটি যেমন আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে, তেমনি চরিত্রদুটিও পরিণত বাস্তব থেকে এক স্বতন্ত্র স্বাদ বহন করে এনেছে। এই দিক থেকে বিচার করলে মতি-কুমুদ উপবৃত্তটি ও তৎসংশ্লিষ্ট চরিত্র দুটির বিশ্লেষণ ও রূপায়ণ ঔপন্যাসিক মানিকের শক্তিমত্তার নিদর্শন।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ এপিসোড ধর্মী উপন্যাস। উপন্যাসের গঠনের ক্ষেত্রে এইসব ‘এপিসোড’-এর মূল্য যথেষ্ট। ‘এপিসোড’-গুলির গ্রন্থনাও উপন্যাসের পক্ষে মূল্যবান। চরিত্র ও এপিসোড-এর মধ্যে সঙ্গতি এনে একটা পূর্ণতা না দিলে উপন্যাসের ‘organic growth’-এর সার্থকতায় মণ্ডিত হয় না। মানিক ‘শুভাশুভ’ উপন্যাস-এ লিখেছেন :- “উপন্যাস লেখার পুরনো রীতি আজও অনেকে আঁকড়ে আছেন—সেটা এই যে উপন্যাসে কোন চরিত্র আনলে তার একটা গতি ও পরিণতির সম্পূর্ণতা দিতেই হবে। শেষ পর্যন্ত মানুষটার কি হল। আমার প্রথম উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় আমি প্রথম নিয়ম ভঙ্গ করি।”

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র আঙ্গিক ও অভিনবত্ব মানিকের উপন্যাসের প্রকরণ ভাবনাকে পরিস্ফুট করে তোলে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্পরীতির মধ্যে সংকেতধর্মিতার প্রয়োগ বার বার লক্ষ্য করা যায়। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসেও শ্রীনাথ মুদির মেয়ের পুতুলখেলা, সেনদিদির পুতুল কুড়িয়ে পাওয়ার সম্ভাবনা, বিন্দুর পুতুল খেলা, অনন্তের মুখে অলৌকিক শক্তি নিয়ন্ত্রিত পুতুল নাচের সঙ্গে মানবজীবনের সাদৃশ্য—সবই এই উপন্যাসে গূঢ় সংকেতের সঙ্গে গভীর জীবনদৃষ্টি বহন করেছে। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ বাস্তবধর্মী উপন্যাস কিন্তু নানা ক্ষেত্রে শিল্পরীতির ব্যঞ্জনাসৃষ্টির জন্য সংকেতরীতি ব্যবহার করে লেখক এই উপন্যাসকে এক স্বতন্ত্র মাত্রা দান করেছেন। এই রীতিবৈশিষ্ট্য মানিকের উপন্যাসের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম উপাদান।

W. H. Hudson বলেছেন : Plot characters, dialogue, time and place of action, style and a stated or implied philosophy of life, these are the chief elements entering into the composition of any work of pure fiction, small or great good or bad”

অন্যত্র হাড়সন বলেছেন: “a novel is great only when it lays its foundations broad and deep in the things which most constantly and seriously appeals to us in the struggles and fortunes of our common humanity.” হাডসনের এই মন্তব্য থেকে যে সারার্থ আমরা পাই, তা প্রধানত উপন্যাসের রীতিপ্রকরণ ও ভারবিন্যাস সম্পর্কে। উপন্যাসের কথাবস্তু (plot), চরিত্রসৃষ্টি, সংলাপ স্থান-কাল ঐক্য, স্টাইল, দৃষ্টিভঙ্গী এইসব উপকরণ সার্থক বা অসার্থক উপন্যাসের কায়ারূপ। উপন্যাসের জীবনাশ্রয়ী বাস্তবচিত্র সর্বজনীন মানুষের সংগ্রাম ও ভাগ্য পরিবর্তনকে রূপ দেয়। এই সব দিক থেকে বিচার করলে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র ঔপন্যাসিকগুণ অসাধারণ।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র প্লট বা আখ্যায়িকা গাওদিয়ার সমাজ জীবনের নানা ঘটনাবর্তের মধ্যে আবদ্ধ। গাওদিয়ার জীবনধারার যে উত্থান-পতন, যে সুখদুঃখের চিত্র উপন্যাসে পাওয়া যায়, তা বাস্তবধর্মিতার সঙ্গে অঙ্কিত হয়েছে। মতি-কুমুদ বা নন্দ-বিন্দু কাহিনীবৃত্ত উপন্যাসে প্রথিত হয়েছে লেখকের জীবনাভিজ্ঞতার অংশ হিসেবে। এখানে গঠনকে ‘শিথিল’ প্লট (loose plot)-এর গঠন না বলে, ‘ঐক্যবদ্ধ প্লট’ (organic plot) বলাই যুক্তিসঙ্গত। শিথিল আখ্যায়িকায় খণ্ড-বিচ্ছিন্ন ঘটনার সমবায় দেখা যায়। ঐক্যবদ্ধ ‘প্লট’-এর গঠনে ঘটনার সমবায়ে একটি নির্দিষ্ট পরিণামের দিকে অগ্রসরণ লক্ষ্য করা যায়। এই দিক থেকে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র গঠন-ঐক্য প্রকরণের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়েছে।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে এক বিশিষ্ট ও মহৎ জীবনবোধের প্রতিফলন ঘটেছে। শশী চরিত্র এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্রসৃষ্টি। ‘চতুরঙ্গ’-র নায়ক শচীশ বা ‘অন্তঃশীলা’-র খগেনবাবুর মত বুদ্ধিদীপ্ত নায়ক সে নয়। অসামান্য কোন বুদ্ধিদীপ্ত নায়ক না হয়েও কেবল লোকহিতৈষী সহৃদয় মানুষ হিসেবে শশী যে বিচ্ছিন্নতা ও বেদনার মুখোমুখি হয়েছে তা লেখকের আধুনিক ভাবনার সঙ্গে যুক্ত। শশীর মধ্যে ফুটে উঠেছে চিকিৎসাবিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গী। তাই যাদব ও পাগলদিদির মৃত্যুদৃশ্যের বর্ণনা এই উপন্যাসের এক অসামান্য অধ্যায়। মৃত্যুরহস্যের অলৌকিকত্ব ও আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের মনের দ্বন্দ্ব এখানে পরিস্ফুট হয়েছে। “চিরদিনের জন্য এ ঘটনা মনে গাঁথা হইয়া রহিল। এক অপূর্ব অপার্থিব দৃশ্যের স্মৃতি। দুঃখ যন্ত্রণার সময় এ কথা মনে পড়িবে। জীবন রুক্ষ নীরস হইয়া উঠিলে এ আশা করিবার সাহস থাকিবে যে খুঁজিলে এমন কিছুও পাওয়া যায় জগতে, বাঁচিয়া থাকার চেয়ে যা বড়ো। শোক, দুঃখ, জীবনের অসহ্য ক্লান্তি এসব তো তুচ্ছ, মরণকে পর্যন্ত মানুষ মনের জোরে জয় করিতে পারে।” এইসব উপলব্ধি ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-য় এক নতুন চিন্তার উদ্রেক করে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গীতে জীবনভাবনায় আধুনিকতার লক্ষণ পাওয়া যায়। সমালোচকগণ উপন্যাসে দৃষ্টিভঙ্গীর গুরুত্ব বার বার তুলে ধরেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গীর গুরুত্বই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনভাবনার ফলশ্রুতি। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে জীবনরহস্যের রূপায়ণ নানা চরিত্রের মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে। শশীর মনের দর্পণে যে জীবনরহস্য প্রতিফলিত হয়েছে, তা গাওদিয়ার গ্রামজীবনের নানা চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্কবিন্যাসের ফলেই সৃষ্ট হয়েছে। গ্রাম্য জীবন পরিবেশে ব্যাধি, মৃত্যু, ইচ্ছামৃত্যু ও সংস্কার-সন্দেহ, অবৈধ প্রণয়ের গুপ্ত সাক্ষাৎ সব মিলিয়ে মানুষের রহস্য জটিল রূপ শশীর জীবন-অভিজ্ঞতাকে পরিবর্তিত করেছে। সে অনুভব করেছে—“গ্রামে জীবন কম গভীর নয়, কম জটিল নয়। একান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে গ্রামে ডাক্তারি শুরু করিয়া ক্রমে ক্রমে এ জীবন শশীর যে ভালো লাগিতেছে, ইহাই তাহার প্রথম ও প্রধান কারণ”। এই জীবন জটিল। জটিল জীবনের রহস্যাস্বাদ শশীর দৃষ্টিভঙ্গীকে গড়ে তুলেছে। মানুষের অসহায়তা ও অদৃশ্য শক্তির কাছে ক্রীড়নকের মত মানুষের নিষ্ফল প্রয়াস উপন্যাসের জীবনদৃষ্টিকে অভিনবত্বে মণ্ডিত করেছে। “The novel does not simply convey life; it says something about life; it reveals some kind of pattern in life” (Arnold Kettle), এই kind of pattern গাওদিয়ার মানুষের জীবনবিন্যাস। এই জীবনবিন্যাসের খণ্ডতা থেকে মুক্তির জন্য তাই সচেতন মানসের অধিকারী শশীর প্রয়াসেরও শেষ নেই। এই দিক থেকে উপন্যাসটি সার্থক। ভাষা, সংলাপ, গঠন ও জীবনবিন্যাসের রূপায়ণে উপন্যাসটি সাফল্য লাভ করেছে। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।