‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-য় কুমুদ-মতির উপাখ্যান একটি ‘episode’ বা বৃত্তের মত গড়ে উঠেছে ও উপন্যাসের মূল স্রোতের সঙ্গে তা যুক্ত হয়ে একটি অখণ্ড ঐক্য রচনা করেছে। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসে লেখক জীবন রহস্যের এক গভীর উপলব্ধিকে প্রকাশ করেছেন। এই উপলব্ধির ক্ষেত্রেই এসেছে নানা শ্রেণীর নরনারী, নানা পুরুষ ও নারী চরিত্র। কুমুদ এমনই এক অপ্রচল ও প্রথাদ্রোহী চরিত্র যাকে মতির জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে লেখক তার জীবন-রহস্য ব্যাখ্যার গভীরতাকে প্রকাশ করেছেন। এই উপাখ্যানের উপযোগিতা উপন্যাসে শুধু এক নতুন বৈচিত্র্য দান করেছে তা নয়, লেখকের মূল দৃষ্টিভঙ্গীর প্রসারে ও রূপায়ণেও সাহায্য করেছে। এই দিক থেকে কুমুদ-মতি উপাখ্যানের উপযোগিতা যথেষ্ট গভীর। লেখক এই উপাখ্যানকে উপন্যাসের মূল কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করেছেন বলে তা উপন্যাসে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। উপন্যাসের সংহতির পক্ষে এই কাহিনীর গুরুত্ব যথেষ্ট।
মতি-কুমুদ উপাখ্যানের বৈশিষ্ট্য এই যে এখানে যাত্রাজগতের যে চরিত্রকে আনা হয়েছে, তা আমাদের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা থেকে পৃথক। অপরিচিত ও অপ্রচলিত জীবন ধারার চরিত্র। এই পরিচিত পরিবেশ থেকে পৃথক চরিত্রকে গ্রাম্য মানুষদের সাধারণের ভিড়ে স্বতন্ত্র বলে মনে হয়েছে। কুমুদ-চরিত্রের আস্বাদ স্বতন্ত্র। তার ‘বোহেমিয়ান’ জীবনযাত্রা পুতুল নাচের ইতিকথায় গাওদিয়া গ্রামের এক মামুলি জীবনযাত্রায় নতুন তরঙ্গ এনে দিয়েছে।
মতিকে নিয়ে উপন্যাসের সমস্যার শুরু। হারু ঘোষ মতির জন্য সুপাত্র আনতে গিয়ে বজ্রাহত হয়ে মারা যায়। উপন্যাসের শুরুতেই ভয়াবহ মৃত্যুদৃশ্য বর্ণিত হয়ে আছে—”খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছটার গুঁড়িতে ঠেস দিয়া হারু ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন। হারুর মাথার কাঁচা পাকা চুল আর মুখের বসন্তের দাগভরা রুক্ষ চামড়া ঝলসিয়া পুড়িয়া গেল। সে কিন্তু কিছুই টের পাইল না। শতাব্দীর পুরাতন তরুটির মূক অবচেতনার সঙ্গে একান্ন বছরের আত্মমতায় গড়িয়া তোলা চিন্ময় জগৎটি চোখের পলকে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে।” এই মৃত্যু যাকে ঘিরে সে মতির পিতা। মেয়ের জন্য বাজিতপুরে যোগ্য পাত্র দেখতে গিয়েছিল হারু। পথ সংক্ষেপ করার জন্য বিপথে পাড়ি দিতে গিয়ে জীবনের পথ তার সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল। মতির জন্য সুপাত্র সন্ধানে দায়িত্ব শেষে গিয়ে পড়ে শশীর ওপর। শশী তখন হারু ঘোষের পরিবারে প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে। পরান দুর্বল, উদাসীন। তাই শশীর নির্দেশে সে চলে। হারু ঘোষের মৃত্যুতে বাড়িতে সোরগোল বাধে। গাওদিয়ার গোপসমাজে উচ্চাশী হারু ঘোষকে ‘ভদ্দর লোক’ বলা হত। সুদেবের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব হারু ঘোষ খারিজ করে দেয়। শশীও তাকে আমল দেয় না। এইরকম একটা শূন্য অবস্থায় কুমুদ বিনেদিনী অপেরা পার্টির একজন অভিনেতা হয়ে আসে। কুমুদ কাহিনী শুরু হয় চতুর্থ পরিচ্ছেদ থেকে। তার আগে পর্যন্ত মতিকে দেখা যায় তার অফুরন্ত স্বপ্ন নিয়ে। গেঁয়ো মেয়ে মতি, বালিকা মতি শশীকে ভক্তি করে, শশীকে শ্রদ্ধা করে। “মতির ভারি ইচ্ছা, বড়লোকের বাড়িতে শশীর মতো বরের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। কাজ নাই, বকুনি নাই, নোংরামি নাই। বাড়ির সকলে সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে হাসে, তাসপাশা খেলে, কলের গান বাজায় আর বাড়ির বৌকে খালি আদর করে। চিবুক ধরিয়া তাহার লজ্জিত মুখখানি তুলিয়া বলে লক্ষ্মী বৌ, এমন না হলে বৌ।”—মতির এই স্বপ্ন তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। এই পটভূমিতেই মতি হঠাৎ কুমুদের সঙ্গে পরিচিত হয়। বিনোদিনী অপেরার দলে অভিনয় করতে এসে কুমুদের অভিনয় দেখে, প্রবীরের ভূমিকায় তার অভিনয় দেখে সে তাকে হৃদয় দান করে। এই প্রসঙ্গেই মতি-কুমুদের উপাখ্যান তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে মূল আখ্যানের সঙ্গে যুক্ত হয়।
মতি চরিত্র এই উপন্যাসে এক আশ্চর্য চরিত্র। কুসুমের পাশে মতি দুর্বোধ্য নয়। বালিকা বয়স থেকেই সে স্বপ্ন দেখে। ঘরে বসে বসে সে স্বপ্ন দেখে। “স্বপ্ন মতির অফুরন্ত। মস্ত একটি ঘরের এককোণে সে বসিয়া আছে। সর্বাঙ্গে তাহার ঝলমলে গহনা, পরনে ঝকঝকে শাড়ি। ঘোমটার মধ্যে চন্দনচর্চিত মতির মুখখানি কি রাঙা লজ্জায়।” এই স্বপ্নমূর্তি মতির কামনাকে উজ্জ্বল করে তোলে। পরানের বাড়িতে কুসুমের সঙ্গে কলহ ও নৈকট্যে তার দিন কাটে। “কুসুমের সঙ্গে আজকাল প্রায়ই ঝগড়া বাধে মতির। সকলের অগোচরে মতিকে কুসুম শশীর কথা তুলিয়া অন্যায় পরিহাস করিতে আরম্ভ করিয়াছে।”—শশীকে মতি পূজা করে, তাকে নিয়ে মতির শ্রদ্ধা ও বিস্ময়। তাই বিবাহের যোগ্য নায়ক যে শশীর মত হবে এ বিষয়ে তার আর দ্বিধা নেই। “বড়লোকের বাড়িতে শশীর মতো বরের সঙ্গে তার বিবাহ হয়।”—শশীরও তার প্রতি স্নেহের অভাব নেই। মতি কুমুদকে পেয়ে এই পূজা ও শ্রদ্ধাকেই খুঁজে পায়। তালপুকুরের বনে মতির সঙ্গে কুমুদের দেখা হয়। “নিঝুম দুপুরের অলস প্রহরগুলি ঘরে কি তাহার কাটে না? কে বলিবে?” পুকুরপাড়ে কানের একটি মাকড়ি হারিয়ে যাওয়ায় মতি তালপুকুরে আসে। কিন্তু মাকড়ি না পেয়েও তার লাভ হল। সে পেল কুমুদকে। কুমুদ সম্পর্কে তার মনোভাব এইরকম— “কুমুদ এ জগতের রক্তমাংসের মানুষ নয়, রূপকথার রাজপুত্র, মহাতেজা, মহাবীর্যবান, মহা-মহা প্রেমিক। হাঁ, কুমুদ মাটির পৃথিবীর কেহ নয়। পৃথিবীর সেরা লোক শশী, কুমুদ শশীর মতোও নয়।”—এই বীরপূজা থেকে মতির প্রেমের জন্ম। সে কুমুদকে নয়, রাজপুত্র প্রবীরকে বিবাহ করতে চায়। শেষে স্বপ্নের সেই আকাঙ্ক্ষা সার্থক হয়ে ওঠে। কুমুদ মতিকে বিবাহ করার প্রস্তাব শশীকে দেয়। কুমুদ শশীর কলকাতার বন্ধু। তাই শশী বিশ্বাস করতে পারে না ‘গেঁয়ো মেয়ে’ মতিকে কুমুদ বিবাহ করবে। তাছাড়া মতি ত’ বয়সে যথেষ্ট ছোট। গাওদিয়া গ্রামে কুমুদের আত্মনির্বাসনের কারণ যে মতি, তা শেষ পর্যন্ত জানা গেল। শশী যখন বলে মতি ত “একটা মুখ্য গেঁয়ো মেয়ে।” কুমুদ তখন উত্তর দেয়, “আমিও তো যাত্রাদলের সং।” শশী তাকে খেয়ালের বশে একটা গেঁয়ো মেয়েকে বিয়ে করে আজীবন জ্বলে মরতে নিষেধ করে। কিন্তু কুমুদ বিশ্বাস করে সঙ্গিনীকে তাকে সৃষ্টি করতে হবে নিজেকেই। মতির প্রতি শশীর বাৎসল্যভাব। তাই মতির সুখের কল্পনা শেষ পর্যন্ত শশীকে এই বিয়েতে মত দিতে হয়তো অনেকটা বাধ্য করে তোলে। কিন্তু মতিকে শশী যতটা জানে, তাতেই মনে হয় এই বিয়েতে জটিলতাও কম নয়। ‘খনিগর্ভে হীরার মতোই বটে মতি—তাকে একদিন অনুপমা ও জ্যোতির্ময়ী করে তোলাও সম্ভব। কিন্তু কুমুদ তাহা পারিবে না।” কারণ কুমুদ চরিত্রে স্বপ্ন সফল করার তপস্যা নেই। মতি ছিল সংসার-অনভিজ্ঞ। এ-পৃথিবীর নিয়ম-কানুন সে জানত না। যাত্রা দেখতে এসে সে সচ্ছ্বল সম্প্রদায়ের মানুষ, বিমলাবুর স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাতেই এই ব্যবধান সে বুঝতে পারে। বিমলবাবুর স্ত্রীর প্রশ্নে, মেয়ের ব্যঙ্গে তার বক্ষসম্পন্দন শুরু হয়। “সংসারে যেখানে যত টাকা সেখানে তত নারী, সেখানে তত পাপ। মতি সংসারের এ নিয়ম জানিত না। সংসারের কোন নিয়মটাই বা সে জানে? কাঁচা মেয়ে সে, বোকা মেয়ে। প্রায় কুড়ি বর্গফুট পরিমাণ পরিষ্কার চাদরের উপর পদ্দা করা ঘষামাজা সাজানো-গোছানো স্বজাতির মধ্যে আসিয়া পড়িয়া সে যেন দিশেহারা হইয়া গিয়াছিল।’ শশী ডাক্তারের বাড়ির মেয়ে, এই পরিচয়ে সে এই সম্প্রদায়ের মধ্যে স্থান পেয়েছিল। সংসারের এই শ্রেণীগত ব্যবধান সে বোঝে না। তাই সে সহজেই রাজপুত্র প্রবীরের ডাকে সাড়া দিয়ে অজানা নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি দিয়েছে। তার কাঁচা মন আনন্দের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়, যে কোন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার মনে উত্তেজনা-উদ্দীপনা হয়। যে কাঁচা মনে বিনা কারণেই সর্বদা আনন্দ ভরিয়া থাকে, যে কোনো একটা তুচ্ছ উপলক্ষে মনে যাহার উত্তেজিত সুখ হয়, শীতলবাবুর পরিবারের মেয়েরা যাত্রা শোনার উৎসাহ তাহার নষ্ট করিয়া দিয়াছে। মতি যেন চুরি করিয়া বাড়ি ফিরিল। তবু কি সুন্দর ওই মেয়েমানুষগুলি। এক একজন যেন এক একটি ছবি।”—এই বর্ণনার মধ্যে মতির মনের সারল্য ও হীনমন্যতাবোধ যেন ফুটে উঠেছে। এই মতি যে অজানা জীবনকে গ্রহণ করল, তা কিসের টানে? মতির জন্য শশীর চিন্তা বাড়ে। সে মতিকে কুমুদের বিশৃঙ্খল জীবনের ডাক বাঁচাতে নিজে বিয়ে করতেও রাজী হয়। কিন্তু নিয়তির অনিবার্য নিয়মে কুমুদের সঙ্গে মতির বিবাহ হয়ে যায়। বিয়ের পর মতি হনিমুনে চলে যায়। “গাওদিয়ার গেঁয়ো মেয়ে মতি, তাকে লইয়া কুমুদ চলিল হনিমুনে।” মতির এই পরিবর্তন দেখে পরান এবং অন্য সকলে অবাক হয়ে যায়। কুমুদের সঙ্গে মতি গিয়ে কলকাতার এক হোটেলে ওঠে। কলকাতার সিনেমা ও গঙ্গাতীরে কুমুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে মতি বিস্মিত হয়। কুমুদের খামখেয়ালী স্বভাব, আলস্যপ্রিয়তা সব দেখে অবাক হয়ে যায় মতি। কুমুদের ভালবাসার ধীর প্রকাশ মতিকে ক্লান্ত করে। যদিও ছোট-বড় সেবার সুযোগও সে পায়। “ভালবাসার এত ক্রমশ মতির ভাল লাগে না। তবে ছোট বড়ো সেবার সুযোগ মতিকে কুমুদ অফুরন্ত দিয়াছে।” মতির অস্থিরতা ও চাঞ্চল্য তার স্বভাবের বৈশিষ্ট্য। কুমুদের আশাভঙ্গ হয়। কুমুদ নিজেকে বন্দীনী মনে করে। নতুন জীবনে এসে মতির মনে nostalgia জাগে, ফেলে আসা গ্রামের পথে ঘাটে মতির মন ঘুরে বেড়ায়— “মনে হয়, কুমুদ তাকে চিরকাল এই ছোটো ঘরটিতে পা-টেপানোর জন্য আটকাইয়া রাখিবে। তার খেলার সাথী কেহ থাকিবে না, আপনার কেহ থাকিবে না, মাঠ ও আকাশ আর জীবনে পড়িবে না চোখে, বালিমাটির নরম গেঁয়ো পথে আর সে পারিবে না হাঁটিতে।” সাতদিনের মধ্যে মতির মনের এই পরিবর্তন তার নতুন জীবনের সঙ্গে অভিযোজনের ব্যর্থতাই প্রমাণ করে।
মতি গাঁয়ের মেয়ে। শহরের নতুন জীবনের ধারাকে সে বুঝতে পারে না। কিন্তু কুমুদের বন্ধুদের দেখে কে ভালো, কে মন্দ সে সহজেই বুঝতে পারে। বন্ধুদের মধ্যে বনবিহারীকে তার ভালো লাগে। বনবিহারীর সূক্ষ্ম রসিকতা শুনে সে একটু অবাক হয়ে যায়। এদের দেখে মতি কৌতুকে উদ্ভাসিত হয়, লজ্জিত হয়, আবার আনন্দ ও পায়। বনবিহারীর হাসির কথায় মতি হেসে ওঠে—কখনো কখনো সশব্দেই হেসে ওঠে। হোটেলে বন্ধুদের সঙ্গে তাসখেলা দেখে মতি দুঃখ পায়। তার কান্না আসে। সহজে সে নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না। মতি ঘর ছেড়ে বেরোতে পারে না। বন্ধু সমাগমে তাকেও চা-পান দিয়ে পরিচর্যা করতে হয়। এই নতুন জীবনধারায় মতির মন আবার nostalgia-তে আক্রান্ত হয়। জানালার ধারে বসে থাকতে থাকতে তার মন উন্মনা হয়ে যায়। “রাগে দুঃখে অভিমানে পাখি হইয়া মতির গাওদিয়া উড়িয়া যাইতে সাধ হয়।” বন্ধুদের জ্বালা থেকে মুক্তির জন্য মতি কুমুদকে আলাদা ঘর ভাড়া নেবার কথা বলে। বন্ধুদের জুয়ার আড্ডা দেখে সে বিরক্ত হয়ে পড়ে। কুমুদের নিয়মহীনতার ডাক শুনে মতি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। কুমুদ মনে করে মতি বৌ নয়, সাথী। কুমুদের কথা শুনে গেঁয়ো মেয়ে’ মতি ভয় পায়। প্রশ্ন করে কুমুদ কি তাকে ত্যাগ করবে।
জয়া-বনবিহারীর দেখা পেয়ে একটা ঘরোয়া জীবনের আশ্বাস পায়। মতির মধ্যে যে ঘরণী লুকিয়ে ছিল, সেই ঘরণী এতক্ষণে নিজের স্থান পেয়ে সুখী হয়। জয়ার ব্যবহার দেখে অবাক হয় মতি। সে কৌতুক বোধও করে। জয়ার ব্যবহার দেখে মতির এই সকৌতুক প্রশ্ন কুমুদকে সংশয়ী করে তোলে, কুমুদ ভাবে যে মতির মন বড় ছোট। কুমুদের বিরক্তি দেখে সহজেই তার চোখে জল পড়ে। কুমুদ ‘ছিচকাঁদুনে’ বলে তাকে আঘাত করে। কিন্তু মতিরও পরিবর্তন হয়। মতি সংসার সম্পর্কে হিসাবনিকাশ করে। কুমুদ চায় সে ছেলেমানুষ, নিজের স্ফুর্তিতে যেন দিন কাটায়। তাই তার প্রশ্ন, “এত কচি ছিলে গাওদিয়ায়, এত পাকলে কেন?” কুমুদের মনে হয় সে কি ছেলেমানুষির ভান করেছিল? এই সব বয়স্ক প্রশ্নে মতির চোখে জল আসে। ভাবপ্রবণ বলে মতির চোখে সহজেই জল আসে। কুমুদের জীবনযাত্রা তাকে কৌতূহলী করে তোলে। নতুন বাড়িতে উঠে এসে কোথা থেকে টেবিল-চেয়ার আলনা-তক্তপোয় চলে আসে, সে বুঝতে পারে না। নতুন আশার মোহে মতি বার বার আবিষ্ট হয়ে পড়ে। এতেই বোঝা যায় যে মতির মন কত সরল। কুমুদ চায় গাওদিয়ার কথা সে ভুলে যাক। জন্মের মত নতুন জীবনে চলে আসতে হবে। তালবনের অবুঝ বিহ্বল মনের প্রতিজ্ঞার কথা ভেবে মতির এখন ভয় জাগে। -“নতুন জীবন, নতুন জগৎ, পুতুলের মতো কুমুদের হাতে নড়াচড়া”—এসব দেখে মতি পুরোনো প্রতিশ্রুতি ভুলতে চায়। “জীবনে আর কোনদিন গাওদিয়ায় যাইতে পারিবে না ভাবিয়া মতির যখন কষ্ট হয়, কাঁচা মনে তখন কমবেশি আশা-আনন্দের সঞ্চার হয়। শৃঙ্খলার যথেষ্ট অভাব থাকিলেও জীবন এখানে মোটামুটি নিয়মানুবর্তী। আর মাঝে মাঝে কুমুদকে যতই ভয়ানক, নির্মম ও পর মনে হোক, কী একটা আশ্চর্য মন্ত্রে কুমুদ তাহাকে মুগ্ধ করিয়া রাখে।” কুমুদের এই মুগ্ধতার জন্য সে পরে নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়ায়।
কুমুদ প্রবীরবেশে একদা মতিকে মুগ্ধ করে। কুমুদ প্রকৃত অর্থে নায়ক। সে শিল্পী। শিল্পীর মতই সে বোহেমিয়ান। কোন বাঁধন সে মানে না। তার ঘর নেই, সংসার নেই, সে ছন্নছাড়া। মতি তার বধূ নয়, মতি তার সঙ্গিনী। তার চরিত্রে অনিয়মই নিয়ম। এই জীবনধারা মতিকে বিস্মিত করে, আকৃষ্ট করে। মতি এই জীবনধারার সঙ্গে পরিচিত নয়। বিয়ে করে সে হোটেলে উঠবে, হোটলে বসে বন্ধুদের সঙ্গে জুয়া ও তাস খেলবে, হোটেলে। ধার করে খাবে, হোটেলের মালিককে পয়সা না দিয়ে নতুন বাড়ির জন্য আসবাব কিনবে, এসব মতির কাছে চিরবিস্ময়ের ব্যাপার। সে মতিকে বিয়ে করে ভেঙ্গেচুরে নতুন করে গড়তে চায়। জীবনে কুমুদের এই খেয়ালীপনা, এই উচিত-অনুচিতের সীমারেখা লঙ্ঘন করে এগিয়ে চলা, বাকসর্বস্ব হয়ে জীবনকে কেবল ‘এপিকিউরান’ দৃষ্টিতে দেখা, এসবই কুমুদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। তার কল্পনা বিরাট, আকাঙ্খাও বিরাট, তার বড়ো বড়ো কথায় সায় দিয়ে যাওয়াই যে যথেষ্ট এটুকু মতিও বোঝে। তার কথায় সায় না দিলে, তার পথে না চললে সে ক্ষমা করবে না মতিকে। “জীবনে আর কিছুই কুমুদ চায় না, যখন যা খেয়াল জাগে সেটা পরিতৃপ্ত করতে পারিলেই সে খুশি। নিয়ম, দায়িত্ব, ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত এগুলি তার কাছে বিষের মতো। কথাসর্বস্ব বটে কুমুদ।” কুমুদ পুরোপুরি শিল্পী। যে কুমুদ একদিন প্রবীর বেশে গাওদিয়ার সর্বস্তরের নরনারীকে মুগ্ধ করেছিল, মতির হৃদয় জয় করেছিল, সেই কুমুদ তার শিল্পকে বনবিহারীর মত বাজারের মূল্যে বিকিয়ে দিতে চায়। কুমুদ তাই বনবিহারীর জন্য দুঃখবোধ করে। তার সহানুভূতি এই কথা ভেবে যে, শিল্পী অর্থাভাবে হয়ে উঠেছে পটুয়া। কুমুদ বেপরোয়া। তাই সে “ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেত” নীতিকে মেনে চলে।
হঠাৎ মতি দেখে তার সাধের গলার হারটা নেই। হার হারিয়েছে দেখে মতি বিভ্রান্ত। তালপুকুরের ধারে মতির কানের মাকড়ি হারিয়েছিল। কুমুদ তাকে না চাইতেই কিনে দিয়েছিল। শশীর উপহার দেওয়া এই অপূর্ব হার ত’ কুমুদ নেবে না। চারিদিকে ‘খোজ খোঁজ’ রব। সকলেই চিন্তিত। কুমুদ ফিরে এলে জয়া তাকে প্রশ্ন করতে সহজেই সে উত্তর দেয় “হারাবে কেন? আমি বিক্রি করেছি।” কুমুদ সহজ ও স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দেয়। কুমুদ মনে করে হার থেকে কোন লাভ নেই। টাকাটা ত’ কাজে লাগে। কুমুদ মনে করে “গয়না যেসব মেয়েমানুষের সর্বস্ব আমি তাদের দুচোখে দেখতে পারি না।” কুমুদের চিন্তাধারার এই বৈশিষ্ট্য জয়ার কাছে অপরিচিত নয়। -তাই কুমুদ যখন জয়াকে বলে “তুমি বুঝি ভেবেছ বাড়ি ভাড়ার টাকা দেবার জন্যই আমি হার বিক্রি করেছি।” তখন জয়া তাকে বলে “অনেকদিন থেকে তোমায় জানি আমি কুমুদ, আমার কাছে হেঁয়ালি কোরো না।” কুমুদের এমন করে সত্যকথা বলার জন্য শক্তি জয়ারই ছিল। প্রবীর বেশে কুমুদ যে মতিকে মুগ্ধ করেছিল, একথা মতি ভুলতে পারে না। কুমুদ মতির অভিমান ভোলাবার জন্য থিয়েটারে নিয়ে যায়। যোগেশের বূমিকায় তার অভিনয় দেখতে দেখতে মতির মনে পড়ে প্রবীরবেশী কুমুদের কথা। “আলোকোজ্জ্বল ষ্টেজের দিকে চাহিয়া যোগেশকে মতি আর দেখিতে পায় না, দ্যাখে রাজপুত্র প্রবীরের বেশে কুমুদকে। সুখে গর্বে মন ভরিয়া ওঠে মতির।” কুমুদ চলতি হাওয়ার পথ্বী। টাকা জমাবার প্রবণতা তার নেই। জয়া বলে যে সে যেন লুকিয়ে কিছু টাকা জমায়, তখন মতি তা করতে অস্বীকার করে। কারণ কুমুদের কাছে টাকা কোনদিন অন্তরায় নয়। কুমুদের মতামতগুলো স্বতন্ত্র। কুমুদও অনন্য। “কুমুদের যেমন তুলনা নাই, কুমুদের মতামতগুলিও তেমনি অতুলনীয়। তেজের সঙ্গে টাকাপয়সা রীতিনীতি লইয়া ছিনিমিনি খেলার চেয়ে আর কিসে বেশি মজা? তারপর যা হয় হইবে।” কুমুদের স্বভাবে এই বেপরোয়া উদ্দামতা মতিকে মুগ্ধ করেছে বার বার। কুমুদের রোগ দায়িত্বহীনতার। এই রোগ তার দূষণ নয়, ভূষণ। ‘গেঁয়ো মেয়ে মতির মধ্যে এ রোগ সংক্রামিত করে দিতে চায় সে।
কুমুদের কোন কিছু স্থায়ী নয়। তাই জীবনযাত্রায় কোন স্থায়ী ঠিকানা নেই। স্ফূর্তি আর আনন্দ তার চিরসঙ্গী। তার প্রেমে আছে বৈচিত্র্য, রোমাঞ্চ আর সর্বগ্রাসী দৃষ্টি। সে মতিকে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে গাওদিয়ার জীবন, তার সামনে এনেছে নানা অনিশ্চয়তার রোমাঞ্চ, এইভাবে সে মতিকেও নতুন করে সৃষ্টি করে নিতে চায়। কুমুদের এই নতুন নতুন রূপ দেখে মতিও তাকে নতুন করে ভালবাসতে শুরু করে।
কুমুদ যাত্রা করতে দেশান্তরে পাড়ি দিতে চায়। মতিকে এবারে সে সঙ্গে নিতে চায় না। তাই সে মতিকে কমাসের জন্য গাওদিয়ায় রাখতে চায়। কুমুদ দল গড়ে, টাকা পয়সা জমিয়ে সবই গুছিয়ে নিতে চায়। এ সব সুবিবেচনার কথা মতির কিন্তু ভাল লাগে না। “এ ধরনের কথা কি মানায় কুমুদের মুখে? মতি এই সুবিবেচক কুমুদকে চেনে না। কুমুদ বলতে বোঝায় বেহিসেবিপনা, অবিবেচনা, দায়িত্বহীনতা। এই উদ্দাম ‘বোহেমিয়ান’ প্রকৃতিকে মতি ভালবাসে। কুমুদ চলে যায় নিরুদ্দেশের পথে। মতিও কৌশল করে তার সহযাত্রী হয়। কুমুদ-মতি অধ্যায় হয়ে ওঠে এক রহস্যজনক অধ্যায়। কুমুদ চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে তাদের জীবন, তাদের শিল্প-অন্বেষা, তাদের বেঁচে থাকার রসদসন্ধান। জীবনকে উপভোগ করার জন্য সব ঝুঁকি নিয়ে বাঁচতে চায় কুমুদ। কুমুদ প্রকৃত অর্থে শিল্পী। মতি এই শিল্পীর সঙ্গিনী, তাই তাদের চলার পথ শেষ পর্যন্ত এক হয়ে যায়।
Leave a comment