পুঁজিবাদের সংজ্ঞা

পুঁজিবাদ হল এক বিশেষ সমাজব্যবস্থা। এই সমাজব্যবস্থা চিরন্তন বা শাশ্বত নয়। এই সমাজব্যবস্থা বিকাশ লাভ করে বা গড়ে উঠে। এই সমাজব্যবস্থার গড়ে উঠার ভিত্তি হল পুঁজিপতিদের দ্বারা মজুরি শ্রমিক (wagelabour)-এর শোষণ। পুঁজিবাদের ধারণা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মহামতি লেনিন কর্তৃক প্রদত্ত সংজ্ঞাই সর্বাধিক প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “Capitalism is the name given to that social system under which the land, factories, implements, etc. belong to a small number of landed proprietors and capitalists, while the mass of the people possesses no property, or very little property, and is compelled to hire itself out as workers.” fe পুঁজিবাদ বলতে এক বিশেষ সমাজব্যবস্থাকে বোঝায়। এই সমাজব্যবস্থায় জমিজমা, শিল্পকারখানা, যন্ত্রপাতি প্রভৃতির মালিকানা কুক্ষিগত থাকে মুষ্টিমেয় জমিজমার মালিক ও পুঁজিপতিদের হাতে। এবং জনসাধারণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের হাতে কোন সম্পদই থাকে না, বা নামমাত্র কিছু থাকে। এই জনগোষ্ঠী বাধ্য হয় মজুরি-শ্রমিক হিসাবে দিনপাত করতে। সুতরাং পুঁজিবাদ হল শোষণ এবং উৎপাদন শক্তির মালিকানার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এক বিশেষ ধরনের সমাজব্যবস্থা। শোষণ ব্যতিরেকে পুঁজিবাদের অস্তিত্ব অসম্ভব। মজুরি শ্রমিকদের শোষণ করে উৎপাদন শক্তির মালিকরা। পুঁজিবাদে যে শোষণের কথা বলা হয় তার সঙ্গে সংযুক্ত থাকে মজুরি-শ্রমিক ও উৎপাদন শক্তির মালিকানা। অর্থাৎ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একদিকে থাকতে হবে উৎপাদনের উপাদানসমূহের মালিক। এদের বলা হয় পুঁজিপতি। এরা সংখ্যায় মুষ্টিমেয়। আর এক দিকে থাকতে হবে জনগণের গরিষ্ঠ অংশ। এদের জীবিকার একমাত্র উপায় হল মজুরির বিনিময়ে পুঁজিপতিদের কাছে শ্রম বিক্রয় করা। এদের বলা হয় মজুরি-শ্রমিক।

একটি উৎপাদন পদ্ধতি: প্রকৃত প্রস্তাবে পুঁজিবাদ বলতে বিশেষ এক উৎপাদন পদ্ধতিকে বোঝায়। এই উৎপাদন পদ্ধতিতে পুঁজিই হল উৎপাদনের প্রধান উপায়। তবে এই পুঁজি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। শ্রম ক্ষমতা এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় উপকরণ যা দিয়ে ক্রয় করা যায় তাই পুঁজি হিসাবে পরিগণিত হয়। সুতরাং টাকাকড়ি, ধার দেওয়ার মত কোন সামগ্রী, যন্ত্রপাতি প্রভৃতি পুঁজি হিসাবে গণ্য হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজির ব্যক্তিগত মালিকানা ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর হাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ এই মালিকানা থেকে বঞ্চিত থাকে। এমিল বার্নসও একটি উৎপাদন প্রথা হিসাবে পুঁজিবাদের কথা বলেছেন। লেনিন পুঁজিবাদের দুটি মূল বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। এই দুটি বৈশিষ্ট্য হল শিল্পের ব্যাপক বিস্তার ও বৃহদাকারবিশিষ্ট সংস্থাসমূহের মধ্যে উৎপাদনের কেন্দ্রীভবন। পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতিতে পণ্য ও উদ্বৃত্ত মূল্যের সৃষ্টি হয়, অবিরাম পুঁজির সঞ্চয় ও সঞ্চালন ঘটে এবং পুঁজিবাদী সম্পর্ক স্থাপিত হয়। পুঁজিবাদী সম্পর্ক বলতে শ্রমিক শোষণ ও মুনাফা ভোগকে বোঝায়।

আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ও আন্দোলন: আবার পুঁজিবাদ একটি অর্থব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা হিসাবেও পরিগণিত হয়। মানবসভ্যতার ইতিহাসের একটি স্তরের আর্থনীতিক ও সামাজিক রূপ হল পুঁজিবাদ। অনেকের অভিমত অনুসারে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদন পদ্ধতি ও ভাবধারার ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এবং উভয় ক্ষেত্রেই একই সঙ্গে পরিবর্তন দেখা দেয়। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি হিসাবে অবাধ বাণিজ্য ব্যবস্থা, জাতীয় স্বাধীনতা, উদারনীতিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমানাধিকারের স্বীকৃতি, ব্যাপক গণ-অংশগ্রহণ প্রভৃতির কথা বলা হয়। অনেকে আবার পুঁজিবাদকে যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী।

বিভিন্ন পর্যায়: পুঁজিবাদের আবার বিভিন্ন পর্যায় আছে। পুঁজিবাদের এই সমস্ত পর্যায়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। উৎপাদনের সামাজিকীকরণের মান অনুযায়ী এই পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। তাই বলা হয় যে, পুঁজিবাদ বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এই পরিবর্তনের পরিপেক্ষিতে সাম্রাজ্যবাদ, একচেটিয়া পুঁজিবাদ, রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া পুঁজিবাদ প্রভৃতি পুঁজিবাদের বিভিন্ন রূপের কথা বলা হয়।

পুঁজিবাদের উদ্ভব ও বিকাশ

সামন্ততন্ত্রের ধ্বংসের ভিত্তিতে পুঁজিবাদের উদ্ভব:

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উদ্ভব হয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজের গর্ভেই। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংস করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটেছে। অর্থাৎ পুরাতন সামন্ত-সমাজের ধ্বংসস্তূপের উপর গড়ে উঠেছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ইমারত। আগেকার সামন্ত সমাজব্যবস্থার ব্যক্তিগত উৎপাদন থেকেই পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার উৎপত্তি হয়। বুর্জোয়া বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে সপ্তদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে। এবং মূলত পশ্চিম ইউরোপে এই বিপ্লব সংঘটিত হয়। এবং এই বিপ্লবের সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে সামন্ততন্ত্রের অবসান ও পুঁজিবাদের উত্তরণ সম্পাদিত হয়। সামত্ততন্ত্রের ধ্বংস সাধিত হওয়ায় তার জায়গায় পুঁজিবাদের আবির্ভাব ঘটেছে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন হত কুটির ও ক্ষুদ্রায়তন শিল্পের মাধ্যমে। এই উৎপাদন ব্যবস্থার ধ্বংস সাধিত হয় শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে। শিল্পায়নের ফলে সামন্ততান্ত্রিক আর্থনীতিক ব্যবস্থার অবসান ঘটে। আগেকার দরিদ্র কৃষক, ছোটখাট হস্তশিল্পীরা তাদের সাবেকী আর্থনীতিক উদ্যোগ থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। এবং তারা বৃহদায়তনবিশিষ্ট শিল্প-কারখানায় সামিল হয়। তারা জীবিকা নির্বাহের জন্য শ্রম বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। তারা মজুরি শ্রমিকে পরিণত হয়। এই মজুরি-শ্রমিকদের উৎপাদনের উপর নির্ভর করে উৎপাদন-উপাদানের মালিক হিসাবে মুষ্টিমেয় মানুষ বিপুল বৈভবের মালিক হয়। একে বলে পুঁজির পুঞ্জিভবন। তারফলে সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সম্পদ-সামগ্রী কেন্দ্রীভূত হয়। তারাই হয় যাবতীয় উৎপাদন শক্তির মালিক। এরাই হল পুঁজিপতি।

শক্তিশালী রাজতন্ত্রের বিরোধিতা:

মধ্যযুগে শক্তিশালী বৃহৎ রাষ্ট্র ও স্বাধীন রাজনীতিক কর্তৃত্ব যাতে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে সে ব্যাপারে সামন্ততন্ত্র ও ক্যাথলিক চার্চ সক্রিয় ছিল। অপরপক্ষে চরম ক্ষমতাযুক্ত নৃপতিবর্গ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে নিজেদের হাতে কেন্দ্রীভূত করতে এবং সামন্ততন্ত্রকে ধ্বংস করতে সচেষ্ট হয়। নৃপতিরা শক্তিশালী রাজতন্ত্রের অধীনে জাতীয় রাষ্ট্র গঠন করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। সমকালীন সমাজের শিল্প-বাণিজ্যের মালিক ও ব্যবসায়ীরা এই উদ্যোগকে সমর্থন জানায়। বিরোধী শক্তি সুসংহত ও সবল হওয়ায় সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়।

বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব:

সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নতুন উৎপাদন শক্তির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। সমকালীন উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে এই বিকশিত নতুন উৎপাদন শক্তির সামঞ্জস্য সাধন অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করা দরকার। সমকালীন সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সহায়ক পরিস্থিতিতে বৈপ্লবিক অংশগুলির দ্রুত ও বিপুল বিকাশ সম্পন্ন হয়। ভৌগোলিক আবিষ্কার ও নতুন নতুন উপনিবেশ স্থাপিত হয়। ঔপনিবেশিক বাণিজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। শিল্পোৎপাদন, নৌ-বাণিজ্য ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অভাবিত অগ্রগতি ঘটে। উৎপাদন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নতুন উপকরণের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সময় নতুন নতুন উৎপাদন কৌশল ও যন্ত্রপাতি উদ্ভাবিত হয়। বাষ্প-চালিত যানবাহনের ব্যবহার শুরু হয়। বিকশিত নতুন উৎপাদন শক্তির কল্যাণে বৃহদায়তনবিশিষ্ট কল-কারখানা স্থাপিত হয়। শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়। রাজতন্ত্র- শাসিত ব্যবস্থায় শিল্পের মালিক ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তাদের উৎপাদন শক্তির বিকাশের স্বার্থে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অধিকতর ও নতুন সুযোগ-সুবিধার দাবিতে সোচ্চার হয়। এই সূত্রে সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যাণ্ডে এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। এই আন্দোলন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসাবে পরিচিত। পুঁজিপতিদের স্বার্থেই এই আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে। মার্কস ও এঙ্গেলসের অভিমত অনুসারে ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে সামন্ততান্ত্রিক মালিকানার অবসান ঘটেছে এবং বুর্জোয়া মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মার্কসীয় ব্যাখ্যা অনুসারে নতুন উৎপাদন শক্তির উদ্ভব ও বিকাশ, শিল্প-বাণিজ্যের ব্যাপক বিস্তার, বৃহদায়তনবিশিষ্ট শিল্প-কারখানায় সপ্তায় মজুরি-শ্রমিকের যোগান প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে একেবারে এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। এই পরিস্থিতি সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে প্রতিকূল প্রতিপন্ন হয়। এবং কালক্রমে সমাজতন্ত্রের অবসান অনিবার্য হয়ে পড়ে।

জাতীয়তাবাদী আন্দোলন:

পুঁজিবাদের উন্মেষ ও বিকাশের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী সত্তার গভীর সংযোগকে অস্বীকার করা যায় না। সামস্ততান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার থেকে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিল অধিকতর গতিশীল চরিত্রসম্পন্ন। ইউরোপে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আবির্ভাব ও বিকাশের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের অবদান অনস্বীকার্য। লেনিন-এর অভিমত অনুসারে পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কযুক্ত। তিনি বুর্জোয়া বিপ্লবের পরিণতি হিসাবে জাতীয়তাবাদকে প্রতিপন্ন করেছেন। পুঁজিবাদের আর্থ-সামাজিক কারণ জাতীয় আন্দোলনের মধ্যেও বর্তমান থাকে। জাতীয় আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার ধ্বংসের উপর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চূড়ান্ত সাফল্যের কথা বলা হয়ে থাকে। পুঁজিবাদের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল পণ্য-উৎপাদন। পণ্য উৎপাদনের স্বার্থে বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রণাধীনে দেশীয় বাজারের অস্তিত্ব অপরিহার্য। অর্থাৎ দেশের আভ্যন্তরীণ বাজার পুরোপুরি পুঁজিবাদীদের দখলে থাকা দরকার। এই বিষয়টির মধ্যেই যাবতীয় জাতীয় আন্দোলনের আর্থনীতিক ভিত্তি বর্তমান। এবং এই কারণেই সামস্ততন্ত্রের ধ্বংসের উপর পুঁজিবাদের বিজয় ও বিকাশের সমগ্র অধ্যায়টি জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে ইউরোপে ধর্ম-সংস্কার আন্দোলন জাতীয় ধর্ম ও জাতীয় শাসকের ধারণাকে পরিপুষ্ট করে। এবং তার ফলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশ ত্বরান্বিত হয়।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী আন্দোলন:

ধর্মের ক্ষেত্রে সংস্কারের অন্যতম সূচক হিসাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের কথা বলা হয়। আবার এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদই আর্থনীতিক ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের পথকে প্রশস্ত করে। এই কারণে বলা হয় যে পুঁজিবাদের আবির্ভাবের ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী আন্দোলনের অবদান অনস্বীকার্য। ঐতিহাসিক দিক থেকে বিচার করলে পুঁজিবাদের উদ্ভবের পিছনে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ভূমিকার গুরুত্ব স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়।

পণ্যোৎপাদন:

পুঁজিবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে একটা প্রয়োজনীয় বিষয় হল পণ্যোৎপাদন। পণ্য উৎপাদন পুঁজিবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পুঁজিবাদের বিকাশ পণ্যোৎপাদনের বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কার্ল মার্কসের অভিমত অনুসার পুঁজিবাদের উদ্ভব হয় পণ্যোৎপাদনের পরিণত অবস্থায়। নিজের বা পরিবারের প্রয়োজন পূরণের জন্য ব্যক্তির যে উৎপাদন তাকে পণ্য বলে না। উৎপন্ন দ্রব্য উৎপাদকের প্রয়োজন ব্যতিরেকে যখন অপরের প্রয়োজন পূরণে ব্যবহৃত হয়, তখন তাকে বলে পণ্য। অর্থাৎ উৎপন্ন দ্রব্য (product) বিনিময়ের মাধ্যমে পণ্যে (commodity) পরিণত হয়। সুতরাং মূলত বিক্রয় বা বাজারের জন্য যে উৎপাদন তাকে পণ্যোৎপাদন বলে। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল উৎপাদকবর্গ এবং এই উৎপাদকের উপর যাদের কর্তৃত্ব বর্তমান সেই সামন্তপ্রভুদের প্রয়োজন পূরণ করা। একে বলা হয় স্বাভাবিক উৎপাদন। সামন্ত সমাজের অবক্ষয় আরম্ভ হওয়ার পর এই স্বাভাবিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভাঙ্গন দেখা দেয়। এবং স্বাভাবিক উৎপাদনের জায়গায় শুরু হয় মুনাফা অর্জনের জন্য পণ্যোৎপাদন। এই পণ্যোৎপাদন হল পুঁজিবাদের মৌলিক লক্ষণ বিশেষ।

শ্রম-শক্তি:

পণ্যোৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষের শ্রম হল অপরিহার্য উপাদান। পণ্য উৎপাদনের জন্য মানুষের শ্রম একান্তভাবে আবশ্যক। এবং এই শ্রমের দ্বারাই মূল্য সৃষ্টি হয়। মূল্য আবার দু’ধরনের হয়—ব্যবহার মূল্য ও বিনিময় মূল্য। এখানে যে মূল্যের কথা বলা হয়েছে তা হল বিনিময়-মূল্য। এ মূল্য উপযোগিতাভিত্তিক প্রয়োজন-মূল্য নয়। পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যয়িত ‘শ্রম-সময়’-এর ভিত্তিতে বিনিময় মূল্য নির্ধারিত হয়ে থাকে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় বাজারে শ্রমশক্তিরও বিনিময়মূল্য পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অন্যান্য পণ্যের মতই শ্রম-শক্তিরও বিনিময় মূল্য আছে। এবং এক্ষেত্রেও শ্রম-সময়ের ভিত্তিতেই শ্রম-শক্তির বিনিময় মূল্য স্থিরীকৃত হয়। নিজের জন্য প্রয়োজনীয় মূল্যের অতিরক্তি শ্রমিক যা উৎপাদন করে তা হল পুঁজিবাদী মুনাফার উৎস। শ্রম-শক্তির মূল্য প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতানুসারে, ‘জীবন্ত শ্রমিকের মধ্যেই শ্রম-শক্তির অস্তিত্ব বর্তমান। নিজের জীবনধারণ ও পরিবার প্রতিপালনের স্বার্থে প্রয়োজনীয় পরিমাণে প্রাণধারণের উপকরণ আবশ্যক। জীবনধারণের জন্য এই নির্দিষ্ট পরিমাণ উপকরণ উৎপাদনের উদ্দেশ্যে যতখানি শ্রম-সময় আবশ্যক সেটাই হল শ্রম-শক্তির মূল্য।

লেনিনের অভিমত:

লেনিনের অভিমত অনুসারে পুঁজিবাদের আবির্ভাবের স্বার্থে দু’টি ঐতিহাসিক পূর্ব শর্ত প্রয়োজন। এই দুটি পূর্ব শর্ত হল: (ক) পণ্যোৎপাদন ব্যবস্থার অপেক্ষাকৃত উন্নত স্তরে কিছু ব্যক্তির হাতে বেশ কিছু অর্থ-সম্পদ সঞ্চিত হওয়া দরকার। (খ) একটি শ্রমিক শ্রেণীর অস্তিত্ব আবশ্যক। এই শ্রমিক শ্রেণী দু’দিক থেকে স্বাধীন হওয়া চাই। (১) ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিক্রয়ের ব্যাপারে শ্রমিকরা হবে সকল রকম বাধা-নিষেধহীন। (২) শ্রমিকরা সকল রকম সম্পদের মালিকানা থেকেও মুক্ত হবে। তারা হবে সর্বহারা। নিজেদের শ্রম-শক্তি ব্যতিরেকে তাদের অন্য কোনও ধন-সম্পদ থাকবে না। সুতরাং পুঁজিবাদের উদ্ভবের জন্য দুটি বিষয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। একদিকে থাকতে হবে উৎপাদনসমূহের মালিককে বা পুঁজিপতিকে। এবং অপরদিকে থাকতে হবে শ্রমিকদের। এই শ্রমিকদের জীবনধারণের একমাত্র উপায় হবে পুঁজিপতিদের কাছে মজুরির বিনিময়ে শ্রম বিক্রয় করা। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শ্রমিক কাজ করে। এই কাজের বিনিময়ে শ্রমিক মজুরি পায়। এবং পুঁজিপতির হাতে আসে মুনাফা। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যই হল এই মুনাফা অর্জন করা। এবং পুঁজিপতির এই মুনাফার উৎস হল উদ্বৃত্ত মূল্য।

উদ্বৃত্ত মূল্য ও শ্রমিক শোষণ:

পণ্যের উৎপাদন থেকে মুনাফার উদ্ভব হয়। আবার এই মুনাফা থেকেই জন্ম নেয় পুঁজিবাদ। এই প্রক্রিয়াটি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। পুঁজিপতির মুনাফার উৎস হল উদ্বৃত্ত মূল্য (Surplus Value)। উদ্বৃত্ত মূল্য উদ্বৃত্ত শ্রমের দ্বারা সৃষ্ট মূল্য। মার্কসের শ্রমের দুটো দিক বা অংশ বর্তমান। শ্রমের এই দুটো দিক বা অংশ হল ‘আবশ্যিক শ্রম’ বা ‘আবশ্যিক শ্রম-সময়’ (necessary labour-time) এবং ‘উদ্বৃত্ত শ্রম-সময়’ (Surplus labour-time)। শ্রমিক ও তার পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য যতটুকু শ্রম আবশ্যিক তা হল আবশ্যিক শ্রম। নিজের ও পরিবারের জীবন-যাপনের স্বার্থে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর মূল্যের সমান মূল্য সৃষ্টির জন্য শ্রমিককে যতক্ষণ শ্রম করতে হয়, তাকে বলে আবশ্যিক শ্রম সময়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মোট শ্রম-সময় থেকে আবশ্যিক শ্রম-সময় বাদ দেওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে তাকে বলে উদ্বৃত্ত শ্রম বা উদ্বৃত্ত শ্রম-সময়। আবশ্যিক শ্রম-সময়ে শ্রমিক যে মূল্য সৃষ্টি করে তা হল মজুরি মূল্য। অপরপক্ষে যে মূল্য উদ্বৃত্ত শ্রম-সময়ে সৃষ্টি হয় তা হল উদ্বৃত্ত মূল্য। শ্রমিকই এই উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টি করে। কিন্তু উৎপাদনের মালিক বা পুঁজিপতি এর থেকে শ্রমিককে বঞ্চিত করে এবং নিজে তা মুনাফা হিসাবে আত্মসাৎ করে। পণ্য বিক্রী করে যা পাওয়া যায় পুঁজিপতি তার একটা অংশ জীবনধারণের জন্য মজুরি হিসাবে শ্রমিককে দেয়। কিন্তু শ্রমিকের উৎপাদন এর থেকে অনেক বেশী, অবশিষ্ট অংশ মুনাফা হিসাবে মালিকই দখল করে। এইভাবে সৃষ্টি হয় মুনাফা বা উদ্বৃত্ত মূল্যের। শ্রমের ন্যায্য মজুরি থেকে মালিক শ্রমিককে বঞ্চিত করে বলেই সৃষ্টি হয় উদ্বৃত্ত মূল্যের বা মুনাফার। এই উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করাই হল শ্রমিক শোষণের পুঁজিবাদী পদ্ধতি। এবং শ্রমিক-শোষণই হল পুঁজিবাদের মৌলিক লক্ষণ। শ্রমিক শোষণ ও পুঁজিবাদ বহুলাংশে সমার্থক। পুঁজিবাদী প্রথায় অতিরিক্ত মুনাফার লোভে শ্রমিককে শোষণ করা হয়। এই শোষণের কাজে পুঁজিকে ব্যবহার করা হয়। এই প্রক্রিয়াই পুঁজিবাদের আকৃতি-প্রকৃতি প্রাপ্ত হয়। উদ্বৃত্ত মূল্যের পরিমাণ যত বাড়বে শ্রমিক-শোষণও তত বাড়বে। সুতরাং উদ্বৃত্ত মূল্য, মুনাফা ও পুঁজির ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির উৎস হল উদ্বৃত্ত মূল্য। উদ্বৃত্ত মূল্য বা মুনাফাই হল পুঁজিবাদী শোষণ। শ্রমিকদের শ্রমে উৎপন্ন মূল্যের একটি অংশ থেকে পুঁজিপতি শ্রেণী তাদের বঞ্চিত করে। শ্রমিকশ্রেণীকে বঞ্চিত করে পুঁজিপতিশ্রেণী সেই অংশটুকু মুনাফা হিসাবে নিজেই আত্মসাৎ করে। এই পথেই পুঁজিপতিশ্রেণী শ্রমিকশ্রেণীর উপর তার শোষণ কায়েম করে। এ প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের অভিমত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতানুসারে ‘শ্রমশক্তির মূল্য দেওয়া হয়; কিন্তু এই শ্রমশক্তি থেকে পুঁজিপতি যে পরিমাণ মূল্য আদায় করে নেয়, তার তুলনায় সে মূল্য কম। ঠিক এই পার্থক্যটুকুই, এই অবৈতনিক শ্রমটুকুই হল পুঁজিপতির অংশ, অধিকতর সঠিকভাবে সমগ্র পুঁজিপতি শ্রেণীর অংশ।” প্রকৃত প্রস্তাবে মজুরি-শ্রমিক প্রথার মধ্যেই এক নতুন ধরনের দাসত্ব-ব্যবস্থা বর্তমান আছে। এই কারণে অনেকের অভিমত অনুসারে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হল এক ধরনের মজুরি-দাসত্ব ব্যবস্থা।

বর্ধিত হারে পণ্যের পুনরুৎপাদন এবং পুঁজির পাহাড়:

পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মুনাফা বা শোষণকে বাদ দিয়ে তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে না। উৎপাদন-উপাদানের মালিক বা পুঁজিপতি-শ্রেণী এই মুনাফা বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগ-আয়োজনকে অব্যাহত রাখে। এ ধরনের উদ্যোগের অঙ্গ হিসাবে মজুরির হার হ্রাস, শ্রম-সময় বৃদ্ধি, শ্রমের বেগ বৃদ্ধি প্রভৃতি ব্যবস্থাদি গৃহীত হয়। পুঁজিপতিরা মুনাফা হিসাবে যে উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে, তার একটি অংশ তারা নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ব্যবহার করে ও অবশিষ্ট অংশকে তারা নতুন পুঁজিতে রূপাত্তির করে। তারপর পুঁজির মালিক এই নতুন পুঁজিকে মূল পুঁজির সঙ্গে যুক্ত করে। অর্থাৎ এই অবস্থায় পুঁজির মালিক শ্রেণী অধিকতর সংখ্যায় মজুরি-শ্রমিক নিয়োগ করে। তার ফলে পুঁজিবাদী উৎপাদনের পরবর্তী পর্যায়ে উদ্বৃত্ত-মূল্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পুঁজিপতিদের পুঁজির পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। এইভাবে পুঁজির পাহাড় গড়ে উঠে। সীমাহীনভাবে বাড়তে থাকে পুঁজির আয়তন। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় পণ্য উৎপাদনের পরবর্তী প্রতিটি পর্যায়ে বর্ধিত হারে পুনরুৎপাদনের ব্যবস্থা করা হয়। বর্ধিত হারে পুনরুৎপাদনের জন্য অধিকতর পরিমাণে পুঁজির প্রয়োজন হয়। এই প্রয়োজন পুরণের জন্য পুঁজির সঞ্চয় বৃদ্ধি করা দরকার। এবং এই কারণেই পুঁজির মালিকশ্রেণী উদ্বৃত্ত-মূল্য আত্মসাৎ করার পর তার একটি অংশকে নতুন পুঁজিতে পরিণত করে এবং আগের পুঁজির সঙ্গে তাকে যুক্ত করে। তার ফলে পুঁজির সঞ্চয় আবার বৃদ্ধি পায়। পুঁজির সঞ্চয় বৃদ্ধি এবং বর্ধিত হারে পুনরুৎপাদনের এই চক্রবৎ প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত থাকে।

পুঁজিবাদের আবির্ভাব:

পুঁজির আদি সঞ্চয় শুরু হয়েছে শোষণ-পীড়ন, লুণ্ঠন, বঞ্চনা, বলপ্রয়োগ প্রভৃতির মাধ্যমে। তবে পুঁজির ঐতিহাসিক ভিত্তি হল ব্যবসা-বাণিজ্য। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাতেই বিনিময়ের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি ও পরিধি প্রসারিত হয়। তারফলে বণিক শ্রেণীর সম্পদ-সামগ্রীর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বস্তুত বাণিজ্যিক পুঁজি এবং তেজারতি পুঁজি হিসাবেই পুঁজির প্রথম আবির্ভাব ঘটে। এবং ভৌগোলিক বিচারে পুঁজিবাদ প্রথম দেখা দেয় ইউরোপের দেশগুলিতে। পুঁজিবাদের আগমন প্রথম অনুভূত হয় যখন উৎপাদন উপাদানের মালিকশ্রেণী উদ্বৃত্ত সামগ্রী উৎপাদন এবং অধিক মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। তবে পুঁজিবাদের সাড়ম্বর আবির্ভাব ঘটেছে শিল্পবিপ্লবের পরই। বস্তুত অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

অর্থ-পুঁজি:

পুঁজিবাদী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্নভাবে বিকশিত হতে থাকে। শিল্পকারখানাগুলি ক্রমশ বৃহদায়তনবিশিষ্ট হয়ে পড়ে। এই সমস্ত বৃহৎ শিল্প-কারখানা ক্ষুদ্রায়তনবিশিষ্ট শিল্পকারখানাগুলিকে কার্যত গিলে ফেলে। তারফলে বৃহদায়তনের শিল্পকারখানাগুলির কলেবর ক্রমশ সম্প্রসারিত হতে থাকে। এই অবস্থায় বৃহৎ আকারে বিভিন্ন মহাজনী ব্যাঙ্ক গড়ে উঠে। এই মহাজনী ব্যাঙ্কগুলিই হল পুঁজিপতিদের অর্থের আধার। এই মহাজনী ব্যাঙ্কগুলি সমকালীন ক্ষুদ্রায়তনবিশিষ্ট ব্যাঙ্কগুলিকে গিলে ফেলে। তার ফলে মহাজনী কাঙ্কগুলি অধিকতর বৃহদাকার বিশিষ্ট হয়ে পড়ে। এই সমগ্র প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ একচেটিয়া শিল্পকারখানা এবং একচেটিয়া ব্যাঙ্কের উদ্ভব হয়। এই রকম আর্থনীতিক অবস্থায় একচেটিয়া ব্যাঙ্কগুলি তাদের পুঁজি একচেটিয়া কারখানাগুলিতে লগ্নি করে। এই লগ্নির পরিমাণ ও মেয়াদ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এইরকম পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয় অর্থ পুঁজির’ (Finance Capital)। ব্যাঙ্কের পুঁজি এবং শিল্পকারখানার পুঁজি মিলেমিশে অর্থপুঁজিতে পরিণত হয়। এ প্রসঙ্গে লেনিন বলেছেন: “The merging of bank capital with industrial capital the creation, on the basis of finance capital, of a financial oligarchy.” লেনিন আরও বলেছেন: “The concentration of production and capital developed to such a high stage that it created monopolies which play a decisive role in economic life.” অর্থ পুঁজির প্রভাব-প্রতিপত্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এই অর্থ পুঁজির ভিত্তিতে উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালিত হলে তা ‘অর্থ পুঁজিবাদ’ হিসাবে পরিচিত হয়। যাঁরা অর্থ পুঁজির মালিক তাঁরাই হলেন একচেটিয়া পুঁজি ও একচেটিয়া ব্যাঙ্কের মালিক। এদের নিয়েই গঠিত হয় অর্থ পুঁজিবাদী গোষ্ঠী। অর্থ পুঁজিবাদী গোষ্ঠীগুলি বৃহদায়তনবিশিষ্ট সমস্ত শিল্পকারখানা ও বড় বড় ব্যাঙ্কগুলির মালিকানা দখল করে নেয়। এই প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা কিছু অর্থ পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর কর্তৃত্বাধীনে আসে। এবং কালক্রমে মুষ্টিমেয় মহাধনী সমগ্র পুঁজিবাদী দুনিয়ার উৎপাদন ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করে।

সাম্রাজ্যবাদী স্তরে পুঁজিবাদের পদার্পণ:

পুঁজিবাদের চূড়ান্ত পর্যায় হল সাম্রাজ্যবাদ। ক্রমবিকাশের ধারায় পুঁজিবাদ যখন সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হয় তখন সৃষ্টি হয় সাম্রাজ্যবাদের। বৃহদায়তনবিশিষ্ট শিল্পকারখানায় প্রভূত পরিমাণ দ্রব্য-সামগ্রী উৎপাদিত হয়। দেশের আভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে তা অনেক বেশী। তা ছাড়া বৃহদায়তন উৎপাদন ব্যবস্থায় সস্তায় অধিকতর পরিমাণে কাঁচামালের প্রয়োজন প্রকট হয়ে পড়ে। সর্বোপরি অর্থ পুঁজির মালিকদের মুনাফার চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এই সমস্ত কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে বহির্বিশ্বে নতুন নতুন বাজারের প্রয়োজনীয়তা প্রবলভাবে অনুভূত হয়। নতুন বাজারের এই ব্যাপক চাহিদা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় পরিণত হয়। একচেটিয়া অর্থ পুঁজির মালিকগণ তাদের কারবারকে বিদেশের বাজারে প্রসারিত করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। পুঁজিবাদী শক্তিগুলি নানা অছিলায় ও অন্যায়ভাবে বলপ্রয়োগ ও যুদ্ধের মাধ্যমে দুর্বল দেশগুলিকে দখল করে। উপনিবেশগুলি একাধারে একচেটিয়া পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদিত দ্রব্য-সামগ্রীর জন্য নতুন বাজার ও চাহিদার অভাব পূরণ করেছে এবং সস্তায় কাঁচামাল সরবরাহের নিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। যাইহোক এইভাবে কালক্রমে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী স্তরে উপনীত হয়েছে। বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশের একচেটিয়া অর্থ-পুঁজির মালিকগোষ্ঠী পুঁজির জোরেই বিভিন্ন দুর্বল দেশের সরকারী ব্যবস্থার উপর কর্তৃত্ব কায়েম করে এবং অতিরিক্ত মুনাফা লাভের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। লেনিনের অভিমত অনুসারে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী স্তরে উপনীত হয়েছে ১৯০০ সালের কাছাকাছি সময়ে। Imperialism – The Highest Stage of Capitalism শীর্ষক গ্রন্থে লেনিন বলেছেন: “Imperialism emerged as the development and direct continuation of the fundamental attributes of capitalism in general.” এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন: “Imperialism is capitalism in the stage of development in which the domination of monopoly and finance capital has taken shape, in which the export of capital has acquired preponderant importance; in which the division of the world by international trusts has begun and in which the partition of all the territory of earth by the greatest capitalist has been completed.”