উপন্যাস আধুনিক কালের সৃষ্টি হলেও এর মধ্যে গ্রিক নিয়তিবাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। উপন্যাস হল মানব জীবনের দ্বন্দ্ব সংক্ষুব্ধ আলেখ্য। মানুষ এই জীবন সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এই জীবনের নিয়ন্ত্রা শক্তিরূপে নিয়তির প্রভাব লক্ষ করা যায়। নিয়তির প্রভাবে সবই পূর্ব নির্দিষ্ট থাকে মানুষ শুধু ‘শক্তিহীন পুতুল’দের মতো আচরণ করে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসটি জাগতিক ক্রিয়াকাণ্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ শক্তিহীন পুতুলদের নাচের এক নির্মম পালাকাহিনি। সমালোচকের এ জাতীয় মন্তব্য কতখানি যথার্থ তা আলোচনা করে দেখা হবে।
‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে নানাবৃত্তে থাকা নানা চরিত্রের মধ্যে অস্তিত্বের সংকট চিত্রিত হয়েছে। তবে সমস্ত সংঘাত এবং সংকটের অন্তরালে এক অদৃশ্যশক্তি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কাহিনি তথা ঘটনা এবং সেই সূত্রে চরিত্রগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই উপন্যাসের নায়ক শশীকে যেন চালিত করেছে। এই উপন্যাসটির দ্বিতীয় সংস্করণে লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন—“পৃথিবীর এই বিরাট রঙ্গমঞ্চে মানুষ যেন শুধু পুতুল কোনো অদৃশ্য হাতের সুতোর টানা পোড়েনে মানুষ নাচে হাসে কাঁদে। নদীর মতো নিজের খুশিতে গড়া পথে তার জীবনের স্রোত বেয়ে চলে না।”
‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসটি নানান ঘটনা দ্বন্দ্ব সংঘাত ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বৈচিত্র্যময় চরিত্রগুলিকে কেন্দ্র করে এগিয়ে চলেছে। প্রধান চরিত্র শশী ডাক্তারের সঙ্গে মূলকাহিনি বা শাখা কাহিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্ক থেকে গেছে। এই সূত্র ধরেই পরাণের স্ত্রী কুসুমের সঙ্গে শশীর যোগাযোগ দাম্পত্য জীবনের অপূর্ণতা পুরোনোর জন্য শশীকে ভালোবাসা নিবেদন করে। শশী কুসুমের এই আহ্বান মেনে না নিলেও অন্তরে তার প্রতি একটা টান অনুভব করে। এ যেন শিক্ষিত শশীর কাছে নিয়তির প্রভাব। তাই বাবার কথার প্রতিধ্বনি করে বলে—’অদৃষ্টের লেখা কে খণ্ডাবে?
শশী কুসুমের সম্পর্কের বিবর্তনকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে প্রথম দিকে কুসুমের অদম্য আগ্রহ থাকলেও শশী তা আমল দেয়নি। এরজন্য কুসুম তাকে অনেকবার বলেছে—“পুজ্য মানুষ আপনি, আপনাকে পূজা করে পুণ্যি হয়।” কখনো আবার বলেছে–“মতি কি বললে জানেন ? ছোটোবাবুর অহংকার হয়েছে।” যে শশী একদিন ভেবেছিল ‘এত বয়সেও কুসুমের পাগলামী গেল না। কিন্তু নিয়তির নির্দেশেই যেন উপন্যাসের শেষে শিক্ষিত, মার্জিত শশী ডাক্তার কুসুমকে বলে—“চলো কুসুম পালিয়ে যাই।” এযেন নিয়তির এক খেলা। আবার যে কুসুম একদিন বলেছিল—“আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন ছোটোবাবু।” সেই কুসুমই শেষে উত্তর দিয়েছে—“আপনি বুঝি ভেবেছিলেন, যেদিন আপনার সুবিধে হবে ডাকবেন, আমি অমনি সুর সুর করে চলে যাবো? কেউ তা যায় ?”
কুসুমের দুঃখ-শশীর ট্র্যাজেডি সমস্ত কিছুর মূলে রয়েছে নিয়তির অদৃশ্য নির্দেশ। তাই শশীকে, কুসুমের বাবার কাছ থেকে শুনতে হয়েছে—“সংসার মানুষ চায় এক হয় এক। চিরকাল দেখে আসছি ডাক্তারবাবু পুতুল বৈ তো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছে।” ঠিক এমন ট্র্যাজেডি লক্ষ্য করা যায়—একেবারেই কাঁচা মেয়ে’ মতি এবং শশীর মেজো বোন বিন্দুর ক্ষেত্রেও। বিন্দুর সব আছে; দাস-দাসী, ঘর-বাড়ি, গহনা কিন্তু তবুও বিন্দু সুখী নয়। কারণ বিন্দুর স্বামী নন্দলাল বেপরোয়া চরিত্রহীন মানুষ। সে বিন্দুকে স্ত্রী মর্যাদা দেয়নি, তাকে রক্ষিতা করে রেখে শাস্তি দিয়েছে। বিন্দুর পরিবর্তিত ব্যক্তিত্ব যা চিরকালের জন্য ছাপ রেখে গেছে। কিন্তু পিতা গোপালের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না মেয়েকে সুখী করার জন্য কিন্তু তবুও বিন্দু অসুখী। এটাই ভবিতব্য—এটাই নিয়তি। লেখক এই প্রসঙ্গে বলেছেন—‘জীবনের অজ্ঞাত রহস্য গাওদিয়ার বিন্দুতে গ্রাস করিয়াছে।
‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র নানান চরিত্র নানান ঘটনা, নানান বৃত্ত বা এপিসোড। তবে তার মধ্যমণি হিসাবে উপস্থিত থেকেছে শশী। তাকে কেন্দ্র করে যেমন এসেছে কুসুম মতি-কুমুদ বিন্দু ঠিক তেমনই এসেছে যাদব পণ্ডিত এবং পাগলা দিদি। যাদব পণ্ডিত চরিত্রটি প্রথম থেকেই রহস্যাবৃত। পাগলাদিদি তার সহধর্মিণী। ২১ বছর বয়সে এই গাওদিয়া গ্রামে তার ধুমকেতুর মতো আবির্ভাব। তারপর থেকে সিদ্ধ পুরুষ বলে খ্যাতি। যাদবের আচরণ নিয়ে শশীর মনে একটা সংশয় ছিল—“পদধূলি দেন না, আশীর্বাদ করেন না, পাষাণ দেবতার মতো উপেক্ষা করে ভক্তিকে শশীর সন্দেহ জাগে লোকের মনে ভয় ও শ্রদ্ধা জাগানোর কৌশল এসব।” সকলকে বিশ্বাস করালেও শশীকে করতে পারেনি যে সূর্যবিজ্ঞান তার হাতের মুঠোয়। নিয়তির করাঘাতেই যেন শশীকে যাদব জানিয়ে দেয় করে মারা যাবে। যাদব যেন নিজের হাতেই বাধা পড়েছে। না মরতে পারলে মিথ্যাবাদী হয়ে যাবে সে। কারণ নিজে মুখে বলেছে যে—’আমি রথের দিন মরবো শশী।” অবশেষে সেই রথের দিন উপস্থিত। প্রথমে পাগলাদিদি মারা যায় আর যাদব পণ্ডিতের অবস্থার কথা জানাতে গিয়ে লেখক জানিয়েছেন—“যাদবের মুখ ঢাকিয়া গিয়েছিল চটচটে ঘাম আর কালিমায়, চোখের তারা দুটি সংকুচিত হইয়া আসিয়াছিল।”
শশী ডাক্তার জানতো যাদবের এই মৃত্যুর আসল রহস্য। আফিম খেয়ে তার এই অবস্থা হয়েছে। কিন্তু তবুও হাসপাতাল তৈরির বিশ্বাস শশীকে ভক্ত বানানোর চেষ্টা এ সমস্ত ব্যাপার শশীর কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। তাই তার মনে হয়—“এও এক অসাধারণত্ব যাদবের।” এ ভাবনা শুধু শশীর নয়, যামিনী কবিরাজেরও। জীবন সচেতন মানুষ যামিনীও যাদবের স্বেচ্ছামৃত্যুকে স্বীকার করে নিয়েছে। তার বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন ‘সে ম্লেচ্ছ নাস্তিক’ কিন্তু তবুও সে যাদবের অলৌকিক শক্তিকে বিশ্বাস করেছে। আসলে যুক্তির অতিরিক্ত কিছু হয়তো বিশ্বাস আছে যা পুতুল নাচের নিয়ন্ত্রণকে বিশ্বাস করায়। এ রকমই আর এক পুতুল সেনদিদি, যামিনী কবিরাজের স্ত্রী। তার রূপ সম্পর্কে লেখক বলেছেন—“যে রূপের জন্য পৃথিবীর লোক উন্মাদ, স্ত্রীর যে সৌন্দর্য মানুষ তপস্যা করিয়া পায় না, যামিনী তাই পাইয়াছে।” কিন্তু নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস, যামিনী কবিরাজের মৃত্যুর পর সে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লো, শুধু তাই নয় বসন্তরোগে সেনদিদির যৌবন বিগত হয়ে গেছে। লেখক তার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন—“যামিনী কবিরাজের বউ-এর রূপের খ্যাতি রহিল না…..তাহাকে দেখিলে এবার যে লোকের হাসি পাইবে ? তাহার অমন ডাগর চোখ।”
পরিশেষে বলা যায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় কুসুম বিন্দু মতি যাদব পণ্ডিত পাগল। দিদি যামিনী কবিরাজ সেনদিদি সর্বোপরি নায়ক শশী সকলেই অল্পবিস্তর নিয়তি বিবর্তিত পথে আবর্তিত হয়েছে। সকলের অন্তরালে অদৃশ্য শক্তির মতো নিয়তি উপস্থিত থেকে পুতুল রূপী চরিত্রগুলিকে নিয়ে গেছে পরিণামি পরিস্থিতির দিকে। সচেতন প্রয়াসে চরিত্রগুলি চলার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত কেউই সফলতা লাভ করেনি। নিয়তির প্রভাবে প্রত্যেকেই কম বেশি ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। তাই সমালোচক যখন বলেন—’পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে প্রত্যেকটি চরিত্রই পুতুল হিসাবে উপস্থিত হয়েছে। তারা শক্তিহীন অদৃশ্য নিয়তির আড়ালে থেকে তাদের চালাচ্ছে। তাদের পালাকাহিনিই এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
Leave a comment