ঔপন্যাসিক-এর কাজ হল জগৎ-জীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা। মানুষের বিশ্বভুবনে। কেউ পর কল্যাণে ব্রতী, কেউ বা স্বার্থপরতার সংকীর্ণ কূপে নিজেকে নিমজ্জিত রাখে। স্বার্থসর্বস্ব চরিত্রের নমুনা তুলে ধরতে গিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় গোপাল দাসের চরিত্রটি অঙ্কন করলেন। শশী চরিত্রের বিপরীতে তার অবস্থান। অপ্রধান চরিত্র হলেও উপন্যাসে তার প্রাধান্য অস্বীকার করার নয়। সত্য সত্যই অত্যুজ্জ্বল এক চরিত্র রূপে গোপাল দাস স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। এ উপন্যাসে এক সমস্যা সংকুলতার চিত্র আঁকা হয়েছে। মূলীভূত সমস্যা হল শশীর জীবন সমস্যা। শশীর মনের সমস্যা, শশীর সত্ত্বার মূলীভূত সমস্যাই এ উপন্যাসের বিষয়। পিতা গোপাল দাস শশীর জীবনে একটা বড়ো অন্তরায়। বলা যেতে পারে শশী চরিত্রকে দ্বন্দ্বময় করে তুলেছে গোপাল। এই বিষয়টি গোপাল উপন্যাসের মধ্যে তার অসাধারণ উপযোগিত্বের দিককে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এই গোপাল চরিত্রে উপযোগিতা দিককে প্রাধান্য দান করে সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন : “তাহার পিতা গোপালের সহিত সংঘর্ষ তাহার জীবনের আর একটি প্রবল বাধা, তবে শেষপর্যন্ত পিতৃস্নেহসুলভ কৌশল শশীকে পরাজিত করিয়া শশীকে গ্রাম ত্যাগের সংকল্প পরিত্যাগ করিতে বাধ্য করিয়াছে।” গোপাল চরিত্বের মধ্যে স্বার্থপরতা, কুটিলতা, অর্থের প্রতি লোভ লোলুপতা প্রভৃতি নীচতার দিক লক্ষণীয়। অর্থাৎ চরিত্রটি মানবিক চরিত্র গুণে সমৃদ্ধ নয়, তার মধ্যে বেশ কিছু পাশবিক প্রকৃতি বিশেষ রূপে প্রাধান্য পেয়েছে।
গোপাল সুদখোর মহাজন। লোকের সর্বনাশ করায় তার বিশেষ খ্যাতি আছে। মহাজন ও দালালি যার পেশা, সে যে মানব কল্যাণের সঙ্গে যুক্ত হবে না—একথা বলা যায়। তাই গোপাল মহাজন ও দালাল রূপেই পরিচিত। এ সম্পর্কে লেখক জানিয়েছেন : “গোপাল দাসের কারবার লোকে বলে গলায় ছুরি দেওয়া। অর্থাৎ দালালি ও মহাজনি। শোনা যায় এককালে সে নাকি বার তিনেক জীবন্ত মানুষের কেনাবেচার ব্যাপারেও দালালি করিয়াছে—তিনটি বৃদ্ধের বউ জুটাইয়া দেওয়া…।” গোপাল লোক হিসাবে ভালো নয়। বুড়া যামিনী কবিরাজ তাকে দেখা হলেই রীতিমতো শাপ দেয়। গ্রামের বউ ঝি-রা গোপাল সম্পর্কে কলঙ্ক রটায়। টাকা পেলে গোপালের মতো মানুষ সবকিছুই করতে পারে। তিন মেয়ে এবং এক ছেলের বাপ যে শশীই গোপালের একমাত্র ছেলে, মেয়ে আছে তিনটি। কীর্তিমান্ত গোপালের কত কীর্তি। বড়ো মেয়ের বিয়ে দিয়েছে একটা ঘোড়ার সঙ্গে। মেজো মেয়ের বর নন্দর কীর্তিকলাপও প্রশংসনীয়, নন্দলালের সঙ্গে মেজো মেয়ে বিন্দুবাসিনীর বিয়েটা যেন এক অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক ঘটনা। নন্দলালের সঙ্গে বিন্দুর বিয়ের ব্যাপারে গোপাল মূলত ছলনার আশ্রয় নিয়েছিল। এ সম্পর্কে ঔপন্যাসিকের বিবৃতি “নন্দলালের কারবার পাটের। বছর সাতেক সে একবার এদিকে আসিয়াছিল। গোপাল তাহাকে ডাকিয়া লইয়া গিয়াছিল নিজের বাড়ি, আদর যত্ন করিয়াছিল ঘরের লোকের মতো। তিনদিন পরে গোপালের অনুগত গ্রামবাসীরা লাঠি হাতে দাঁড়াইয়া বিন্দুর সঙ্গে নন্দলালের বিবাহ দিয়াছিল।” এই হল গোপাল চরিত্রের ঐতিহাসিক কীর্তির নমুনা।
গোপাল তার দৃষ্টি নিয়ে জগৎ ও জীবনকে দেখে। শশীর জীবনদৃষ্টি ভিন্ন। ফলে মনান্তর, মতান্তর হতেই থাকে। বিষয়ী বুদ্ধি সম্পন্ন গোপাল ছেলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতন। যামিনী কবিরাজের স্ত্রী সেনদিদির চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে না করে গোপাল শশীকে। এ ব্যাপারে গোপালের পরামর্শ : “সংসারে মানুষকে ভেবেচিন্তে কত সাবধানে চলতে হয় সে জ্ঞান তোমার এখনো জন্মায়নি। শশী বুঝিতে পারিয়াছে সাংসারিক বুদ্ধিতে বাপের চেয়ে সে ঢের বেশি কাঁচা, গোপাল এখনো তাহাকে পরিচালনা করিতে পারে।” তবে শশীর সঙ্গে গোপালের দিন দিন সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। গোপাল ছেলের সঙ্গে আজকাল প্রায় কথা কওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। যামিনী কবিরাজের বউকে বাঁচাতে গিয়ে শশী দূরে কোথাও যাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। গোপাল রেগে ছেলেকে বলে বসে—“তোমার যা সব কীর্তি ! তুই উচ্ছন্ন যাবি শশী।” ছেলেকে আয়ত্তে আনতে না পেরে গোপাল বলে—“সব ছেড়ে ছুড়ে আমি কাশী চলে গেলে তুমি বোধহয় খুশি হও।” গোপালের এজাতীয় আক্রমণ শশীর গা সওয়া হয়ে গেছে। শশী এ সব কথায় ভয় করে না কিংবা বিশ্বাস করে না। গোপালের সঙ্গে শশীর চূড়ান্ত বিরোধ বাধে বিন্দুকে কোলকাতা থেকে গাওদিয়ায় নিয়ে আসার পর। বাবা হয়েও সে মেয়ের ভালো চায় না। তার কাছে মেয়ের চেয়ে অর্থ সম্পদ বড়ো। শশীকে সে ধমক দিয়ে বলে—“কেন তুই ওকে নিয়ে এলি, শশী। তোর কর্তালি করা কেন, রেখে আয় গে ; আজকে চলে যা।” সেই অবসরে সে মেনে নিয়েছে বিন্দু আসার সময় কোনো গয়নাগাঁটি এনেছে কিনা। সব মিলিয়ে শশী চরিত্রের ক্রমবিকাশে গোপালের একটা বড়ো অবদান বিদ্যমান।
গোপাল পিতা, বাৎসল্য রস তার অন্তরেও বিদ্যমান। আসলে সে চায় ছেলের অর্থ প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ুক। কিন্তু ছেলের সঙ্গে তার মত ও মনের মিল হয় না। ফলে বাক্যালাপ হয় বন্ধ। বাড়ে মানসিক যন্ত্রণা। শংকা বাড়ে ছেলে বুঝি তার নাগালের বাইরে চলে যায়। এ সম্পর্কে লেখক জানিয়েছেন : “ছেলের সঙ্গে এরকম মনাত্তর গোপালের বাৎসল্যের জগতে মন্বন্তরের সমান, বড়ো কষ্ট হয়, দিন যায় কলহ মেটে না, গোপাল উসখুস করে, ছেলে যেন আকাশের দেবতা হইয়া উঠিয়াছে।” গোপাল গাওদিয়ায় অত্যন্ত গরিব ঘরে জন্মগ্রহণ করে নিজের জোরে বড়োলোক হয়েছে। একদিন যে কুড়ে ঘরে গোপালের জন্ম হয়েছিল, আজ সেখানে পাকা দালান। সেই গোপালের জীবনে একি বিড়ম্বনা ? পিতাপুত্রের মূল লড়াই শুরু হয় মূলত দুটি সামাজিকতার ভিন্ন বোধের পরিপ্রেক্ষিতে। শশী গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যেতে চায়। গোপাল বাধা দেয়, “ডাক্তারিতে পয়সা না এলেও তোর চলবে। জমিজমা দেখবে। সুদ গুনে নেবে।” এই হল গোপালের মনস্তত্ত্ব। শশী ঠিক এটা মেনে নিতে পারেনা। যাদব তার যথাসর্বস্ব গ্রামে হাসপাতাল করবার জন্য নিশ্চিন্ত হয়ে শশীর হাতে তুলে দিয়ে গেছে। গোপাল এই অর্থ ব্যায়ের ব্যাপারে নাক গলিয়েছে। কারণ এখান থেকে সে কিছু অর্থ উপার্জনের উপায় খোঁজে। শশী যখন হাসপাতালের কোনো কাজে তাকে যুক্ত না করে তখন সে ভেঙে পড়ে। উভয়ের মধ্যে বেড়ে যায় আরও তিক্ততা। গোপাল রাগের বশেই ক্ষোভ মেটাতে বলে ফেলে : “জানিস শশী, অনেক পাপে ভগবান আমাকে তোর মতো ছেলে দিয়েছে।” গোপাল হাসপাতালের জন্য পাঁচশো টাকা দিতে চাইলে শশী নেয় না, তখন অর্থপিশাচ গোপাল সে টাকা ফিরিয়ে নেয়।
মূলত গোপাল এক বস্তুনিষ্ঠ চরিত্র। মানুষের লোভ-লোলুপতার প্রতীকি সত্তা তার মধ্যে বিরাজমান। সেনদিদির সঙ্গে তার গোপন সম্পর্ক অস্বীকার করার নয়। সেনদিদিকে বাঁচানোর জন্য সে পুত্রের কাছে অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করেছে, সেনদিদিকে চলে যেতেই হল। অনেক বয়সে প্রথম সন্তান হওয়ার সৌভাগ্য সেনদিদির জীবনে বিপজ্জনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। এদিকে অমূল্যকে বসিয়ে শশী গ্রাম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলে, গোপাল তা মেনে নিতে পারে না। গোপাল ছেলেকে আটকাতে নিজেই গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়। এছাড়া যে গোপালের আর অন্য উপায় ছিল না, এ ঘটনা একদিকে যেমন করুণ, মর্মান্তিক এবং নাটকীয়, অন্যদিকে তেমনি একার্থে স্বাভাবিক, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সে পথ প্রস্তুত করেছিল। উপন্যাসের প্রাক্-সমাপ্তি অংশের বর্ণনা থেকে গোপাল চরিত্রের স্বরূপ সত্তা ও অভিপ্রায় অভিলাষ সম্পর্কে স্পষ্ট ধ্যানধারণা লাভ করা সম্ভবপর। এখানে শিল্পীর উপস্থাপনা “চিরকাল সংসারের হাঙ্গামা নিয়ে হয়রান হয়ে এলাম, এখন তোরাও বড়ো হয়েছিস। মনটন ব্যাকুল হলে সাতটা দিনের ছুটিও পাব না ? এতটুকু আশাও তোদের কাছে আমার করা চলবে না ? গোপালকে শশী প্রণাম করিল। সকালবেলায় স্বচ্ছ আলোয় দুজনের মনে হইল না পিতাপুত্রের কোনোদিন কোনো সামান্য বিষয়েও মতান্তর ছিল, জীবনের গতি দুজনের বিপরীতমুখী।”
সর্বোপরি বলতে হয়, গোপাল চিরদিনের মতো চলে গেল, সংসারে আর ফিরল না। সংসারী গৃহস্থ মানুষ ছিল যে, সমস্ত জীবন ধরে সিন্দুকভরা, সোনা-রুপা, কতকগুলি মানুষের সঙ্গে পারিবারিক, কতকগুলি মানুষের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক দায়িত্ব, বাধ্যবাধকতা প্রভৃতি যত কিছু অর্জন করেছিল সব দিয়ে গেল শশীকে, মরে গেলে যেমন দিয়ে যায়। শুধু যাওয়ার সময় সে সেনদিদির মা মরা ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে গেছে। গোপালের এই কীর্তিকলাপে মুগ্ধ বিবশ চিত্তে সমালোচক নিতাই বসু জানিয়েছেন— “স্থূল ভোগ সর্বস্ব কুটীল ও সংকীর্ণচেতা গোপালের পুত্রের সঙ্গে মানসিক দ্বন্দ্ব এবং তজ্জনিত বিচ্ছিন্নতা, বাৎসল্য ও বিরোধ, তার প্রতি আকুল আগ্রহে অথচ অবিচ্ছিন্ন সংঘাত এবং শেষপর্যন্ত গুরু দর্শনের অছিলায় সর্বস্ত ত্যাগ করে কাশীধামে গমন গোপালকে রীতিমতো রহস্যময় করে তুলেছে এবং এই রহস্যময়তা সেনদিদির নবজাতক পুত্রকে নিয়ে যাওয়ায় আরও ইঙ্গিতবহ হয়ে দাঁড়ায়।”
তাইতো রূপদক্ষ শিল্পী মানিকের অমর লেখনীর স্পর্শে আলোচ্য উপন্যাসের গোপাল চরিত্রটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও বাস্তবসম্মতভাবেই রূপায়িত হয়েছে।
Leave a comment