[1] আধুনিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা: চিনে বিদেশি বণিকদের সীমাহীন শােষণ ও লুণ্ঠনের ফলে চিনবাসী জর্জরিত হয়। এই পরিস্থিতিতে সচেতন চিনা নাগরিকগণ উপলব্ধি করেন যে, আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চা ছাড়া চিনের অগ্রগতি সম্ভব নয়।

[2] মিশনারিদের আগমনের সূচনা: নানকিং-এর সন্ধির আগে থেকেই চিনে খ্রিস্টান মিশনারিদের আগমন শুরু হয়। রবার্ট মরিসন ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে চিনে আসেন এবং চিনা ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন। আমেরিকার খ্রিস্টান মিশনারিদের মধ্যে এলিজা কোলম্যান ব্রিজম্যান ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম চিনে আসেন এবং চিনে খ্রিস্টান সাহিত্য প্রসারের উদ্দেশ্যে একটি মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। মিশনারি পিটার পার্কার ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে চিনে এসে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে টি. রিচার্ড, জে. অ্যালেন, আলেকজান্ডার উইলিয়ামসন, এ. পি. মার্টিন প্রমুখ মিশনারি চিনে এসে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের কাজ করেন।

[3] পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার: খ্রিস্টান মিশনারি ও চিনা বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে চিনে পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে। ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, জার্মান প্রভৃতি বিদেশি ভাষা শিক্ষার জন্য ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে চিনে তুং ওয়েন কুয়ান নামে বিদেশি ভাষা শিক্ষার একটি কলেজ গড়ে ওঠে। এখানে গণিত, জ্যোতিষশাস্ত্র, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে আধুনিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সাংহাই, ক্যান্টন, ফুচাও প্রভৃতি শহরে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

[4] শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন: মিশনারিদের উদ্যোগে চিনে বহু বিদ্যালয়, গ্রন্থাগার, জাদুঘর প্রভৃতি স্থাপিত হয়। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে সাংহাই শহরে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি বিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।

[5] বুদ্ধিজীবী শ্রেণির উদ্ভব: চিনে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের প্রভাবে হু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী যুবকের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই যুবকরা চিনে প্রগতিশীল সমাজ-সংস্কারের দাবিতে সরব হন। তাদের উদ্যোগে পাশ্চাত্যের অনুকরণে চিনে আধুনিক ভাবধারা প্রসারের উদ্দেশ্যে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন চিনা বুদ্ধিজীবী কাংইউ-ওয়ে।

চিনে মাঞ্চু রাজবংশের অপশাসনের বিরুদ্ধে যেসব বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল তাইপিং বিদ্রোহ (১৮৫০-৬৪ খ্রি.)।

পরিচিতি: চিনা ভাষায় ‘তাইপিং’ কথার অর্থ হল বা মহান শান্তি। খ্রিস্টীয় প্রােটেস্ট্যান্ট চিন্তাধারার প্রভাবে এক ধরনের সমাজতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামাে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাইপিং বিদ্রোহীদের লক্ষ্য। এরূপ সমাজ গড়ে উঠলেই চিনে ‘স্বর্গীয় শান্তি’ বা ‘মহান শান্তি’ আসবে বলে বিদ্রোহীরা মনে করতেন।

কারণ

  • দেশবাসীর দুর্দশা: উনিশ শতকের মাঝামাঝি চিনের সাধারণ মানুষ চরম দুর্দশার শিকার হয়। খরা, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী প্রভৃতির সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মুদ্রাসংকট, বেকারত্ব প্রভৃতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তােলে।

  • সরকারের অপদার্থতা: চিনের দুর্বল ও অপদার্থ মাঞ্জু সরকারের শাসনকালে দেশে ব্যাপক অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম আফিমের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এই সরকার নানকিং-এর অপমানজনক সন্ধি (১৮৪২ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এই সরকারের প্রতি দেশবাসী প্রবল ক্ষুদ্ধ হয়।

  • কর্মচারীদের দুর্নীতি: মাঞ্জু সরকারের কর্মচারীরা ছিল সীমাহীন দুর্নীতিগ্রস্ত, লােভী ও অত্যাচারী। তারা কৃষকদের ওপর বিপুল করের বােঝা চাপিয়ে তা আদায়ে তীব্র অত্যাচার শুরু করে।

  • বিদেশি আধিপত্য: চিনের অভ্যন্তরে বিদেশিদের আধিপত্যের ফলে চিনারা ক্ষুধ হয়ে ওঠে। বিদেশিরা চিনে অবাধ অর্থনৈতিক লুণ্ঠন চালায়। বিদেশি পণ্যের দাপটে চিনা শিল্প বাণিজ্য ধ্বংস হয়। চিনারা কর্মহীন হয়ে পড়ে।

আন্দোলনের সূচনা: তাইপিং বিদ্রোহের প্রাণপুরুষ ছিলেন হ্যাং-শিউ-চুয়ান (১৮১৪-৬৪ খ্রি.)। ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ পেয়ে নিজেকে ঈশ্বরের সন্তান বলে ঘােষণা করেন এবং ঈশ্বর সেবকদের সংস্থা (১৮৪৪ খ্রি.) গঠন করে চিনে নতুন ধর্মপ্রচার শুরু করেন। তিনি মাঞ্জু শাসনের অবসান ঘটিয়ে চিনে স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান এবং নিজেকে ‘স্বর্গীয় রাজা বলে ঘােষণা করেন।

আন্দোলনের প্রসার: ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ফেংযুন-সান-এর নেতৃত্বে তাইপিংদের একটি সেনাদল গড়ে ওঠে। এই সেনাদল দক্ষিণ চিনের রাজধানী নানকিং দখল (১৮৫৩ খ্রি.) করে সেখানে তাইপিং রাষ্ট্রের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে। নানকিং-এর নতুন নামকরণ হয় তিয়েনকিং বা স্বর্গীয় রাজধানী। তাইপিংরা তাদের রাজ্যে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার চালু করে। ধূমপান, আফিম সেবন, মদ্যপান, জুয়াখেলা, ক্রীতদাস প্রথা, পতিতাবৃত্তি, বহুবিবাহ, পণপ্রথা প্রভৃতি নিষিদ্ধ হয়। এত অগ্রগতি সত্ত্বেও বিদেশি শক্তিগুলির সহায়তায় মাঞ্জু সরকার নানকিং পুনরুদ্ধার (১৮৬৪ খ্রি.) সক্ষম হয়। ব্যর্থ হাং-শিউ- চুয়ান আত্মহত্যা করলে বিদ্রোহ দুর্বল হয়ে পড়ে।