পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আকৃতি-প্রকৃতি পর্যালোচনা করলে এর কতকগুলি মৌলিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়। এই মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা সম্ভব হবে। তা ছাড়া এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক দিকগুলি সহজেই অনুধাবন করা যাবে। তবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কালক্রমে বিকশিত ও পরিবর্তিত হয়েছে। এই বিকাশ ও পরিবর্তনশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলিকে নিম্নলিখিতভাবে সংক্ষেপে সন্নিবিষ্ট করা যায়। উৎপাদনের উপাদানসমূহের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা এবং মুনাফার জন্য উৎপাদন হল পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য।

(১) কেন্দ্রীভূত ব্যক্তিগত মালিকানা: পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদানসমূহের মালিকানা কেন্দ্রীভূত থাকে পুঁজিপতিদের হাতে। শ্রমিক-শ্রেণী উৎপাদনের সকল প্রকার উপাদানের মালিকানা থেকে বঞ্চিত থাকে। পুঁজিপতিরা হল সংখ্যায় মুষ্টিমেয়। অপরদিকে শ্রমিকরা হল সংখ্যাগরিষ্ঠ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণার ভিত্তিতে উৎপাদন-উপাদানের উপর ব্যক্তিগত মালিকানাকে স্বীকার ও সমর্থন করা যায়।

(২) শ্রমশক্তি বিক্রয়: পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আপাতদৃষ্টিতে শ্রমিক-শ্রেণী স্বাধীন ও মুক্ত বলে প্রতিপন্ন হয়। কিন্তু আসল অবস্থা অন্য রকম। এ ধরনের সমাজব্যবস্থায় শ্রমিকরা উৎপাদনের সকল উপাদান থেকে বঞ্চিত। তারা সহায়-সম্বলহীন। এই অবস্থায় নিজেদের জীবনধারণ এবং পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য তারা পুঁজিপতিদের কাছে তাদের শ্রম শক্তি বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। পুঁজিপতির কাছে শ্রম বিক্রি করা ব্যতিরেকে শ্রমিকদের অন্য কোন উপায় থাকে না। পুঁজিপতিরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। নিরুপায় শ্রমিকদের শ্রমশক্তি কম দামে কেনে। পুঁজিবাদ হল পণ্য কেনা-বেচার এক বাজার। ‘শ্রমশক্তি’ হল এই বাজারের শ্রেষ্ঠ পণ্য। অন্যান্য পণ্যের মত শ্রমশক্তিও বাজারের প্রতিযোগিতার যাবতীয় প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে। শ্রমিকদের পরিশ্রম পুঁজি যতক্ষণ বাড়তে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত শ্রমিকদের কাজ থাকে।

(৩) উদ্বৃত্ত মূল্য ও শ্রমিক শোষণ: পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় মালিক শ্রেণী শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে নামমাত্র মজুরি দেয়। ন্যায্য পাওনা থেকে শ্রমিকদের তারা বঞ্চিত ও শোষণ করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিক শোষণের একটি বিশেষ ধারা বা ধরন বর্তমান। শ্রমশক্তির দ্বারা সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্যকে মালিকশ্রেণী মুনাফা হিসাবে আত্মসাৎ করে এবং এইভাবে শ্রমিকদের বঞ্চিত ও শোষণ করে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শ্রমিক শোষণের মাত্রা উদ্বৃত্ত মূল্যের পরিমাণের উপর নির্ভরশীল। উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করাই হল শ্রমিক-শোষণের পুঁজিবাদী পদ্ধতি। উদ্বৃত্ত মূল্যই হল পুঁজির উৎস। উদ্বৃত্ত মূল্য পুঁজির সঞ্চয় ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। পুঁজিবাদের প্রকৃত প্রকৃতি উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি ও সঞ্চয়ের প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল। পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পুঁজি কর্তৃক মজুরীশ্রম শোষণের মাধ্যমে শ্রমিক সাধারণের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা (alienation)-র সৃষ্টি হয়।

মার্কসীয় দর্শনে পণ্যের দ্বিবিধ মূল্যের কথা বলা হয়। এই দুটি মূল্য হল: পণ্যের ব্যবহার মূল্য এবং পণ্যের বিনিময় মূল্য। মানুষের প্রয়োজন পূরণের পরিপ্রেক্ষিতে পণ্যের ব্যবহার মূল্য স্থিরীকৃত হয়। অপরদিকে সংশ্লিষ্ট পণ্য উৎপাদনে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমসময় কি পরিমাণে সংযুক্ত তদনুসারে পণ্যের বিনিময় মূল্য নির্ধারিত হয়। পুঁজিপতি পণ্যের ব্যবহার মূল্য ছাড়াও বিনিময় মূল্য এবং উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে। শ্রমিক তার মোট শ্রম সময়ের একটা অংশ দিয়ে তার শ্রমশক্তির মূল্য উৎপাদন করে। এবং বাকি সময় দিয়ে উৎপাদন করে অতিরিক্ত মূল্য। এই অতিরিক্ত মূল্যই হল বাড়তি মূল্য বা উদ্বৃত্ত মূল্য। এই উদ্বৃত্ত মূল্য গ্রাস করে মালিক পুঁজিপতি। উদ্বৃত্ত মূল্যের হার বাড়িয়ে যাওয়া এবং সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক শোষণ বাড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে বর্তমান থাকে। শ্রমিক যে মূল্য সৃষ্টি করে তা সে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে না। মার্কসের অভিমত হল: “Capitalism separates the product of labour from labour itself.”

(৪) সরলীকৃত শ্রেণী-কাঠামো: তার শ্রেণী-কাঠামো পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচিত হয়। এই শ্রেণী-কাঠামো অপেক্ষাকৃত সরলীকৃত। পুঁজিবাদী সমাজ শোষক পুঁজিপতি এবং শোষিত শ্রমিক শ্রেণীতে বিভক্ত। পুঁজিবাদী সমাজে মালিক পুঁজিপতি শ্রেণী এবং শ্রমিক শ্রেণী ছাড়াও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কিছু মানুষ থাকে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে কৃষক, কারিগর, দোকানদার, ছোটখাট উৎপাদক প্রভৃতি মানুষের কথা বলা যায়। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজে এরা কালক্রমে শোষিত শ্রেণীর পর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়ে।

(৫) মুনাফার জন্য উৎপাদন: পুঁজিবাদী সমাজে মুনাফার জন্য পণ্য উৎপাদন করা হয়। মুনাফা অর্জনই হল পুঁজিবাদী উৎপাদনের মূল প্রেরণা। পুঁজিবাদী উৎপাদন বলতে মুনাফার জন্য পণ্য উৎপাদনকে বোঝায়। উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে পুঁজিপতিরা অধিক মুনাফা অর্জনের ব্যাপারে তাদের উদ্যোগকে অব্যাহত রাখে। এবং মুনাফার পরিমাণ যত বাড়তে থাকে পুঁজিপতিরা উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে তত বেশী উদ্যোগী হয়। মুনাফা অর্জন ও তাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করাই হল পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য।

(৬) উৎপাদন শক্তির উন্নতি: পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদন শক্তির দ্রুত উন্নতি ও ব্যাপক বিকাশ ঘটে। শিল্প সংগঠন, প্রযুক্তিবিদ্যা ও উৎপাদনের কলাকৌশলের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। পুঁজিপতিরা প্রতিযোগিতার বাজারে উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে গবেষণা খাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করে। তার ফলে কারিগরী বিদ্যা ও প্রযুক্তিগত কলাকৌশলের অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটে। উৎপাদনের ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট যন্ত্রপাতির বহুল ব্যবহার শুরু হয়। উন্নত মূলধন ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকদের উৎপাদন শক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। পুঁজিপতিরা নিজেদের মুনাফার স্বার্থেই এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করে।

(৭) শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র হিসাবে রাষ্ট্র: পুঁজিবাদী সমাজে রাষ্ট্র শ্রেণী-শোষণের হাতিয়ার হিসাবে ভূমিকা পালন করে। সর্বহারা শ্রমিক-শ্রেণীর উপর শোষণকে অব্যাহত রাখার উপায় হিসাবে পুঁজিপতি শ্রেণী রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পুঁজিপতি-শ্রেণীর স্বার্থে পীড়নমূলক ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি “Anti-Duhring”-এ মন্তব্য করেছেন: “The modern state,…is essentially a capitalist machine, the state of the capitalists,….”

(৮) বাজার অর্থনীতি ও শ্রমবিভাগের নীতি: পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বাজার অর্থনীতি (Market economy) পরিলক্ষিত হয়। বাজার অর্থনীতির নিয়ম অনুসারে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় সর্বপ্রথম শ্রমবিভাগ নীতির‌ প্রয়োগ দেখা যায়। এই নীতির প্রয়োগের ফলে আগের থেকে উৎপাদনের পরিমাণ বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। বাজার অর্থনীতির অস্তিত্বের কারণে পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদন ব্যবস্থার উপর সরকার বা বাইরের কোন শক্তির নিয়ন্ত্রণ বরদাস্ত করা হয় না। পুঁজিবাদী উৎপাদকরা ক্রেতাসাধারণের চাহিদা ও পছন্দ অনুসারে পণ্য উৎপাদন করে।

(৯) অবাধ প্রতিযোগিতা: পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল অবাধ প্রতিযোগিতা। পুঁজিবাদী সমাজে বাজার অর্থনীতির নিয়ম অনুসারে বিভিন্ন উৎপাদক-গোষ্ঠী ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অবাধ প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত হয়। পুঁজিবাদী সমাজে একচেটিয়া কারবারের নীতি অস্বীকৃত। এখানে অবাধ প্রতিযোগিতাকে স্বীকার ও সমর্থন করা হয়। পুঁজিপতি উৎপাদকরা নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের জন্য বাজার দখলের উদ্দেশ্যে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। এই অবাধ প্রতিযোগিতার কারণে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। কারণ উৎপাদন ব্যবস্থা অপরিকল্পিত ভাবে চলে।

(১০) পণ্যোৎপাদন: পণ্য উৎপাদনের একাধিপত্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচিত হয়। বিনিময় ও বিক্রয়যোগ্য দ্রব্যের উৎপাদনকে পণ্য উৎপাদন বলে। এই পণ্যোৎপাদনের সর্বোচ্চ ধরন হল এই পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা। Capital শীর্ষক গ্রন্থে পুঁজিবাদী অর্থনীতির আলোচনায় মার্কস পণ্যোৎপাদন সম্পর্কিত বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় ভোগের জন্য নয়, বিক্রির জন্য উৎপাদন পরিচালিত হয়। ব্যবসা ও বিক্রির বাজার সম্প্রসারিত করার জন্য উৎপাদন নিয়ন্ত্রিত হয়।

(১১) উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণ: পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদন প্রক্রিয়ার উপর পুঁজিপতি বা তার প্রতিনিধির পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়। পণ্য, প্রযুক্তি, কাজের পরিবেশ, শ্রম সময়, শ্রমশক্তি, শ্রমশক্তির মূল্য, উদ্বৃত্ত মূল্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে পুঁজিপতির অবাধ নিয়ন্ত্রণ পরিলক্ষিত হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদন প্রক্রিয়া ছাড়াও সব রকম আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা ও অধিকার পুঁজিপতির হাতেই থাকে।

(১২) বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে টাকার ব্যবহার বৃদ্ধি: পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিনিময়ের মূল মাধ্যম হিসাবে টাকার ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজি টাকার রূপ ধারণ করে। তার ফলে পুঁজির সচলতা বৃদ্ধি পায়। এবং পুঁজির পুনর্বিনিয়োগ ও বিস্তারের সুযোগ সম্প্রসারিত হয়। এই অবস্থায় ব্যবসা বাণিজ্যের বিস্তার ঘটে এবং ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য আর্থিক সংস্থাসমূহের কাজকর্মের পরিধি প্রসারিত হয়।

(১৩) পুঁজির সামাজিক প্রকৃতি: পুঁজি হল একটি আর্থ-সামাজিক শক্তি। পুঁজির একটি সামাজিক প্রকৃতি ও তাৎপর্য আছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে এককভাবে পুঁজির সৃষ্টি সম্ভব নয়। পুঁজির সৃষ্টি সম্ভব হয় সমাজের বহু ও বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে পুঁজিপতিদের ক্রমোন্নতি এবং প্রলেতারিয়েতদের ক্রমোন্নতি ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত।

(১৪) উদারনীতিক গণতন্ত্রের অনুপন্থী: পুঁজিবাদী সমাজে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৌলিক বিষয়গুলিকে স্বীকার ও সমর্থন করা হয়। স্বাধীনতা, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব, মানবাধিকার, জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রভৃতি উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ধারণাগুলিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পরিপোষণের ব্যবস্থা করা হয়। আর্থ রাজনীতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিবর্গের স্বাধীনতা ও অধিকারের অবাধ অনুশীলনকে পুঁজিবাদে স্বীকার করা হয়। এ সমস্ত ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অপ্রয়োজনীয় প্রয়োগ অস্বীকৃত। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাজনীতিক স্বাধীনতা ও অধিকারের উপর অত্যধিক গুরুত্ব ও মর্যাদা আরোপ করা হয়। সরকারের বিরোধিতা করার অধিকার এবং বিরোধী দল কর্তৃক বিকল্প সরকার গঠন করার অধিকার পুঁজিবাদে স্বীকার ও সমর্থন করা হয়। তা ছাড়া রাজনীতিক দল ও স্বার্থগোষ্ঠীসমূহের উদ্ভব, বিকাশ ও ভূমিকার স্বাধীনতাকে মেনে নেওয়া হয়। এই কারণে অনেকের মতানুসারে পুঁজিবাদই হল উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ ও সাফল্যের সহায়ক। তবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে সাধারণত রাজনীতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রাখার ব্যবস্থা করা হয়। কারণ পুঁজিবাদী পরিকাঠামোতে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের মৌলিক প্রলক্ষণগুলিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।

(১৫) এলিটদের প্রাধান্য: পুঁজিবাদে মুষ্টিমেয় বাছাই করা ব্যক্তির প্রাধান্যকে (elitism) সমর্থন করা হয়। পুঁজিবাদে যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়, তা হল প্রকৃত প্রস্তাবে অল্পকিছু এলিটদের শাসন। একে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন বলা যায় না। প্রকট ও প্রবল আর্থিক বৈষম্যের কারণে সর্বসাধারণের গণতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা অবহেলিত হয় এবং আর্থনীতিক ক্ষেত্রে যারা প্রভাবশালী তাদের প্রাধান্য ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। পুঁজিবাদের পরিকাঠামোতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সকল সুযোগ-সুবিধা এলিটদেরই করায়ত্ত থাকে। এই অবস্থায় জনসাধারণ রাজনীতিক ক্ষমতার সুযোগ-সুবিধা থেকে কার্যত বঞ্চিত থাকে।

(১৬) পুঁজিবাদী আর্থনীতিক ভিত্তি ও উপরিকাঠামো: পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজির জোরে দেশের আর্থনীতিক ভিত্তি পুঁজিপতিদের কুক্ষিগত থাকে। এবং এই সুবাদে উপরিকাঠামোও পুঁজিপতিদের দ্বারা তাদেরই স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত হয়। ভিত্তি এবং উপরিকাঠামো পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। উপরিকাঠামো গড়ে উঠে আর্থনীতিক ভিত্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও এ কথা সর্বাংশে সত্য। আর্থনীতিক ভিত্তি পুঁজিবাদী হলে উপরিকাঠামোও পুঁজিবাদী হতে বাধ্য। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উপরিকাঠামো হল তার মতাদর্শ, আইন-আদালত, শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিভিন্ন রাজনীতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি। পুঁজিবাদী আর্থনীতিক ভিত্তির দ্বারা তার উপরিকাঠামো গড়ে উঠে।

সাম্রাজ্যবাদী স্তরে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

ক্রমবিকাশের ধারায় পুঁজিবাদ এক সময় সাম্রাজ্যবাদী স্তরে উপনীত হয়। সাম্রাজ্যবাদী স্তরে উপনীত হওয়ার পরে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আরও কতকগুলি বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট প্রতিপন্ন হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলি মূলত আর্থনীতিক প্রকৃতির। এই বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কেও আলোচনা করা আবশ্যক।

(ক) সাম্রাজ্যবাদী স্তরে উৎপাদন ও পুঁজির অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভবন ঘটে। এই কেন্দ্রীভবনের কারণে একচেটিয়া পুঁজি ও একচেটিয়া কর্তৃত্বের সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রের আর্থনীতিক ক্ষেত্রে এই পুঁজি ও কর্তৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ও নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা পালন করে।

(খ) এই পর্যায়ে ব্যাঙ্ক-পুঁজি ও শিল্প-পুঁজি সংযুক্ত হয়। এই সংযুক্তির ফলে সৃষ্টি হয় ‘অর্থ পুঁজির’ (Finance Capital)। এবং এই অর্থ পুঁজি মুষ্টিমেয় মহাধনি বা ধনকুবেরের কুক্ষিগত হয়। অর্থাৎ ব্যাঙ্ক ও শিল্পসমূহের মালিকানা ধনকুবের পুঁজিপতিদের হাতে আসে। অধিকাংশ উৎপাদন ব্যবস্থা ও পুঁজির উপর অর্থ পুঁজির মালিক ধনকুবের পুঁজিপতিদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব কায়েম হয়।

(গ) সাম্রাজ্যবাদী স্তরে অর্থ পুঁজির মূল উদ্দেশ্য হল পুঁজি রপ্তানি করা। এই পর্যায়ে পণ্য রপ্তানির পরিবর্তে পুঁজির রপ্তানি প্রাধান্য পায়। পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে অল্পবিস্তর ঝুঁকি থাকে। কিন্তু পুঁজি রপ্তানির মাধ্যমে নির্দিষ্ট হারে সুদ লাভের ক্ষেত্রে কোন ঝুঁকি থাকে না। পুঁজি রপ্তানি সূত্রে অর্থ পুঁজির মালিকদের মুনাফা অর্জন নিশ্চিত ও নিরাপদ।

(ঘ) এই অবস্থায় অর্থ পুঁজির মালিক ধনকুবের পুঁজিপতিরা নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়ানর জন্য গড়ে তোলে একচেটিয়া আন্তর্জাতিক যৌথ সংগঠন। তারপর তারা দুনিয়া জুড়ে একচেটিয়া কারবার পরিচালনা করতে থাকে। এবং তার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আর্থনীতিক ব্যবস্থাদি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে আসে। এই সবের সামগ্রিক ফল হিসাবে তারা সমগ্র সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার অবাধ সুযোগ পায়।

(ঙ) একচেটিয়া পুঁজিবাদী গোষ্ঠগুলি বহির্বিশ্বে তাদের কার্যকলাপকে ছড়িয়ে দেয়। তাদের উৎপাদিত পণ্যের জন্য নতুন বিক্রয় বাজার সৃষ্টি এবং পণ্যোৎ-পাদনের জন্য সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একচেটিয়া পুঁজিপতিরা বহির্বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূখণ্ড দখল ও উপনিবেশ স্থাপনের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে একচেটিয়া পুঁজিবাদী শক্তিসমূহ পৃথিবীর বিভিন্ন অনগ্রসর অঞ্চল ও দেশকে উপনিবেশ হিসাবে দখল করে এবং নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয়।