পুঁজিবাদের পতন অনিবার্য
‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’ (Manifesto of the Communist Party) শীর্ষক রচনায় কার্ল মার্কস ও ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস মন্তব্য করেছেন: ‘বুর্জোয়ার পতন ও প্রলেতারিয়েতের জয়লাভ, দুই-ই সমানভাবে অনিবার্য” (“Its fall and the victory of the proletariat are equally inevitable.”)। ‘পুঁজি’ (Capital) শীর্ষক গ্রন্থে কার্ল মার্কস মন্তব্য করেছেন যে, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার ভিতরেই স্ববিরোধ বা দ্বন্দ্ব বর্তমান থাকে। এই স্ববিরোধিতার কারণে পুঁজিবাদের মধ্যে সংকটের সৃষ্টি হয়। এই সংকট থেকে নিষ্কৃতি লাভের উদ্দেশ্যে পুঁজিপতিরা যে পথে এগোয় তাতে সংকট প্রকট হয়ে পড়ে। সমগ্র পুঁজিবাদী সমাজ সংকটের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়। পুঁজিবাদের অবসান ঘটে। বস্তুত পুঁজিবাদ কোন শাশ্বত বা চিরন্তন ব্যবস্থা নয়। সামাজিক প্রক্রিয়ার সাধারণ নিয়মে পুঁজিবাদের পতন অনিবার্য।
পুঁজিবাদের ভিতরকার ও বাহ্যিক বিরোধ
পুঁজিবাদের পতনের পিছনে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিতরকার ও বাহ্যিক স্ববিরোধ বর্তমান থাকে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাধারণ সংকটের মাধ্যমে তার আভ্যন্তরীণ বিরোধ প্রতীয়মান হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাধারণ সংকট হল একটি বিশেষ পর্যায়। এই পর্যায়ে পুঁজিবাদ নিতান্তই দুর্বল হয়ে পড়ে। পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের মাধ্যমে পুঁজিবাদী সমাজের অসমবিকাশের অসঙ্গতি অনুধাবন করা যায়। পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের মধ্যে রাজনীতিক তথা মতাদর্শগত বিরোধী এবং উৎপাদন পদ্ধতির বিরোধও পড়ে। তবে শুধুমাত্র আর্থনীতিক সংকটই পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের অন্তর্ভুক্ত নয়। পুঁজিবাদী সমাজের সংকটও এর অন্তর্ভুক্ত। পুঁজিবাদের পতনের বাহ্যিক কারণ বলতে বোঝায় ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদী শক্তির সঙ্গে পরাধীন উপনিবেশগুলির শোষিত ও স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীর বিরোধ এবং ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদী শক্তিগুলির নিজেদের মধ্যে বিরোধ।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আভ্যন্তরীণ স্ববিরোধ
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই বৈপরীত্য বা স্ববিরোধ বর্তমান। প্রথমেই আভ্যন্তরীণ স্ববিরোধ সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক। তারপর রাজনীতিক ও মতাদর্শগত এবং বাহ্যিক বিরোধ ও সংকট সম্পর্কে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদের পতনের অনিবার্যতা আলোচনা করা যাবে। পুঁজি হল পুঁজিবাদের প্রাণ। পুঁজিবাদের বিকাশের জন্য পুঁজির সঞ্চয় বৃদ্ধি দরকার। এই কারণে পুঁজির সঞ্চয় বৃদ্ধি ও পুঁজির একত্রীকরণের উদ্যোগ-আয়োজন চলতে থাকে। এই প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যেই মূলত তিনটি ক্ষেত্রে মৌলিক স্ববিরোধের সৃষ্টি হতে দেখা যায়। এই স্ববিরোধের ক্ষেত্রগুলি হল:
-
(ক) পুঁজির সঞ্চয় বৃদ্ধি ও মুনাফার হারে হ্রাস,
-
(খ) উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি ও জনগণের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস এবং
-
(গ) উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ।
(ক) পুঁজির সঞ্চয় বৃদ্ধি এবং গড় মুনাফা হ্রাসের স্ববিরোধ:
পুঁজিবাদের বিকাশের জন্য পুঁজির সঞ্চয় বৃদ্ধি আবশ্যক। কারণ মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধি ব্যতিরেকে পুঁজিবাদের শ্রীবৃদ্ধি অসম্ভব। আবার পুঁজির সঞ্চয় বৃদ্ধি করতে না পারলে মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায় না। সুতরাং পুঁজিবাদের বিকাশের স্বার্থে মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য পুঁজির সঞ্চয় বৃদ্ধি করা দরকার। কিন্তু পুঁজির সঞ্চয় বৃদ্ধি পেলে মুনাফার হার হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। বিষয়টি ব্যাখ্যা করা দরকার। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় অবাধ প্রতিযোগিতার অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়। পুঁজিবাদী উৎপাদকরা তাদের উৎপন্ন দ্রব্যের জন্য চাহিদা সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতার সামিল হয়। এই প্রতিযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিযোগী উৎপাদকরা সাধারণভাবে কতকগুলি ব্যবস্থা অবলম্বন করে। এই সমস্ত ব্যবস্থাদির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগ, উন্নততর স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতির ব্যাপক ব্যবহার, সামগ্রিকভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়ার মানোন্নয়ন প্রভৃতি। এই সমস্ত ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য উৎপাদকদের মুনাফার হার বৃদ্ধি করা। এই সমস্ত উদ্যোগ আয়োজনের ফলে পুঁজিবাদী উৎপাদকদের মধ্যে কেউ কেউ সাময়িকভাবে তাদের মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধিতে সক্ষম হয়। তখন এই প্রতিযোগিতার অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য পুঁজিবাদী উৎপাদকরাও একই পথে অধিক মুনাফা অর্জনের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। তারফলে পুঁজিবাদী উৎপাদকদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা প্রবল ও প্রকট হয়ে পড়ে। এই তীব্রতর পারস্পরিক প্রতিযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদী উৎপাদকরা বাধ্য হয়ে উৎপাদন ব্যয়েই তাদের পণ্য বিক্রয় করে। তারফলে মুনাফা বৃদ্ধির পরিবর্তে গড় মুনাফা হ্রাস পায়। সুতরাং ক্রমাগত পুঁজির সঞ্চয় বৃদ্ধির চূড়ান্ত ফল হিসাবে গড় মুনাফা হ্রাসের পরিণতিকে এড়ান যায়। এইভাবে পুঁজিপতিরা নিজেদের কৃতকর্মের জালে জড়িয়ে পড়ে। পুঁজিপতিরা তাদের মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য ক্রমান্বয়ে পুঁজির সঞ্চয় বাড়িয়ে চলে; কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে পুঁজিপতিদের এই উদ্যোগ গড় মুনাফা হ্রাসের পরিণতি থেকে নিষ্কৃতি পায় না। এই স্ববিরোধিতা থেকে নিষ্কৃতি লাভের পথ পুঁজিপতিরা খুঁজে পায় না।
(খ) উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং জনগণের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাসের স্ববিরোধ:
পুঁজিপতি শ্রেণীর অস্তিত্ব রক্ষা এবং আধিপত্য বিস্তারের মূল শর্ত হল পুঁজির সৃষ্টি ও বৃদ্ধি। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে মার্কস-এঙ্গেলস বলেছেন: “The essential condition for the existence, and for the way of the bourgeois class, is the formation and augmentation of capital;….” মার্কসের মতানুসারে পুঁজির সঞ্চয় বৃদ্ধি পেলে সর্বহারা শ্রেণীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। পুঁজির সঞ্চয় যত বৃদ্ধি পেতে থাকে, উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিক নিয়োগের সংখ্যার উপর ততই তার প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। মার্কসের এই বক্তব্যটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার। পুঁজির সঞ্চয় বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন ব্যবস্থায় অধিক পরিমাণে পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়। এই বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলে অত্যাধুনিক ও উন্নততর যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। এই সমস্ত যন্ত্রপাতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বয়ংক্রিয়। উৎপাদন পদ্ধতির প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জটিলতর শ্রমবিভাগ প্রবর্তন করা হয়। এই সবের সামগ্রিক ফল হিসাবে শ্রমিকদের উৎপাদন ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। শুধু তাই নয়। প্রত্যেক শ্রমিকের উপর শ্রমের তীব্রতাও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এই সমস্ত কিছুর সামগ্রিক ফল হিসাবে প্রতিটি শ্রমিকের বা শ্রমিক পিছু উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং সঙ্গে সঙ্গে মোট উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু শ্রমিক নিয়োগের সংখ্যার উপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। শ্রমিক পিছু উৎপাদন এবং মোট উৎপাদন বৃদ্ধি সত্ত্বেও শ্রমিকের নিয়োগের সংখ্যা আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায় না। ‘শ্রমিকের একটি অংশকে মাত্রাতিরিক্তভাবে পরিশ্রম করিয়ে নেওয়া হয় এবং অপরাংশের উপর আলস্যের অভিশাপ জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়। এই অবস্থায় কর্মরত শ্রমিকদের গড় প্রকৃত মজুরি হ্রাস পায়। কোন নতুন শ্রমিককে কাজে নেওয়া হয় না। কর্মরত শ্রমিকদেরও বেশ কিছুকে বসিয়ে দেওয়া হয়। তারা বেকার হয়ে পড়ে। কালক্রমে বেকার শ্রমিকের মজুদ-বাহিনীর সৃষ্টি হয়। এই বাহিনী বাড়তে থাকে। এই সমস্ত কিছুর সাধারণ ফল হিসাবে সমগ্র সমাজের মোট ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। এবং ক্রয় ক্ষমতার এই নিম্নগতি উল্লেখযোগ্যভাবে ঘটে। অথচ উৎপাদন পদ্ধতির প্রভূত উন্নতি ঘটায় মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে অতিমাত্রায়। এই অবস্থায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এক অভিনব সংকটের সৃষ্টি হয়। এ হল অতি উৎপাদনের সংকট। পুঁজিবাদী উৎপাদকদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রবলভাবে বর্তমান থাকে। তাই তারা তাদের উৎপাদিত মোট পণ্যসামগ্রীকে মুনাফাসহ বিক্রী করতে ব্যর্থ হয়। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে ব্যক্ত মার্কস-এঙ্গেলসের অভিমত অনুসারে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় এই উৎপাদন-সংকট পালা করে ফিরে ফিরে আসে। এবং প্রতিবারই আরও বেশী করে সমগ্র পুঁজিবাদী সমাজের অস্তিত্বটাকেই বিপন্ন করে তোলে। এর উল্লেখই যথেষ্ট। এই সমস্ত সংকটে উপস্থিত উৎপন্নের অনেকখানি ত’ নষ্ট হয়ে যায়ই, তা ছাড়া আগেকার সৃষ্ট উৎপাদনশক্তির অনেকটাও পর্যায়ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায়। এই সমস্ত সংকটের ফলে এক বিশেষ মহামারি হাজির হয়। আগেকার সকল যুগে একে অসম্ভব মনে করা হত। এ হল অতি উৎপাদনের মহামারি। মার্কস ও এঙ্গেলস বলেছেন: “It is enough to mention the commercial crises that by their periodical return put on its trial, each time more threateningly, the existence of the entire bourgeois society. In these crises a great part not only of the existing products, but also of the previously created productive forces, are periodically destroyed. In these crises there breaks out on epidemic that, in all earlier epochs, would have seemed an absurdity – the epidemic of overproduction.”
অতি-উৎপাদনের সংকট: পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় অতিরিক্ত উৎপাদনের ফল স্বরূপ নতুন উৎপাদন বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং হ্রাস পায়। তারফলে শ্রমিক ছাঁটাই ও বেকারত্বের সৃষ্টি হয়। এবং এই সবকিছুর ফলে ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায় ও বাজারের চাহিদার অবনতি ঘটে। তখন আর এক দফা এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া গড়ে উৎপাদন ব্যবস্থার উপর। আরও অধিক সংখ্যক কারখানা তাদের উৎপাদনের গতি কমিয়ে আনে। বিদ্যমান কারখানাগুলির বেশ কিছু বন্ধ হয়ে যায়। নতুন করে আর কোন কারখানা গড়ে উঠে না। তখন আরও শ্রমিক বেকার হয়। অর্থাৎ বেকার শ্রমিকের সংখ্যা আবার বৃদ্ধি পায়। এইভাবে অতি উৎপাদনের সংকটের জালে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বার বার জড়িয়ে পড়ে। পুঁজিবাদের বিকাশের ধারায় পুঁজির সঞ্চয় ক্রমাগত বাড়তে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনও বাড়তে থাকে। কিন্তু মজুরি বাড়ে না, কমে। বেকার শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ে। জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতা কমে। এবং তার ফলে উৎপন্ন পণ্যের চাহিদা কমে। বেশী কিছু ক্ষয়-ক্ষতি সামলে নিয়ে পুঁজিপতিরা এই সংকট থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করে। তারা সাময়িকভাবে কিছুটা সফলও হয়। কিন্তু অচিরেই নতুন ও বৃহত্তর সংকটে নিমজ্জিত হয় এবং হাবুডুবু খায়। প্রকৃত প্রস্তাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকটের অন্যতম মূল কারণ হল পুঁজির সঞ্চয় বৃদ্ধি এবং শ্রমিকের চাহিদার আপেক্ষিক মন্দার মধ্যে অসামঞ্জস্য।
পুঁজির সঙ্গে শ্রমের বিরোধ: উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয় যে পুঁজি ও শ্রমের মধ্যে বিরোধ বর্তমান। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মালিক শ্রেণী উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাতের মাধ্যমে শ্রমিক শোষণ কায়েম করে এবং পুঁজির সৃষ্টি ও সঞ্চয় করে। শ্রমিক শোষণ যত বৃদ্ধি পায় উদ্বৃত্ত মূল্য তথা পুঁজিপতির মুনাফা ও পুঁজির পরিমাণ তত বৃদ্ধি পায়। এবং পুঁজির পরিমাণ যত বৃদ্ধি পায় পুঁজিপতি ততই তার উৎপাদন বৃদ্ধিতে উদ্যোগী হয়। উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পুঁজিপতি শ্রেণী শ্রমিকের পরিবর্তে অত্যাধুনিক উন্নততর স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি প্রচলন করে। তা ছাড়া প্রতিটি শ্রমিকের উপর শ্রমের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থায় কোনও নতুন শ্রমিক কাজ পায় না এবং কর্মরত বহু শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে অধিক শ্রম বিক্রয় করতে শ্রমিকদের কার্যত বাধ্য করা হয়। উন্নততর স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতির প্রচলন অসংখ্য শ্রমিককে বেকারত্বের অভিশাপে নিমজ্জিত করে। বেকার শ্রমিকের মজুত বাহিনী ক্রমশ বাড়তে থাকে। কার্ল মার্কস যথার্থই বলেছেন, “পুঁজির সঞ্চয় বৃদ্ধির অর্থ হল, সর্বহারা শ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি।” প্রকৃত প্রস্তাবে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় যে নৈরাজ্য দেখা দেয় তারফলে অসংখ্য মানুষ সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েতে পরিণত হয়। এই সর্বহারা শ্রেণী শ্রেণী-সংগ্রামের মাধ্যমে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামের সামিল হয়। এইভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিপ্লবের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে নিজের ধ্বংসের পথকে প্রশস্ত করে।
(গ) উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ:
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদন-সম্পর্কের বিরোধ দেখা দেয়। এই বিরোধকে পুঁজিবাদের সংকটের আর্থনীতিক কারণ হিসাবে গণ্য করা হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যে উৎপাদন সম্পর্ক বর্তমান থাকে তা সমকালীন উৎপাদন শক্তির বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়ক। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরী জ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি ও বিকাশ সাধিত হয়। এই উৎপাদন শক্তির বিকাশ ঘটে দ্রুত গতিতে এবং ব্যাপকভাবে। উৎপাদন শক্তির এই বিকাশ পুঁজিবাদের অবসানকে আহ্বান জানায়। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে বক্তা মার্কস-এঙ্গেলসের অভিমত অনুসার ‘আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ নিজের উৎপাদন ব্যবস্থা, বিনিময় ব্যবস্থা ও সম্পত্তি-সম্পর্ক নিয়ে এক বিশেষ সমাজ গড়ে তুলেছে। এই সমাজ যাদুকরের মত উৎপাদন ও বিনিময়ের এক বিশাল উপায় গড়ে তুলেছে। অথচ নিজের যাদুমন্ত্রে পাতালপুরির শক্তিসমূহকে সঞ্জীবিত করে যাদুকর সেগুলিকে এখন আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।’ মার্কস-এঙ্গেলস বলেছে: “Modern bourgeois society with its relations of production, of exchange and of property, a society that has conjured up such gigantic means of production and of exchange, is like the sorcerer, who is no longer able of control the powers of the nether world whom he has called up by his spells.” উৎপাদন শক্তির ব্যাপক বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদ এক দ্বন্দ্বের আবর্তে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এই আবর্ত থেকে পুঁজিবাদের উদ্ধার অসম্ভব হয়ে পড়ে। পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে উৎপাদন শক্তির বিকাশের পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। নতুন উৎপাদন শক্তির বিকাশ ও বিস্তারকে বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্ক প্রতিহত করতে উদ্যোগ হয়। বিকশিত উৎপাদন শক্তির পরিপূর্ণ বিকাশের পথে বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্ক নানা রকমের বাধা-বিপত্তি চাপানর চেষ্টা করে। এই অবস্থায় পুঁজিবাদী মালিকানা ও বিদ্যমান উৎপাদন-সম্পর্কের বিরুদ্ধে বিকশিত উৎপাদন শক্তির বিরোধ-বিদ্রোহ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
উৎপাদন-শক্তির সামাজিকীকরণ এবং ব্যক্তিগত মালিকানার মধ্যে বিরোধ: পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় ক্রমান্বয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কারখানায় বহুসংখ্যক শ্রমিকের একত্রে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যোগদানের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া জটিল শ্রমবিভাগের প্রয়োজনীয়তাকেও অস্বীকার করা যায় না। এই সবের ফলে উৎপাদন-শক্তি সামাজিক হতে থাকে। বিপুল পরিমাণ শ্রমকে সংঘবদ্ধ করার মাধ্যমে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উৎপাদনকে সামাজিক চরিত্রসম্পন্ন করে তোলে। পুঁজিবাদের বিকাশ এবং শ্রমের সামাজিকীকরণ ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। উৎপাদনের সামাজিকীকরণ সম্পাদিত হওয়া সত্ত্বেও উৎপাদনের উপায় ও উৎপাদিত পণ্যের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা অব্যাহত থাকে। শ্রমের সামাজিকীকরণ এবং উৎপাদনের উপকরণের কেন্দ্রীভবন এক অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি করে। একদিকে উৎপাদন শক্তির সামাজিক চরিত্র এবং অপরদিকে শ্রমের ফসলের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার অস্তিত্ব যে অবস্থার সৃষ্টি করে তার থেকে জন্ম নেয় এক আপসহীন স্ববিরোধিতার। উৎপাদন শক্তি সামাজিক চরিত্র সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও, পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের কোন পরিবর্তন ঘটে না। এই অবস্থায় পুঁজিপতি মালিক শ্রেণী এবং শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে আপসহীন বিরোধের সৃষ্টি হয়। এবং এই বিরোধ ক্রমশ তীব্রতর হয়। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে ব্যক্ত মার্কস-এঙ্গেলসের অভিমত অনুসারে, ‘যে অস্ত্রে বুর্জোয়া শ্রেণী সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়েছিল। সেই অস্ত্রই আজ তাদের বিরুদ্ধে উদ্যত। যে অস্ত্রে তাদের মৃত্যু বুর্জোয়া শ্রেণী শুধু সেই অস্ত্রটুকুই গড়েনি; এমন লোকও তারা সৃষ্টি করেছে যারা সে অস্ত্র ধারণ করবে, সৃষ্টি করেছে আধুনিক শ্রমিকশ্রেণীকে, প্রলেতারিয়েতকে।’ মার্কস-এঙ্গেলস বলেছেন: “The weapons with which the bourgeoisie felled feudalism to the ground are now turned against the bourgeoisie itself. But now not only has the bourgeoisie forged the weapons that bring death to itself, it has also called into existence the men who are to wield those weapons- the modern working class the proletarians.”
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বাহ্যিক সংকট: পুঁজিবাদের বিকাশের বৈশিষ্ট্যই হল অ-সম বিকাশ। পুঁজিবাদী সকল দেশের পুঁজিই সামগ্রিক বিচারে এই নিয়মের অধীন। বিভিন্ন দেশের অর্থ পুঁজির (Finance Capital) মালিক গোষ্ঠীগুলি নিজেদের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। এই উদ্দেশ্যে তারা অস্ত্রসজ্জা ও যুদ্ধের সামিল হয়। পণ্য উৎপাদনের প্রয়োজনে সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহ এবং উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ পণ্যের জন্য নতুন নতুন বাজার সৃষ্টির জন্য পুঁজিপতিরা সাম্রাজ্যবাদী পদে পৃথিবীর বিভিন্ন অনগ্রসর অঞ্চল ও দেশে উপনিবেশ স্থাপনে উদ্যোগী হয়। এইভাবে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী স্তরে উপনীত হয়। তারা উপনিবেশের সম্পদ-সামগ্রী ও অধিবাসীদের শোষণ করতে থাকে। এই ঔপনিবেশিক শাসন শোষণ দীর্ঘকাল অব্যাহতভাবে চলতে পারে না। শোষণের দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভের জন্য উপনিবেশগুলির শোষিত মানবগোষ্ঠী সংগ্রামের সামিল হয়। এইভাবে ঔপনিবেশিকতাবাদ-বিরোধী বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী মুক্তি আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। এই কারণে পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী স্তর কেবলমাত্র যুদ্ধেরই যুগ নয়, এ হল বিপ্লবেরও যুগ। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে এ রকম অসংখ্য সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের কাহিনী পরিলক্ষিত হয়। এই সমস্ত বিদ্রোহ বিপ্লবের ফলে পুঁজিবাদী ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি বিপন্ন বোধ করে। তাদের অবসান অনিবার্য হয়ে পড়ে। পুঁজিবাদের বাহ্যিক সংকটের আর একটি দিক আছে। এ হল সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির নিজেদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ। পুঁজির রপ্তানি ও বিনিয়োগ, উপনিবেশগুলি থেকে সস্তায় কাঁচামাল আমদানি, উৎপাদিত পণ্যের বিপুল সম্ভারের জন্য বাজার দখল প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতার সামিল হয়। এইভাবে এই সমস্ত পুঁজিবাদী শক্তিগুলির মধে সংঘাত-সংঘর্ষ এবং পরিণতিতে পুঁজিবাদের অবসান অনিবার্য হয়ে পড়ে। লেনিনের অভিমত অনুসারে সাম্রাজ্যবাদী স্তরে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একদিকে তীব্র আর্থনীতিক সংকট ও বিশ্বযুদ্ধের সৃষ্টি হয়। এবং অপরদিকে দেখা দেয় মেহনতী মানুষের বিপ্লব ও সাম্রাজ্যবাদী শাসন শোষণের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশের অধিবাসীদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।
পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংঘাত: মেহনতী মানুষের মতাদর্শগত সংগ্রামেও পুঁজিবাদের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে সংকটের সৃষ্টি করে। পুঁজিবাদী মতাদর্শে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা, বৈষম্যের বৈধতা, রাজনীতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও সমানাধিকার, জাতিগত প্রভুত্বের তত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ের কথা বলা হয়। কিন্তু কালক্রমে বাস্তব অবস্থার সঙ্গে এই সমস্ত ধ্যান-ধারণার অ-সামঞ্জস্য স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়। পুঁজিবাদী মতাদর্শের অসারতা অনুধাবন করতে শ্রমজীবী জনতার অসুবিধা হয় না। পুঁজিবাদী মতাদর্শের চরম প্রতিক্রিয়াশীল প্রকৃতি মেহনতী মানুষ হাড়েহাড়ে উপলব্ধি করে। পুঁজিবাদী মতাদর্শের প্রধান শত্রু হল সাম্যবাদী মতাদর্শ। এই সাম্যবাদী মতাদর্শই হল শ্রমিক শ্রেণীর মতাদর্শ। সাম্যবাদী মতাদর্শকে হাতিয়ার করে শ্রমিক-শ্ৰেণী পুঁজিপতি শ্রেণীর বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালিত করে। এই মতাদর্শগত বিরোধিতার ফলে পুঁজিবাদের সংকট প্রকট হয়ে পড়ে। এই সংকট কাটিয়ে উঠা পুঁজিবাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রাজনীতিক সংকট: পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যে সমস্ত সংকটের সম্মুখীন হয় তার প্রভাব পড়ে রাজনীতিক ক্ষেত্রেও। বিকশিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একচেটিয়া পুঁজিপতিদের কুক্ষিগত হয়। এ হল রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া পুঁজিবাদ। নিজেদের স্বার্থে একচেটিয়া পুঁজিপতিরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কাজে লাগায়। পুঁজিবাদের সাধারণ সংকট নিবারণের স্বার্থে এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আড়ালে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র পুঁজিবাদের সাধারণ সংকট নিবারণের জন্য হিংসাত্মক ও বলপ্রয়োগমূলক প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন নানারকম উপায় পদ্ধতি অবলম্বন করে। এতদ্সত্ত্বেও মুমূর্ষু পুঁজিবাদের শেষ রক্ষা হয় না। পুঁজিবাদের অবসান অনিবার্য হয়ে পড়ে।
Leave a comment