মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাস-সাহিত্যে বাস্তবতার প্রতিভূ শিল্পী। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যে বিজ্ঞানমনস্ক মননের সূত্রপাত করেছেন, তা তাঁকে এক অনন্যত্ব দান করেছে। ঔপন্যাসিক বাস্তবকে সন্ধান করেন, বাস্তব জীবনের রূপ দেন। বাস্তবতাই উপন্যাসের প্রধান গুণ। তাই শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিককে বাস্তব মানুষ ও জীবনকে তাঁর সাহিত্যে রূপ দিতে হয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন: “উপন্যাসেও কাব্য সৃষ্টি করা যায়, কল্পনা পার হয়ে যেতে পারে বাস্তবতার সীমা, গড়ে উঠতে পারে এক মানস-জগৎ যার অস্তিত্ব লেখকের মন ছাড়া কোথাও নেই।” এর পরে তিনি বলেছেন: “বাস্তব মানুষ, বাস্তব জীবন, বাস্তব পরিবেশ অবলম্বন করেই এসব ঘটাতে হবে।” অথবা অন্যত্র তিনি বলেছেন: “লেখক যে ভাব আর ভাবনাই সাজিয়ে দিন উপন্যাসে, ভিতটা তাঁকে গাঁথতেই হবে খাঁটি বাস্তবতার।” উপন্যাসের ভিত্তি বাস্তবতা, উপন্যাসের স্বরূপও এই বাস্তবতা। জীবন, জগৎ ও মানবসমাজকে বাস্তববাদী দৃষ্টিতে দেখে তাকে উপন্যাসের আঙ্গিকে ফুটিয়ে তোলাই সাহিত্যিকের লক্ষ্য।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সাহিত্য করার আগে’ প্রবন্ধে লিখেছেন–“ভাবপ্রবণতার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ সাহিত্যে আমাকে বাস্তবকে অবলম্বন করতে বাধ্য করেছিল।” বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর সহায়তায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বাস্তবতাকে বিশোধিত করেছিলেন। এই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য নানা স্তরে, নানা পর্যায়ে বিভক্ত। কিন্তু কোন স্তরেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বৈজ্ঞানিক যুক্তিনিষ্ঠাকে অগ্রাহ্য করেননি। তাঁর বাস্তবতার বিবর্তনে ‘ন্যাচারালিস্ট’-এর কোন ভূমিকা নেই। এই কারণে তিনি ‘দর্পণ’-এর পর থেকে অর্থাৎ ১৯৪৪ থেকে যে বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছেন, তা ‘রিয়ালিজম’-এর অন্তর্গত। মানিক ‘দৰ্পণ’, ‘চিহ্ন’ প্রভৃতি উপন্যাসে এসে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার পথে এগিয়েছেন। প্রথম পর্বের বাস্তবতাপন্থী উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় রোমান্টিক লক্ষণ বা উপাদান থাকলেও উপন্যাসটি বাস্তব বিশ্বস্ততার সীমা লঙ্ঘন করেনি। এ সম্পর্কে একজন সমালোচক যথার্থ বলেছেনঃ “পুতুল নাচের ইতিকথা’-র রোমান্টিক উপাদানের অস্তিত্ব মেনে নিয়েও বলা চলে যে, কাহিনী, চরিত্র বা পরিবেশ-উপন্যাসে বাস্তবতা সৃষ্টির এইসব উপকরণ বিচারে আলোচ্য উপন্যাসটিকে নিছক রোমান্টিক রূপক লক্ষণাক্রান্ত বলা চলে না। যেসব চরিত্রের মধ্যে রোমান্টিক প্রবণতা আছে তারা ব্যক্তি হিসেবে ব্যক্তি চরিত্রের কার্যকারণ সম্পর্ক ও সম্ভাব্যতার বিচারে নিঃসংশয়ে পাঠকের বিশ্বাসের সীমা লঙ্ঘন করে না—কুসুম, কুমুদ ও মতি এর প্রমাণ। অন্যান্য চরিত্রের প্রায় প্রত্যেকটি—গোপাল, সেনদিদি, পরান, যাদব পণ্ডিত ও গাওদিয়া গ্রামের অন্য মানুষজন সকলেই তাদের সীমাবদ্ধ জীবনের দুঃখে সুখে, আকাঙ্ক্ষায় ও আত্মবঞ্চনায় এরাও বাস্তব। কিন্তু এসব সত্ত্বেও যেন মনে হয়, এই উপন্যাসের বাস্তবতার রূপায়ণরীতি ও সংবেদন, সমকালীন উপন্যাসের, যেমন শরৎচন্দ্রের গ্রামীণ জীবনের বাস্তবধর্মী বিন্যাসরীতি ও তার আবেদন থেকে বহুলাংশে আলাদা হয়ে গেছে। এর পরিবেশ ও চরিত্রপরিকল্পনায় ও খণ্ড খণ্ড আখ্যান বা ‘এপিসোড উদ্ভাবনায় যেন প্রচলিত বাস্তবতার সংবেদন থেকে স্বতন্ত্র কিছু পাই, কিন্তু তা অবশ্যই অবাস্তব নয়। এমন যে ঘটে তার অন্যতম প্রধান কারণ—এই উপন্যাসে তথ্যবাহী ঘটনার ভূমিকা মুখ্য নয়, নায়কের মনে সেইসব ঘটনার সূক্ষ্ম জটিল প্রতিক্রিয়াই মুখ্য।” (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : জীবনদৃষ্টি ও শিল্পরীতি)।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ গাওদিয়া গ্রামসমাজের জীবনযাত্রার চিত্র। কিন্তু এই জীবনযাত্রার বর্ণনায় লেখক বিভূতিভূষণ বা তারাশঙ্করের মত তুচ্ছ ঘটনা বা তথ্যের ওপর নির্ভর করেননি। গাওদিয়ার গ্রাম সমাজের পরিবেশ পরিস্ফুট হয়েছে নানা চরিত্রের পরিবেশ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া থেকে। গোপাল শশীর পিতা। সে শশীকে বার বার পল্লীসমাজের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন করেছে। মতি বা কুসুমের বাড়ি বার বার যাওয়ার জন্য বা সেনদিদির বাড়িতে ঘন ঘন যাওয়ার জন্য নানাভাবে অনুযোগ করেছে, মৃদু তিরস্কারও করেছে। তার এইসব কাজ গোপাল সমর্থন করেনি। “গোপাল ছেলের সঙ্গে আজকাল প্রায় কথা বন্ধ করিয়া দিয়াছে। যামিনী কবিরাজের বৌ বাঁচিয়া উঠিয়াছে বলিয়া নয়, অন্য কারণে। অন্তত সাধারণ মানুষের তাই ধরিয়া লওয়া উচিত। ব্যাপারটা হইয়াছিল এই শশীর বেশ পসার হইয়াছে। বাজিতপুরের সরকারী ডাক্তারকে ডাকিতে খরচ অনেক। অনেকে শশীকেই ডাকে। যামিনী কবিরাজের বৌ-এর চিকিৎসার জন্য কয়েক দিন শশী দূরে কোথাও যাওয়া তো বন্ধ রাখিয়াছেনই, তিন মাইল দূরের লক্ষ্মণপুরের কল পর্যন্ত ফিরাইয়া দিয়াছে।” এই ব্যাপার গোপাল সমর্থন করেনি। গোপাল শশীর উদারতাকে গ্রাম সমাজের প্রতিক্রিয়ার মাপকাঠিতে বিচার করে তাকে তিরস্কার করেছে—“কিন্তু তুমি এরকম আরম্ভ করলে আর একটা দিনও থাকি কি করে?” শশী জিজ্ঞাসা করে যে সে কী অন্যায় কাজ করেছে? “কী করেছ? মুখে চুনকালি মেখেছ। সবাই কি বলছে তোমার কানে যায় না আমার কানে আসে! যামিনী খুড়োর বৌ-এর অসুখে তোমার এত দরদ কেন? ডাক্তার মানুষ তুমি, একবার গেলে, ওষুধ দিলে, চলে এলে। দিনরাত রোগীর কাছে পড়ে থাকলে বলবে না লোকে যে আগে থাকতে কিছু না থাকলে”—এই প্রতিক্রিয়াই গ্রামসমাজের সংকীর্ণ সংস্কারের ফসল। তাই গোপালের মুখে সেই সমাজের চিত্র বাস্তবধর্মিতার আয়তনে ফুটে উঠেছে।

গ্রামের পর্দা প্রথা তখনও বহিরস্থ মানুষদের জন্য শিথিল নয়। অর্থাৎ বাড়ির আবহাওয়া খোলামেলা নয়। কুমুদ শশীর অন্তরঙ্গ বন্ধু। সে শশীর বাড়ি এসে তার স্বভাবসঙ্গত ভাবে খোলামেলা ভঙ্গীতে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। শশী গ্রামে থেকেও গেঁয়ো বনে যায়নি, এই উক্তির মধ্যে গ্রামসমাজের মধ্যে শশীর রুচি-স্বাতন্ত্র্য ফুটে উঠেছে। কুমুদ শশীর বাড়িঘরকে সুসজ্জিত দেখে খুশী হয়। অন্তঃপুরচারীদের দেখবার জন্য সে উৎসুক হয়। কিন্তু গ্রামসমাজের চিত্র লেখক বাস্তবধর্মিতার মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। “গ্রামে পর্দা প্রথা শিথিল, কিন্তু সে গ্রামেরই চেনা মানুষের জন্য। শশীর বাড়ির মেয়েরা সকালবেলা অন্তঃপুরে পাক খায়। কুমুদ উৎসুক দৃষ্টিতে খোলা দরজা দিয়া প্রকাণ্ড সংসারটির গতিবিধি যতটা পারে দেখিতেছিল। খানিক পরে ছোটো একটি ছেলে আসিয়া দরজাটা ভেজাইয়া দিয়া গেল। কুমুদ আহত হইয়া ভাবিল, আমি তো ওদের দেখিনি? ওদের কাজ দেখছিলাম যে আমি। সকলে মিলে কি রচনা করছে তাই দেখছিলাম।”—গ্রামসমাজের রক্ষণশীলতা ও পর্দাপ্রথার তথ্যগত ইঙ্গিত লেখক এখানে দিয়েছেন।

গ্রামবাংলার যাত্রার বর্ণনা লেখক আভাসে সেরেছেন। যাত্রার আসরে ‘চিক’ প্রথার বর্ণনা করতে লেখক ভোলেননি, সেখানেও শ্রেণীভেদ যে কত সচেতন তার প্রমাণ মতির পরিচয় দেবার পর বাবুদের বাড়ির মহিলাদের উঠে যাওয়ার দৃষ্টান্তে প্রমাণিত হয়েছে। “আসরে যখন তাহারা পৌঁছিল যাত্রা আরম্ভ হইতে বিলম্ব আছে। চিকের আড়ালে জায়গার জন্য কলহ শুরু হইয়া গিয়াছে ইতিমধ্যেই। সকলেই চিক ঘেঁষিয়া বসিতে চায়, এগার বছরের সদ্য পর্দা পাওয়া মেয়ে হইতে তাহার পঞ্চাশ বছরের দিদিমা পর্যন্ত। এসব বিষয়ে কুসুম ভারি ওস্তাদ। সকলকে ঠেলিয়া ঠুলিয়া সেই যে চিকের কাছে প্রথম সারিতে একটা দশ ইঞ্চি ফাঁকের মধ্যে নিজেকে পুঁজিয়া দিল কেহ আর তাহাকে সেখান হইতে নড়াইতে পারিল না।” গ্রামের যাত্রার বর্ণনা বিভূতিভূষণও ‘পথের পাঁচালী’তে করেছেন। কিন্তু মানিকের বৈজ্ঞানিক মননসিদ্ধ দৃষ্টি বিভূতিভূষণের ছিল না, তাই মানিক বিভূতিভূষণের তুলনায় অনেক বেশি, অল্পকথায় নবীনের উত্তেজনা, যাত্রার উপভোগ্যতা ও বাবুদের গৃহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষজনের শ্রেণীপার্থক্য বর্ণনা করতে সক্ষম হয়েছেন। “এত লোক এত আলো, এত শব্দ-মতির নেশা লাগিয়া গিয়াছিল। পাটকরা মুগার চাদরটা কাঁধে দেওয়ায় শশীকে ভারি বাবু দেখাইতেছে। সে আসরে আসিয়া দাঁড়ানো মাত্র মতি তাহাকে দেখিতে পাইয়াছিল। স্বয়ং শীতলবাবু তাহাকে ডাকিয়া কাছে বসাইলেন দেখিয়া শশীর সম্মানে মতির সম্মানের সীমা নাই।” – এখানে কুসুমের দৃষ্টিতে বা মতির দৃষ্টিতে লেখক যাত্রাকে দেখেছেন, শশীর সামাজিক সম্মানের কথা বর্ণনা করেছেন। শীতলবাবুর দেওয়া সম্মান শশীকে যে সম্মানিত করেছে এ বিষয়ে লেখক সামাজিক দৃষ্টিকে পাঠকের কাছে পরিবেশন করেছেন। বর্ণনার মধ্যে অতিরেক নেই, কোথাও। গ্রামে শ্রেণীভেদের বর্ণনা মানিক পরবর্তী অংশে করেছেন “কথাটা শীঘ্রই রটিয়া গেল। হারু ঘোষের মেয়েকে তাহাদের মধ্যে গুঁজিয়া দেওয়ার স্পর্ধায় শশীর উপর শীতলবাবু আর বিমলবাবুর পরিবারের মেয়েরা বিশেষ অসন্তুষ্ট হইলেন। মতির কাছে যাঁহারা ছিলেন, তাঁহারা বাড়ির মধ্যে যাওয়ার ছলে উঠিয়া গেলেন এবং ফিরিয়া আসিয়া অন্যত্র বসিলেন।” এই সব বর্ণনাগুলি খুবই তাৎপর্যবহ। অল্প কথায় মানিক গ্রামসমাজের ভেদরেখাকে সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন।

গ্রামসমাজে লোক-উৎসবের মধ্য দিয়ে যেমন সমাজের আনন্দ, উত্তেজনা ও শ্রেণীভেদ বিশিষ্ট সমাজের পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় ধর্মীয় মোহাচ্ছন্ন মানুষের সার্বিক উত্তেজনায় সমবেত মানুষের কোলাহল ও মায়ামোহ। এমন একটি ঘটনা রথের দিন যাদবের মৃত্যুদৃশ্যের বর্ণনায় ফুটে উঠেছে—“রথের দু’দিন আগে খুব বৃষ্টি হইয়া গিয়াছিল। সেদিনও সকালের দিকে কখনো-কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়িল, কখনো মেঘলা করিয়া রহিল। আগের দিন সন্ধ্যা হইতে সংকীর্তন আরম্ভ হইয়াছিল, সারারাত্রি এক মুহূর্ত্ত বিরাম নাই। সকালবেলা নূতন নূতন লোক আসিয়া দল ভারী করিয়াছে, কীর্তন আরও জাঁকিয়া উঠিয়াছে। যাদব স্নান করিয়া পট্টবস্ত্র পরিধান করিয়াছেন, সকলে ফুলের মালায় তাঁহাকে সাজাইয়াছে। পাগলদিদি আজও রেহাই পান নাই, তাঁর গলাতেও উঠিয়াছে অনেকগুলি ফুলের মালা। তবে তেল সিঁদুর দেওয়া সধবারা বন্ধ করিয়াছে, আজ যার বৈধব্যযোগ তাঁকে ওসব আর দেওয়া যায় না। বেলা বাড়িবার সঙ্গে যাদবের বাড়ির সামনে আর কায়েতপাড়ার পথে লোকে লোকারণ্য হইয়া উঠিল। গাওদিয়া, সাতগাঁ আর উখার গ্রামের একদল ছেলে ভলান্টিয়ার হইয়া কাজ করিতেছে, উৎসাহ তাদেরই বেশি। বাঁশ বাঁধিয়া দর্শনার্থী মেয়ে পুরুষের পথ পৃথক করিয়া দেওয়া হইয়াছে। ভাঙা দাওয়ায় যাদবের বসিবার আসন। অঙ্গনে কয়েকটা চৌকি ফেলিয়া গ্রামের মাতব্বরেরা বসিয়াছেন। তাদের হুঁকা টানা ও আলাপ আলোচনার ভঙ্গি উৎসব বাড়ির মতো। যেন বিবাহ উপনয়ন সম্পন্ন করাইতে আসিয়াছে। শীতলবাবু ও বিমলবাবু সকালে একবার আসিয়াছিলেন, দুপুরে আবার আসিলেন। বাবুদের বাড়ির মেয়েরা আসিলেন অপরাহ্ণে। যাদব এবং পাগলদিদির তখন মুমূর্ষু অবস্থা।” এই বর্ণনা বাস্তবপ্রধান উপন্যাসের লক্ষণে বিশিষ্ট। এখানে বর্ণনার যথার্থ ও তথ্য স্বাভাবিক মাত্রায় বর্ণিত হয়েছে। এই রীতি ‘ন্যাচারালিস্ট’-এর নয়, ‘রিয়ালিস্ট’-এর। এই রীতির মধ্যে গ্রামীণ মানুষের মনস্তত্ত্ব, ধনীদের আসা-যাওয়ার নিয়মরীতি গ্রামের মাতব্বরদের বিবাহ-উপনয়ন-সদৃশ উৎসব দেখার মনোভাব ও নানা গ্রামের মানুষের সমারোহের বর্ণনা এখানে নীচু সুরে বর্ণিত হয়েছে। বর্ণনারীতির এই রীতিকে বৈজ্ঞানিক রীতি বলা চলে। এই রীতি বিভূতিভূষণের মধ্যে অনুপস্থিত। গ্রাম বাংলার মানুষের মনে মিথ্যার মোহ কতখানি কার্যকরী হয়ে উঠেছে, এই দৃশ্য তার প্রমাণ। “সত্যি মিথ্যায় জড়ানো জগৎ। মিথ্যারও মহত্ত্ব আছে। হাজার হাজার মানুষকে পাগল করিয়া দিতে পারে মিথ্যার মোহ। চিরকালের জন্য সত্য হইয়াও থাকিতে পারে মিথ্যা।” এই মিথ্যামোহাচ্ছন্ন গ্রামসমাজের হাজার হাজার মানুষের চিত্র এই উপন্যাসে এনে লেখক গ্রামবাংলার কুসংস্কার ও উদ্দীপনার বাস্তবধর্মী চিত্রই এঁকেছেন।

শশী চরিত্রকে বাস্তব-আবাস্তবের দ্বন্দ্বে রেখে ঔপন্যাসিক তাঁর বাস্তববাদী মনেরই পরিচয় দিয়েছেন। শশী যাদবের ইচ্ছামৃত্যুর রহস্যকে চিনতে পেরেছে, কিন্তু হাসপাতাল করার ব্যাপারে শশীর হাতে কর্তৃত্ব করার অধিকার উইলে লিপিবদ্ধ করে যাদব তাকে জড়িয়ে ফেলেছে। “তাকে জড়াইয়া গেলেন কেন? সে ম্লেচ্ছ, নাস্তিক, শেষ পর্যন্ত অবিশ্বাস করিয়া আসিয়াছে যাদবের অলৌকিক শক্তিকে?” যাদব ছিল গৃহী সন্ন্যাসী, “কিন্তু টাকার ছাপ তো কোথাও ছিল না সেই গৃহী সন্ন্যাসীর গৃহে।” অর্থনৈতিক দিক থেকে অসচ্ছল মানুষের দান, তাই বিস্ময় উদ্রেক করেছে সকলের। যাদবের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক বলেছেন “মানুষটার চরিত্রের কত আশ্চর্য দিকে যে একে একে পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে থাকে। এই উইলের বিষয় তাকে না জানানো, এও এক অসাধারণত্ব যাদবের। শেষ কয়েকটা দিনে তার যোগসাধনার ক্ষমতায় শশীর বিশ্বাস জন্মিলে যদি বুঝিতে না পারা যায় ও বিশ্বাস স্বত্যোৎসারিত, এর পিছনে আর কোনো পার্থিব বিবেচনার প্রেরণা নাই?” যাদবের অসাধারণত্ব বা অলৌকিকত্ব যেমন পরিচিত বাস্তব থেকে দূরবর্তী এক fantasy-র জগৎ, তেমনি গ্রামের সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কিন্তু এই অলৌকিকতা-স্পষ্ট নয়। গোপাল শশীর কাছে সব কথা শুনে বলে “এত টাকা লোকটা পেল কোথায় রে, এ্যা?” –আবার ছেলেকে সতর্ক করে দিল “ওয়ারিশ থাকিলে খবর পেয়ে তারা বোধহয় গোলমাল করবে শশী। মামলা মোকদ্দমা না করে ছাড়বে না সহজে। তুই না বিপদে পড়িস শেষে।” — এই সব প্রতিক্রিয়া বাস্তবধর্মী। গ্রামসমাজের বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত এই প্রতিক্রিয়া। এর দ্বারা বোঝা যায় গ্রামের মানুষের কৌতূহল, সন্দেহ এবং সঙ্কীর্ণতা কতদূর সক্রিয় ছিল, মানিকবাবু এই সমাজকে চিনেছিলেন ও সাহিত্যে রূপ দিয়েছিলেন। গোপালের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে লেখকের আর একটি মন্তব্য বেশ তাৎপর্যমূলক “একজন সৎকাজে যথাসর্বস্ব দান করিয়া গিয়াছে, আর একজন তাতে কিছু ভাগ বসাইতে চায়।” গ্রামের মানুষের পক্ষে এই উক্তি যে কতখানি বাস্তব তা বোঝা যায় গ্রামের মানুষের এই চিত্রণে। শীতলবাবু তাঁর প্রাধান্য সম্পর্কে সচেতন, তাই তিনি শশীকে ডেকে সব শুনে বললেন, “পণ্ডিতমশাই বলে এবং তিনি স্বর্গীয় বলে শশী, নইলে আমি থাকতে আমার গাঁয়ে আমাকে ডিঙিয়ে হাসপাতাল দেবার স্পর্ধা কখনো সইতাম না।” এই উক্তি শীতলবাবুর পক্ষে সুসঙ্গত। শীতলবাবুর চরিত্রটি লেখক স্বল্প রেখায় অঙ্কিত করে গ্রামসমাজের প্রধানদের মনস্তত্ত্বকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। শশী যখন শীতলবাবুকে হাসপাতালের স্থায়ী কমিটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে, তখন শীতলবাবু প্রীত হয়ে বলেন “প্রেসিডেন্ট হতে হবে নাকি আমায়?” শীতলবাবুর প্রভাব এত গভীর যে হাসপাতালের কমিটি নির্মাণ কিছুতেই হতে চায় না। “এমন কৌশলে শীতলকে বশ করিতে পারায় এবার সহজেই যথারীতি কমিটি গঠিত হইল।… মতান্তরের ভয়টা তার চেয়ে ওঁদেরও কম নয়।” গ্রামসমাজে কমিটি গঠনের পেছনে যে মতান্তরের ভয় থাকে, দলাদলির আশঙ্কা থাকে, এখানে তার চিত্র পাওয়া যায়। গ্রামের সামাজিক ব্যাপারের জটলায় জীবনে ডাক এসেছে শশীর। এইসব সভা সম্পর্কে শশীর অনুভূতি তীব্র ও অর্থবহ “আজ যে হুঁকা ও কাশির শব্দে মুখরিত সভায় তাকে সম্মানের আসন দেওয়া হইবে, কাল সেখানে তার জুটিবে টিটকিরি।” গ্রামসমাজের পরিণত ব্যক্তিদের সভা সম্পর্কে শশীর ধারণা বাস্তব ও যথাযথ।

চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে লেখক বাস্তবতাকে অবলম্বন করেছেন। গাওদিয়া গ্রামের নিম্নবিত্ত সংসারের মেয়ে। মতির স্বপ্ন ও জীবনযাত্রার পালাবদল রোমান্টিকতার বর্ণে রঞ্জিত হলেও মতির পরিবর্তনকে লেখক যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। রাজপুত্র প্রবীরকে স্বামী হিসেবে পেয়ে মতির সুখের সীমা নেই। গ্রামের প্রতি তার টান কেমন করে তার জীবনযাত্রার নতুন নতুন আকর্ষণে নিষ্প্রভ হয়ে গেল, তার ইঙ্গিত আছে তার অপরিণত মানসিকতায়। হোটেলে খেতে বসে ভাত নষ্ট হবে ভেবে যার আপশোসের সীমা নেই, হোটেলে কুমুদের জীবনযাত্রা দেখে মতি এতই অবাক হয়ে গেল, অবাক হয়ে গেল তার বন্ধুদের দেখে, ও পরে জয়া বনবিহারীর প্রতি তার বিস্ময়মাখানো দৃষ্টি সবই অঙ্কিত হয়েছে বাস্তবসম্মত রীতিতে। কুমুদের বন্ধুদের দেখে মতির মনে যে প্রতিক্রিয়া হয়, তাকে স্বাভাবিক ও সঙ্গত করেই বর্ণনা করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কুমুদের সঙ্গে মতির চলে যাওয়ার দৃশ্যটি এত নাটকীয় যে তাকে বিশ্বাস্য করে তোলার জন্য মতির আবেগকেই প্রধান কারণ বলে তুলে ধরা হয়েছে। এইভাবে চরিত্রটিকে বিশ্বাস্য করে তোলা হয়েছে।

শশী এই উপন্যাসের নায়ক। এই নায়ক চরিত্রের বিবর্তনের ক্ষেত্রে অন্তর্দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে এই চরিত্রটিকে বাস্তবধর্মী করে তোলা হয়েছে। শশীর মধ্যে দুটো মানুষ আছে একজন সমাজ ও সংসারের প্রতি কল্যাণকারী মানুষ, দায়িত্বশীল ও কর্মী মানুষ, কর্তব্যে অবিচল মানুষ, অন্যজন নিজের অনুভূতিতে নিভৃতে লালন করে নিজের দুঃখকে গোপন করে রাখে। এই দুটো মানুষের সমন্বয়ে যে ব্যক্তিত্বটি গড়ে উঠেছে, সেই ব্যক্তিত্বটি এই উপন্যাসের বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। শশীর পরিণতি তাই স্বাভাবিক ও সুসঙ্গত। কুসুম চলে যাওয়ার পর শশী নিজেকে চিনতে পারে। তার অন্তরের সুপ্ত প্রণয় তটিনীর উদ্ভাসিত বেগে আত্মপ্রকাশ করে। শশী আত্মবিস্মৃত হয়ে, কর্তব্যবিস্মৃত হয়ে নিজের জীবনের কেন্দ্রকে হারিয়ে ফেলে। কুসুমের প্রতি তার নির্বিকারত্ব শেষ পর্যন্ত আত্মগ্লানিতে পূর্ণ হয়ে এক কাঙালপনায় পরিণত হয়। এই পরিবর্তন অত্যন্ত বাস্তবধর্মী পরিবর্তন। শশীকে যেভাবে উপন্যাসে অঙ্কিত করা হয়েছে, তাতে এই পরিবর্তন না হলে শশী হয়ে উঠত অবিশ্বাস্য ও এক আদর্শবাদী যুবক। এমনকি কুসুমের সেই বিখ্যাত উক্তি যা দিয়ে শশীর নির্বিকারত্ব বোঝা যায়, সেই উক্তির মধ্যে লেখকের জীবনরহস্যসন্ধান সার্থকভাবে ফুটে ওঠে।

“কুসুম নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন ছোটবাবু?

শরীর। শরীর!

তোমার মন নাই কুসুম।”

এই সংলাপ চরিত্রচিত্রণের ক্ষেত্রে অসামান্য বাস্তবধর্মিতার পরিচায়ক। শশীর পরিণতি এই সংলাপের বিচারে যথাযথ। তাই শশী বিষণ্ণ হয়ে কুসুমকে বলে, “কই কথা শুধোবার জন্যে তালবনে আর তো আমায় ডাক না বৌ।”—অথবা “শশী জ্বালা বোধ করে। এ কি আশ্চর্য যে কুসুমকে সে বুঝিতে পারে না, মৃদু স্নেহসিঞ্জিত অবজ্ঞায় সাত বছর যার পাগলামিকে প্রশ্রয় দিয়াছিল? শশীর একটা দুর্বোধ্য কষ্ট হয়।” শশী চরিত্রের এই পরিণাম লেখকের বাস্তবধর্মিতার পরিচায়ক।

চরিত্রসৃষ্টির ক্ষেত্রে, পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ বাস্তবধর্মী উপন্যাস। গাওদিয়া গ্রামের জীবন্ত চিত্র যেমন এই উপন্যাসে পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় ঐ গ্রামের মানুষের সঙ্কীর্ণতা-সন্দেহ-স্নেহ-প্রীতি মিশ্রিত জীবনযাত্রার চিত্র। ব্যাধি ও মৃত্যুশাসিত এই জীবনে শশীই একমাত্র আশ্রয়, তাই শশী চরিত্র দেবতার অনুষঙ্গ নিয়ে এলেও তা মানুষের অসহায় নিয়তির ট্র্যাজেডিতে পূর্ণ। শশী-কুসুম সম্পর্কের বিবর্তনে লেখক এই সূক্ষ্ম ও অদৃশ্য সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে নরনারীর দেহমনের বাস্তব দাবীকে পরিস্ফুট করেছেন। এইসব দিক থেকে বিচার করলে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র বাস্তবধর্মিতা উল্লেখযোগ্য মর্যাদার দাবী রাখে।