‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক সার্থক উপন্যাস। এই উপন্যাসে লেখক মানবচরিত্রাভিজ্ঞতা ও জীবনদর্শন এক গভীর জীবনরহস্যকে সন্ধান করেছেন। উপন্যাসে পাত্র-পাত্রীর কর্মধারা সংঘাতের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। প্রতিটি চরিত্র তার পরিবেষ্টনীর মধ্যে থেকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছে। মানিকের শিল্পী-চেতনায় ছিল জীবন রহস্যের উপলব্ধি। এই জীবন রহস্যকে তিনি প্রেম-যৌনতা-কামনা-বাসনার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছেন। মানিকের জীবন-জিজ্ঞাসায় ফ্রয়েডীয় ‘লিবিডোর’ প্রভাব থাকলেও মানুষের পশ্চাতের অন্ধ শক্তির প্রতি তাঁর আস্থা যে কত গভীর ছিল, এই উপন্যাস পাঠে তা জানা যায়। মানিকের জীবন-জিজ্ঞাসায় ছিল ঐকান্তিক জীবন-সন্ধান। তাই শশীর জীবন-সন্ধান ও পরিণামের মধ্যে এই শিল্পীর সংবেদনশীলতা ফুটে উঠেছে।

মানবজীবনের সংকট ও সংকল্প সংঘাত নিয়ে আসে তখন মানুষের গতি স্নথ হয়, স্তব্ধ হয়ে যায়। নচেৎ তা হয়ে ওঠে নানা পথে বিবর্তিত। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের নানা বৃত্তের নানা চরিত্রের মধ্যে এই অস্তিত্ত্বের সংকট চিত্রিত হয়েছে। জীবন তার পূর্ণ প্রয়াসের মধ্যে দিয়েই অগ্রসর হয়, কিন্তু তবু সব কাজের অন্তরালে যেন কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে নিয়ন্ত্রিত করে। এই অস্তিত্ববাদী দর্শন (Existentialist philosophy) এই পর্বে মানিকের জীবন-জিজ্ঞাসায় রূপ নিয়েছিল। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ ভারতীয় ভাষায় সর্বাধিক অনুদিত গ্রন্থ মানিক সাহিত্যের মধ্যমণি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনসংগ্রাম সচেতন শিল্পী বলেই এই উপন্যাসে তিনি ব্যক্তির প্রয়াসকে নানা সামাজিক ও পরিবেশগত বাধার মধ্য দিয়ে নিষ্ফল ক্রন্দনে ভেঙে পড়তে দেখেছেন। এই উপন্যাসের নায়ক তাই দেখেছে সব কর্মের পশ্চাতে এক অদৃশ্য শক্তি তাকে চালিত করেছে। কিন্তু এই উপন্যাসটির দ্বিতীয় সংস্করণের গ্রন্থ পরিচিতিতে লেখা হয়েছে—“পৃথিবীর এই বিরাট রঙ্গমঞ্চে মানুষ যেন শুধু পুতুল। কোন অদৃশ্য হাতের সুতোর টানাপোড়েনে মানুষ নাচে, কাঁদে, কথা বলে। নদীর মতো নিজের খুশিতে গড়াপথে তার জীবনের স্রোত বয়ে চলে না। মানুষের হাতে-কাটা খালে তার গতি।”

‘পুতুল নাচের ইতিকথা-র নানা চরিত্র, নানা ঘটনা, নানা ‘বৃত্ত’ বা episodes’ এইসব চরিত্রমালার মধ্যে কেন্দ্রীয় চরিত্র শশী। শশী গাওদিয়া গ্রামের ছেলে, গ্রামে সব মানুষের মধ্যে একাত্ম হয়ে বড় হয়ে শেষে কলকাতায় গিয়ে পাশ করা ডাক্তার হয়ে এসে গ্রামের মানুষদের সেবাকর্মে সে ব্রতী হয়। গ্রামের মানুষের সুখদুঃখের সঙ্গে একাকার হয়ে ওঠে। গ্রামের দুঃখী, আর্ত, বিপন্ন মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে সে এগিয়ে যায় তাদের দুঃখকষ্ট দূর করতে। শশী আদর্শবাদী ডাক্তার। সকলের সঙ্গেই তার সংযোগসূত্র। তাই তার চিন্তা-ভাবনার দর্শনেই অন্যান্য চরিত্রের সুখদুঃখ প্রতিফলিত হয়ে ওঠে। সে প্রধান চরিত্র, তার জীবনের নানা ঘটনা, নানা কাহিনী অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত হলেও কেন্দ্রে আছে কুসুমের সঙ্গে তার সম্পর্ক। কুসুম পরানের স্ত্রী, কিন্তু সে এই জীবনে তৃপ্ত নয়। শশীর প্রতি তার দুর্নিবার আকর্ষণ তাকে নানা উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে এক করুণ পরিণতিতে উপনীত করেছে। তাই উপন্যাসের মূল আখ্যান শশী-কুসুমের প্রণয় কাহিনীর বিচিত্র পরিবর্তন। শশী চরিত্রে নানা স্তর আছে, আছে নানা দ্বন্দ্ব। কলকাতায় গিয়ে বই ও বন্ধুর প্রভাবে তার অনুভূতি মার্জিত হয়েছে। তার দৃষ্টিভঙ্গিতে এসেছে বিজ্ঞানমনস্ততা, তার যুক্তিবাদী মন নানা ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্ন করতে তৎপর হয়েছে। কিন্তু তবু যামিনী কবিরাজের স্বেচ্ছামৃত্যুর অলৌকিকতাকে সে যুক্তিবোধের বাইরে গিয়ে স্বীকৃতি জানিয়েছে। জীবন সম্বন্ধে সে সচেতন মানুষ, মননশীল মানুষ, কিন্তু সেও শেষ পর্যন্ত যামিনীর ইচ্ছামৃত্যু দেখে, তার অলৌকিক শক্তি দেখে বিস্মিত হয়, অভিভূত হয়। “সে, ম্লেচ্ছ নাস্তিক, শেষ পর্যন্ত অবিশ্বাস করিয়া আসিয়াছে যাদবের অলৌকিক শক্তিতে।” তাকে এই অলৌকিক শক্তিতে বিদ্বান করানোর জন্য যাদবের শেষ পর্যন্ত চেষ্টার শেষ ছিল না। শশীর মনের অন্তরালের এই ‘গ্রাম্য কুসংস্কার’, যুক্তির অতিরিক্ত কিছু হয়ত বিশ্বাসের মধ্যে পুতুল নাচের নিয়ন্ত্রীকে বিশ্বাস করার” প্রেরণা সৃষ্টি হয়েছে।

শশী-কুসুমের সম্পর্কের বিবর্তন তাদের পশ্চাতে এক অদৃশ্য শক্তির ক্রীড়া ছাড়া কিছু নয়। কুসুমকে শশী প্রথম দিকে আমল দেয়নি তার গভীর ও উন্মাদ ভালবাসার রূপ যখন তালবনের ধারে উন্মোচিত হয়েছে, নানা অছিলায় কুসুম যখন শশীর কাছে ছুটে এসেছে, তখন শশী তাকে বুঝতে পারেনি। এই “অনবধানের অপরাধে’-র মূল্য শশীকে দিতে হয়েছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষা করে কুসুমের মন যখন মরে গেছে, কুসুম যখন বুঝেছে শশী গাওদিয়ারবহুজনহিতায়’ নিজেকে উৎসর্গ করেছে, তার সুখস্বপ্নের নীড় তখন অলীক হয়ে গেল। প্রথমদিকে শশী যখন কুসুমকে বুঝতে পারল না, তখন সহস্র চেষ্টাতেও পরে আর শশী তাকে বাঁধতে পারল না। সে তখন নিয়তির নির্দেশে জীবনের নিয়মেই যেন অন্য পথে চলে গেছে। এই দুস্তর বিচ্ছেদ শশীর কাছে দুঃসহ হয়ে উঠল। চুরমার হয়ে গেল শশীর জীবনস্বপ্ন। শশী হয়ে উঠল ট্র্যাজিক নায়ক। শশী-কুসুম আখ্যানে শশীর এই ট্র্যাজেডির জন্য কে দায়ী? কোনো এক অদৃশ্য শক্তি পুতুলের মতো শুধু তাদের জীবনরঙ্গমঞে খেলিয়েছে। এই বোধই শশীর কাছে সত্য হয়ে উঠেছে। কুসুম চলে যায় ভেঙে দিয়ে যায় শশীর মন। এই ভাঙা মন নিয়ে সে হাসপাতালের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে। রোগী দেখতে গিয়ে সে রুক্ষ হয়ে ওঠে। সে কেন্দ্রভ্রষ্ট হয়ে যায়। অমূল্যকে সে হাসপাতালের ভার দিয়ে চলে যেতে চায়। পুত্রের দেশছাড়া হবার সম্ভাবনায় গোপাল বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। শশী সম্পর্কে মনে হয় “জীবন সম্বন্ধে যে অমন তীব্রভাবে সচেতন, সে হইয়া থাকে পুতুলের মত চেতনাহীন।” ভাই শত চেষ্টা সত্ত্বেও সে যখন কুসুমকে ধরে রাখতে পারে না, তখন তার মনে হয় তার জীবনের পথ আলাদা। জীবনপথের এই গতি পরিবর্তন মানুষের হাতে নেই—”নদীর মতো নিজের খুশিতে গড়া পথে কি মানুষের জীবনের স্রোত বহিতে পারে? মানুষের হাতে কাটা খালে তার গতি এক অজানা শক্তির অনিবার্য ইঙ্গিত। মাধ্যাকর্ষণের মত যা চিরন্তন অপরিবর্তনীয়।” এইজন্য তার জীবনে কুসুম বিদায় নেয় তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তালবনের রমণীয় সকাল-সন্ধ্যা চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়। “ডালবনে শশী আর কখনো যায় না। মাটির টিলাটির উপর সূর্যাস্ত দেখিবার শখ এ জীবনে আর একবারও শশীর আসিবে না।” শশীর এই ট্র্যাজেডির জন্য দায়ী তার ‘নেমেসিস’ তার নিয়তির অদৃশ্য অঙ্গুলিনির্দেশ। কুসুমের দুঃখও সীমাহীন। সে সুখেই বাপের বাড়িতে মানুষ হয়েছে, কিন্তু শ্বশুরবাড়ির সংসারে তার ভাগ্যে অনেক কষ্ট দেখা দিল। আদরেই সে হয়ে উঠেছিল খামখেয়ালী স্বভাবের। যে ভালবাসা চেয়েছিল, সে ভালবাসা সংসারে সে পায়নি। পেয়েছিল শাশুড়ীর কটুকথা, পরানের ব্যর্থ জীবন, আর শশীর মতো নায়কের কাছে নিষ্ফল প্রেম। নৌকায় যেতে যেতে তার বাবা অনন্ত এইজন্যই শশীকে বলেছে—“ছোটো মেয়ে, বড়ো দু’বোনের বিয়ের পর ঐ ছিল কাছে, বড্ড আদরে মানুষ হয়েছিল—একটু তাই খেয়ালী হয়েছে প্রকৃতি। সবচেয়ে ভালো ঘর বর দেখে ওর বিয়ে দিলাম। ওর অদিষ্টেই হল কষ্ট। সংসারে মানুষ চায় এক, হয় আর, চিরকাল এমনি দেখে আসছি ডাক্তারবাবু। পুতুল বই তো নই আমরা। একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।” অনন্তর ওই উক্তি তার অভিজ্ঞতালব্ধ জীবন-সত্য। শশী-কুসুমের জীবনের ট্র্যাজেডি পুতুল নাচের মতো অসহায়, কোন অদৃশ্য শক্তির নিয়ন্ত্রণী ব্যাপার।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র অধিকাংশ চরিত্রই এইরূপ আকস্মিক, অঘটনের দুৰ্দ্দৈবের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। অনন্তর উক্তি “সংসারে মানুষ চায় এক, হয় আর”, এই কথাই ফুটে উঠেছে মতির জীবনে, বিন্দুর জীবনে। মতি ও বিন্দু এই উপন্যাসে এক নির্মম ট্র্যাজেডির শিকার। মতি গ্রামের “কাঁচা মেয়ে, একেবারেই কাঁচা মেয়ে”। কোথা থেকে তার জীবনে এল প্রবীররূপী কুমুদ, তার জীবন হয়ে গেল এলোমেলো। ছেলেবেলায় তার স্বপ্ন ছিল শশী, শশীর মতো বর। মতির ভারি ইচ্ছা, বড়লোকের বাড়িতে শশীর মতো বরের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। কাজ নেই, বকুনি নেই, কলহ নেই, নোংরামি নেই, বাড়ির সকলে সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, হাসে, তাস-পাশা খেলে, কলের গান বাজায়, আর বাড়ির বৌকে খালি আদর করে। এই স্বপ্রাণতা তার এলোমেলো হয়ে গেল কুমুদের সঙ্গে বিবাহের পর এক ছিন্নমূল যাযাবর জীবনে। যাত্রার আসরে দেখা রাজপুত্র কুমুদের যে পরিচয় পায়, সে পরিচয় তাকে টেনে নিয়ে যায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। গাওদিয়ার সঙ্গে হয় তার চিরবিচ্ছেদ। বিনোদিনী অপেরার কুমুদ তাকে তালপুকুরের ধারে দেখে। প্রবীর নিজের হাতে মাকড়ি তাকে পরিয়ে দেয়। শশীর কলকাতাবাসের বন্ধু কুমুদ শেষ পর্যন্ত মতিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। শশী এতে অবাক হয়—“ওইটুকু একটা মুখ্যু গেঁয়ো মেয়ে।” কুমুদ উত্তরে বলে “মতি মুখ্যু গেঁয়ো বটে, আমিও তো যাত্রাদলের সং। মতির প্রতি শশীর একপ্রকার বাৎসল্য মেশানো মমতা আছে। তাই তার বিনিদ্র দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। শেষে শশীর মনে হল “হয়তো সত্যই একদিন সে মতিকে রূপে-গুণে অতুলনীয়া করিয়া তুলিবে।” মতিও স্বপ্ন দেখত, কুমুদও স্বপ্ন দেখে। কিন্তু স্বপ্নকে সফল করার তপস্যা নেই বলে কুমুদের জীবন শেষ পর্যন্ত এলোমেলো, অস্থির ও নিরুদ্দেশের পথের যাত্রী হয়ে যায়। মতি গাওদিয়ার নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বিয়ের পর কুমুদের মতো বোহেমিয়ানের সঙ্গে সে হনিমুন করতে যাচ্ছে এ কথাও ছিল অবিশ্বাস্য। কিন্তু এই পথেই মতির জীবনপথ পরিচিত পৃথিবী থেকে অনেক দূরে চলে গেল। বিয়ের পর যে জীবনে মতি এসে পড়ে, তা গাওদিয়ার মেয়ের পক্ষে অচিন্ত্যপূর্ব। হোটেলের জীবন, কুমুদের আলস্যমোহ, অদ্ভুত সব বন্ধুদের সঙ্গে বসে আপত্তিকর আড্ডা, লোককে প্রতারণা করে নতুন বাড়িতে বনবিহারী-জয়ার কাছে এসে ওঠা, আবার সেখান থেকেও উধাও হয়ে যাওয়া, শশীর উপহার দেওয়া হার হারিয়ে যাওয়া ও শেষে কুমুদের স্বীকৃতি এসব যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা মতির সরল মনে আঘাত দেয়। গাওদিয়ার জন্য তার মন চঞ্চল হয়। শেষে কুমুদ যাত্রার ডাকে নানা দেশে ঘুরতে হবে বলে মতিকে বাপের বাড়ি রেখে দিয়ে আসতে চায়। এসব অভিজ্ঞতা এত অসঙ্গতিতেপূর্ণ যে মতির জীবন কোথাও প্রতিষ্ঠা পায় না, চলে যায় নিরুদ্দেশের পথে। মতির জীবনের এই যে অবিশ্বাস্য পরিবর্তন তা মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরের কোন শক্তি থেকে উৎসারিত। মতির জীবন যে পুতুল নাচের মত কোন শক্তির দ্বারা এখানে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে তার জীবন্ত পরিচয় পাওয়া যায় এই আখ্যানে।

বিন্দুও এই একই নিয়তিচক্রের শিকার। “জীবনের অজ্ঞাত রহস্য গাওদিয়ার বিন্দুকে গ্রাস করিয়াছে। কলিকাতার অনামী রহস্য।” বিন্দুর জীবন নন্দলালের কক্ষপথে এসে পরিবর্তিত হয়েছে। বিন্দুও মতির মতো অমায়িক, কিন্তু সেও হয়ে উঠেছে রহস্যময়ী। বিন্দু প্রেমের বিষামৃত পান করে নিজেকে নিঃশেষ করেছে। বিন্দুকে নন্দলাল গয়না-কাপড়ের প্রাচুর্যে পূর্ণ করে দিয়েছে। কিন্তু না জানিয়ে গাওদিয়ায় যাওয়ার জন্য নন্দলাল অশ্রাব্য ভাষায় তাকে গালিগালাজ দিয়েছে। নন্দলাল তাকে রক্ষিতা করে রেখেছে, মনে করেছে সে “গছাইয়া দেওয়া বৌ, প্রাণভয়ে গ্রহণ করা বৌ, লেখাপড়া-নাচ-গান কিছু না জানা বৌ, জীবনের অপূরণীয় ক্ষতি।” বিন্দুকে দেখে লোকে ভেবেছে যে সে সুখে আছে, কিন্তু বিন্দুর কষ্টের কোনো শেষ নেই। বিন্দুর এই জীবনের জন্য অদৃশ্য শক্তিই দায়ী। বিন্দুর জীবনে যে অঘটন তা শুরু থেকে তাকে তাড়িত করেছে। তা দেখে মনে হয় মানুষের জীবনের খেলা পুতুল নাচের সঙ্গে তুলনীয়। কোনো অদেখা সুতোর টানে যে সে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে, কেউ জানে না।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-য় কুসুম, বিন্দু, মতি, সেনদিদি সবই এক অদৃশ্য শক্তির নিয়ন্ত্রণে বিবর্তিত হয়েছে বলে তাদের জীবন সম্পর্কে মানিকের জীবনরহস্যবোধ এত গভীর। বিন্দু চরিত্রের জেদ, তার আসক্তি তাকে পথ থেকে সরে যেতে দেয়নি। গাওদিয়ার সঙ্গে সে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। আবার নন্দলালের কাছে ফিরে গিয়েও সে স্বস্তি পায়নি। নন্দলাল বিন্দুকে আঘাত করেছে, শেষ পর্যন্ত নিজেকে সর্বনাশের গহ্বরে টেনে এনেছে বিন্দু। পরাজিত নন্দলাল শেষ পর্যন্ত ট্র্যাজিক চরিত্র হয়ে পড়েছে। শশীর ট্র্যাজেডি ও নন্দলালের ট্র্যাজেডির মধ্যে পার্থক্য যথেষ্ট। তবু প্রত্যেকটি ট্র্যাজেডি স্বতন্ত্র। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র এক একটি চিত্র।