‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। বাংলা উপন্যাসের অন্যতম অহংকৃত সংযোজন। এই উপন্যাসে লেখক জীবনের বহুবিচিত্র ও বিস্তৃত রূপের উদ্ঘাটন করেছেন। নানা চরিত্রের ভিড়ে সমন্বিত এই উপন্যাসের নারীচরিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য পাঠকদের মন ও মনোযোগ আকর্ষণ করে।

নারীচরিত্রের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য কুসুম চরিত্র। শশী-কুসুমের কাহিনীই এই উপন্যাসের প্রধান কাহিনী। শশী-কুসুমকে কেন্দ্র করেই অন্যান্য চরিত্রের আবর্তন-বিবর্তন। এই সব বিচিত্রমুখী নারীচরিত্রের মধ্যে ঔপন্যাসিকের জীবনভাবনা বিবর্তিত হয়েছে। এই উপন্যাসে নারীমনের বাসনা কামনা কখনও সুপ্ত, কখনও জাগ্রত প্রশ্ন নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। নানা প্রকাশের মধ্যে দিয়ে জীবনরহস্যের অনুভূতিটি প্রবল হয়ে ফুটে উঠেছে।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনরহস্য সন্ধানের এক একটি রূপ ফুটে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে কুসুম চরিত্রের গুরুত্ব সর্বাধিক। শশীর প্রতি কুসুমের আকর্ষণ দুর্বার— তালপুকুরের ধারে কুসুম শশীকে ডেকে আনে। বিন্দুর কথা উপলক্ষ করে কুসুম শশীকে ডাকে। কিন্তু শশী তার মধ্যে দেখে কিশোরীকে। হাস্যে-লাস্যে যার আকর্ষণ কত গভীর। কুসুম রহস্যময়ী নারী, কুসুম বিচিত্ররূপিনী নারী। তার কথাবার্তায় অসঙ্গতি আছে প্রচুর। কিন্তু শশীর জন্য তার ‘উন্মাদ ভালোবাসা’ শেষ পর্যন্ত চরিতার্থতার পথ পায় না। এই ভালোবাসায় শরীরী আকর্ষণের বিন্দুতে তন্ময়। কুসুম শশীকে বলে “আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন ছোটবাবু?” উন্মত্ত ভালোবাসার এই শিহরণ সে বহন করে বেড়ায়। এই কুসুম শেষ পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়ে শশীকে বলে—“লাল টকটকে করে তাতানো লোহা ফেলে রাখলে তাও আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে যায়, যায় না? কাকে ডাকছেন ছোটবাবু? কে যাবে আপনার সঙ্গে? কুসুম কি বেঁচে আছে? । মরে গেছে ?” শশী স্তম্ভিত হয়ে যায় কুসুমের এই পরিবর্তনে, কুসুমকে দেখে শশী নারীরহস্যের বিচিত্ররূপিনী মূর্তিকে উপলব্ধি করে। কুসুম শশীকে আঘাত করে অভিযোগ দিয়ে—“দশ বছর খেলা করেও সাধ মেটেনি। আমরা মূর্খ গেঁয়ো মেয়ে। এসব খেলার মর্ম তো বুঝি না, কষ্টে মরে যাই।” কুসুম সম্পর্কের মধ্যে যে শূন্যতাকে উপলব্ধি করে, সে সম্পর্কে বলে “এমন হবে ভাবিনি। তাহলে কোনকালে গাঁ ছেড়ে চলে যেতাম?” শশী ভাবে, “কে জানিত মোটে দুদিনের নোটিশে কুসুম তাকে এমন বিপদে ফেলিবে তার গুছানো মনের মধ্যে এমন ওলটপালট আনিয়া দিবে।” কুসুম শশীর প্রেমের বিপর্যয় কাহিনী এইভাবে শশীর জীবনে এনেছে হাহাকার, সে হয়ে উঠেছে উদ্ভ্রান্ত। “কুসুম মরিয়া গিয়াছে। সেই চপল রহস্যময়ী আধো-বালিকা, আধো-রমণী জীবনীশক্তিতে ভরপুর, অদম্য অধ্যবসায়ী কুসুম। এই পরিণতি দুঃখজনক, কিন্তু রহস্যময়ী নারীচরিত্রসৃষ্টির ক্ষেত্রে অসাধারণ।

মতি এই উপন্যাসের আর এক চরিত্র যার চোখে অফুরন্ত স্বপ্ন। মতির জীবন-স্বপ্ন তাকে বাস্তবের ঊর্ধ্বে এক জগতে নিয়ে গেছে যেখানে মানুষের পার্থিব জগতের সম্ভাবনা লুপ্ত। কুমুদ-কাহিনী শুরু হয় চতুর্থ পরিচ্ছেদ থেকে। মতির মনে শশীর ভূমিকা বিরাট আদর্শ মানুষের, সে গেঁয়ো মেয়ে কিন্তু শশীর মত পাত্র তার অবচেতন মনের কামনা। মতির ভারি ইচ্ছা, বড়লোকের বাড়িতে শশীর মতো বরের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। “কাজ নাই, বকুনি নাই, নোংরামি নাই। বাড়ির সকলে সর্বদা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে হাসে, তাসপাশা খেলে, কলের গান বাজায় আর বাড়ির বৌকে খালি আদর করে। চিবুক ধরিয়া তাহার লজ্জিত মুখখানি তুলিয়া বলে লক্ষ্মী বৌ, এমন না হলে বৌ।”—এইখানে মতির স্বপ্নের বৈশিষ্ট্য, মতির মত বালিকা কিশোরীর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। এই উচ্চাশার পটভূমিতে যাত্রার মঞ্চে অভিনয় করতে এসে কুমুদের অভিনয় দেখে মতি মুগ্ধ হয়, এবং মতির জীবনে ঘটে আর এক ইতিহাস। গ্রামের মেয়ে, গেঁয়ো মেয়ে মতি—“গাওদিয়ার গেয়ো মেয়ে মতি তাকে লইয়া কুমুদ চলিল হনিমুনে।” মতির এই পরিবর্তন দেখে পরাণ ও অন্যান্য সকলে অবাক হয়ে যায়। মতি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য তার অস্থির ও স্বভাবচঞ্চলতা। কুসুমের মধ্যেও এই ধরনের লক্ষণ বর্তমান ছিল। কলকাতায় জীবনে এসে কুমুদের জীবনযাত্রা দেখে, তার বন্ধু সমাগম দেখে মতির মন ‘nostalogia’-য় আক্রান্ত হয়। মতি দেখে বন্ধুদের সঙ্গে রাজপুত্রবেশী প্রবীরের ‘জুয়ার আড্ডা’, মতির স্বপ্নভঙ্গ হয়। কুমুদ তাকে মনে করিয়ে দেয় সে জীবন বৌ নয়, সঙ্গিনী, সাথী। কুমুদের এই আধুনিকতা মতিকে ভীত করে। জয়া-বনবিহারীর জীবন দেখে সে একটা ঘরোয়া জীবনের স্বাদ পায়। কুমুদ মতিকে ছেলেমানুষ স্ফুর্তিজীবী কিশোরী হিসেবে দেখতে চায়। কুমুদের যাযাবরের জীবন। কোনো কিছুই তার স্থায়ী নয়। তার প্রেমে বৈচিত্র্য, রোমাঞ। সে গাওদিয়ার জীবন থেকে সরে এসেছে। “জীবনে আর কোনোদিন গাওদিয়ায় যাইতে পারিবে না ভাবিয়া মতির যখন কষ্ট হয়, কাঁচামনে তার কমবেশি আশা-আনন্দের সঞ্চার হয়।” যাত্রা করতে কুমুদ দেশান্তরী হয়। মতিকে সে সঙ্গে নিতে চায় না। মতি এই দায়িত্বহীন কুমুদকে চেনে না। কুমুদ-মতি অধ্যায় হয়ে ওঠে রহস্যজনক অধ্যায়। জীবন-উপভোগের মায়া কুমুদ শিল্পীর মত হারিয়ে যায় দেশান্তরে। মতিও তার সহযাত্রী হয়। কুমুদ মতির জীবনের এই রহস্যচেতনা নারীচরিত্রের আর এক বৈশিষ্ট্য।

বিন্দু-নন্দলাল আখ্যানের বিন্দু চরিত্রটি এই উপন্যাসের আর এক রহস্যময়ী নারীসত্তা। শশীর জীবন-চেতনার দর্পণে মুকুরিত হয় রহস্যচেতনা। বিন্দুর প্রেম, তার জীবনে নাটকীয় ঘটনা, শেষ পর্যন্ত তার নারীত্বের অবমাননা সবই এই উপন্যাসে নারী চরিত্রের আর এক মাত্রাকে ব্যঞ্জিত করেছে। বিন্দুকে নন্দলাল স্ত্রীর মত নয়, রক্ষিতার মতো সালংকারে, প্রসাধনে সুসজ্জিত করে রেখেছে। তাকে নারীত্বের মর্যাদা দেয় নি। “গাওদিয়ার বিন্দুকে গ্রাস করা কলকাতার অনামী রহস্য শশীর কাছে স্বচ্ছ হইয়া আসে।” বিন্দু তার অনমনীয় জেদ থেকে এতটুকু সরে নি। বিন্দু প্রেমের বিষামৃত পান করেছে। নন্দর স্বভাবকে সে পরিবর্তিত করতে পারে নি। সে নন্দলালের অস্বাভাবিক জীবনকে মেনে নিয়েছে। বিন্দর জীবনাশক্তি তাকে শক্তি দিয়েছে। কিন্তু এই শক্তিকে সে নন্দর প্রতিশোধ স্পৃহাকে অপনীত করতে পারে নি। বিন্দু নন্দলালের দেওয়া যন্ত্রণাই অক্লেশে গ্রহণ করেছে। এইখানে বিন্দু চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।