অথবা, কী কী কারণে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছে।
ভূমিকাঃ পুঁজিবাদ সমাজ বিকাশের একটি উচ্চতর পর্যায়। বিশেষভাবে পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকার আধুনিক সমাজ কাঠামোর সাথে এ প্রত্যয়টি গভীরভাবে জড়িত। বিগত শতাব্দী থেকে চলমান শতাব্দী জুড়ে এ শব্দটি সর্বাধিক আলোচিত শব্দগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এ প্রত্যয়টি সমাজতাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রনৈতিক, দার্শনিক বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। একটি সমাজতাত্ত্বিক মতবাদ হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত।
পুঁজিবাদ বিকাশের প্রধান কারণঃ পুঁজিবাদের উৎপত্তি ও বিকাশের বহুবিধ কারণ রয়েছে। যথাঃ
(১) ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারঃ ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার পুঁজি সঞ্চয়ে প্রথম ও প্রধান ভূমিকা পালন করে। এ কারণেই ইতিহাসে সর্বপ্রথম বাণিজ্যে ধনতন্ত্রের উদ্ভব হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং পুঁজি গঠন পুঁজিবাদ বিকাশে সাহায্য করে।
(২) ভৌগোলিক আবিষ্কার ও উপনিবেশ স্থাপনঃ ভৌগোলিক পথ আবিষ্কার ও উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে একটি দেশ যখন অন্য দেশে তাদের সম্পদ, অর্থের সরবরাহ করতে থাকে তখন বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত হয়। আর এ কারণেই ১৮ শতকের শেষে এবং উনিশ শতকের প্রথমে পুঁজিবাদের বিকাশ হতে দেখা যায়।
(৩) কৃষি ও শিল্প বিপ্লবঃ কৃষি এবং শিল্প বিপ্লবের কারণে আধুনিক স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। উৎপাদন পদ্ধতির ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণের ফলে পুঁজি বৃদ্ধির মাত্রা অগ্রসর হয়েছে। যা পুঁজিবাদ বিকাশে সহায়তা করছে।
(৪) মুদ্রা অর্থনীতি চালুঃ মুদ্রা অর্থনীতির প্রচলনের সাথে সাথে পুঁজিবাদে নতুন মাত্রা এসেছে। অতীতে পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে পণ্যদ্রব্য ব্যবহার হলেও যখন থেকে মুদ্রা চালু হয় তখন তা আদান প্রদানে সহায়ক হয়। আর এটি পুঁজির সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন মাত্রা এনে দেয়।
(৫) উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ পুঁজিবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষভাবে কাজ করে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলগাড়ির প্রচলন এবং স্টিমার আবিষ্কারের ফলে জলপথ ও স্থলপথে যোগাযোগ সহজ হয়। যা পণ্য পরিবহন ও বাজার সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখে। আর এটি পুঁজিবাদের ক্ষেত্রটিকে প্রশস্ত করে।
(৬) অবাধ প্রতিযোগিতাঃ পুঁজিবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কেননা অবাধ প্রতিযোগিতায় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ কম থাকে এবং পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কখনই মানুষের অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে না। আর এ কারণে অবাধ প্রতিযোগিতা পুঁজি গঠনে বিশেষ সহায়ক।
(৭) ব্যক্তিমালিকানার উপস্থিতিঃ পুঁজিবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানা বিশেষ সহায়ক। কেননা ব্যক্তি মালিকানার কারণে ব্যক্তির মধ্যে ধনসম্পত্তি; ব্যবসায়ে বিনিয়োগ এবং উৎপাদন বৃদ্ধির প্রবণতা থাকে। আর এ কারণে এটি পুঁজিবাদের বিকাশে প্রভাব রাখে।
(৮) বণিক শ্রেণীর পুঁজি সঞ্চয়ঃ সাধারণত সমাজে যারা বণিক শ্রেণি তারা বাজার ব্যবস্থায় সর্বাধিক মুনাফা অর্জনের জন্য বড় আকারের বিনিয়োগ করে। তারা এমনভাবে উৎপাদন করে যেখান থেকে বেশি মুনাফা অর্জিত হয়। মূলত তাদের হাতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও পুঁজির ব্যবহার হয় বলে তারা পুঁজি সঞ্চয়ে আগ্রহী থাকে।
(৯) ঔপনিবেশিক ধারাঃ পৃথিবীর শিল্পোপন্নত এবং প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ দেশগুলো পূর্ব থেকে উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে তাদের বাজার ব্যবস্থাকে চালু রাখে। এসব দেশসমূহ অনুন্নত দেশসমূহ হতে কাঁচামাল সংগ্রহ করার সুযোগ পায়। আর এ কারণে তারা বিভিন্ন পন্থায় বিশ্বব্যাপী বাজার সৃষ্টি করে পুঁজিবাদের ক্ষেত্রটিকে পাকাপোক্ত করে।
(১০) যান্ত্রিক কলাকৌশলের উদ্ভবঃ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং যান্ত্রিক কলাকৌশলের উদ্ভাবনের ফলে উৎপাদন ক্ষেত্রে এসেছে পরিবর্তন। আর এ কারণে পণ্যের সরবরাহ এবং যোগান বিশ্বব্যাপী একটি চলমান প্রক্রিয়া। আবার পণ্য সামগ্রীর বাজারজাতকরণ ও মুনাফা অর্জনে যান্ত্রিক কৌশল বিশেষভাবে কাজ করে।
(১১) বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভবঃ শিল্পোত্তর বিভিন্ন সমাজে কলকারখানা বৃদ্ধি এবং ব্যক্তিগত সম্পদের মালিকানার প্রসারের কারণে সমাজে বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছে। এই বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের অর্জিত সম্পদ ব্যবসা বাণিজ্য ও উৎপাদনে বিনিয়োগ করে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটায়।
(১২) শহর ও নগরের উদ্ভবঃ শিল্প সমাজের একটি মূল বৈশিষ্ট্য হলো এটি শহরকেন্দ্রিক। আর এ শহরকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে বেশিরভাগ শিল্প কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল নগর ও শহরে গড়ে ওঠে। এর মূল কারণ হলো সম্প্রসারিত ব্যবসায়িক সুবিধা। এভাবে নতুন নতুন শহর ও নগরের পত্তন পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে সম্প্রসারিত করেছে।
(১৩) সামন্ততন্ত্রের ধারা ও পুঁজিবাদ বিকাশঃ সামন্তপ্রথার ইতিহাস কৃষক ও সামন্তপ্রভুর মধ্যকার শ্রেণিদ্বন্দ্বের ইতিহাস। যেখানে কৃষক শ্রেণির মত বুজোয়ারা সামন্তবিরোধী সংগ্রামে সমর্থন জোগায়। সামন্তপ্রভুদের নিকট থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে, শাসক শ্রেণির ক্ষমতা ছিনিয়ে তারা শাসক শ্রেণির ক্ষমতা দখল করে। যা পুঁজিবাদের বিকাশে সহায়ক।
(১৪) রেনেসাঁর অবদানঃ পুঁজিবাদ বিকাশের পেছনে রেনেসার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। রেনেসাঁর ফলে মানুষের চিন্তা এবং মননশীলতায় পরিবর্তন আসে। ফলে মানুষ সংকীর্ণতা পরিহার করে নিজের উন্নতির জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে পুঁজিবাদের বিকাশ সহজতর হয়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, উল্লেখিত কারণগুলো পুঁজিবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক ছিল। বর্তমান সমাজে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলো এমনভাবে তৈরি হয়েছে যেখানে পুঁজির বিনিয়োগ অবশ্যম্ভাবী। আর প্রতিযোগিতা এবং উন্মুক্ত বিশ্ব ব্যবস্থায় পুঁজিবাদের সম্প্রসারণের রূপটি চলমান।
Leave a comment