ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্বে পাঠশালা, টোল, মক্তব, মাদ্রাসা প্রভৃতি শিক্ষাকেন্দ্রে প্রাচীন শিক্ষাদান প্রথা চালু ছিল। পরে খ্রিস্টান মিশনারি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও বিভিন্ন প্রগতিশীল ব্যক্তির চেষ্টায় ভারতে প্রচুর শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা দান করা হত। ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে সর্বপ্রথম উদ্যোগ নেয়।

[1] অফিস-আদালতের প্রতিষ্ঠা: ভারতে ব্রিটিশ শাসনে সরকার এদেশে বহু অফিস-আদালত স্থাপন করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ এসব অফিস-আদালতে সরকারি চাকরি লাভের আশায় আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে তৎপর হয়ে ওঠে। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে তারা পাশ্চাত্যের সভ্যতা ও সংস্কৃতির অনুরাগী হয়ে ওঠে।

[2] চাকরিতে অগ্রাধিকার: সরকারি চাকরিই ছিল ঔপনিবেশিক আমলে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ভারতীয়দের প্রধান পেশা। ব্রিটিশ সরকার ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ঘােষণা করে যে, চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজি জানা। প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি আরও বেশি করে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি ঝুঁকে পড়ে।

[3] ব্রিটিশ অনুরাগী: ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণকারী মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিত সম্প্রদায় ইংরেজ সরকারের সহযােগী ও সমর্থকে পরিণত হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও ভূদেব মুখােপাধ্যায় ব্রিটিশবিরােধী রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেন। ডিরােজিওর অনুগামী রামগােপাল ঘােষ ব্রিটিশ সরকারের চাকরি প্রত্যাখ্যান করলেও ভারতে ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্বকে তিনি সমর্থন করতেন।

[4] মধ্যবিত্তদের উদ্যোগ: পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বেশ কয়েকজন প্রগতিশীল ব্যক্তি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন রামমােহন রায়, রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন, বৈদ্যনাথ মুখােপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ। রামমােহন ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। তিনি ভারতে আধুনিক বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ সরকারকে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে একটি চিঠি দেন। তাঁর এই চিঠি ভারতের নবজাগরণের ইতিহাসে একটি মূল্যবান দলিল।

[1] পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাব: ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ফলে সমাজজীবনে সর্বাপেক্ষা প্রগতিশীল শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারা পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের সভ্যতা, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, জাতীয়তাবাদ, মানবতাবাদ, জ্ঞানবিজ্ঞান প্রভৃতি মতাদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়। মধ্যবিত্ত শিক্ষিতরাই ভারতীয় সমাজে এসব ভাবধারা ছড়িয়ে দেয়।

[2] জাতীয় ঐক্য: মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে পাশ্চাত্য ও ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের জাতীয় স্তরের নেতৃবৃন্দের মধ্যে যােগাযােগ ও ঐক্য স্থাপিত হয়। ইংরেজি ভাষা এই ঐক্যের বন্ধন হিসেবে কাজ করে। এর ফলে ইন্ডিয়ান লিগ এবং ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েশন-এর মতাে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে।

[3] প্রগতিশীলতা: মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি বিষয়ে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা গড়ে ওঠে। এর ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যুক্তিবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার পটভূমি তৈরি হয়।

[4] জাতীয়তাবাদী সাহিত্য: পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সাহিত্য রচনায় উদ্যোগী হলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক সাহিত্যের অগ্রগতি ঘটে। তা ছাড়া জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী শােষণের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ভাষায় বহু সাহিত্য রচিত হতে থাকে।

[5] নবজাগরণ: মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাধ্যমে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারা ছড়িয়ে পড়লে ভারতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে বৈপ্লবিক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। এই ঘটনাকে অনেকে উনিশ শতকের ভারতীয় নবজাগরণ বলে অভিহিত করেছেন। বাংলায় এই নবজাগরণের সর্বাধিক প্রভাব পড়ে।

[6] জাতীয় আন্দোলন: মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভারতে ব্রিটিশবিরােধী জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে। মূলত তাদের নেতৃত্বেই ভারতে জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন শুরু হয়।

উপসংহার: উনিশ শতকের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভারতীয় সমাজজীবনে মধ্যমণি হিসেবে সমাজকে আলােকিত করেছিল। এ. আর. দেশাই এই শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণিকে আধুনিক ভারতের স্রষ্টা বলে অভিহিত করেছেন।