সূচনা: ব্রিটিশ শাসনকালে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারার প্রভাবে ভারতে যে বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ঘটেছিল তার সর্বাধিক প্রতিফলন ঘটেছিল বাংলায়। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারার প্রভাবে বাংলায় এক নবযুগের সূচনা হয়। এই ঘটনা ‘বাংলার নবজাগরণ’ (Bengal Renaissance) নামে পরিচিত।

[1] নবযুগের সূচনা: বাংলার মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায় ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করে। আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাবে বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা হয়। নবজাগরণের প্রভাবে বাংলায় যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, উপযােগিতাবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, সমাজবাদ, ডারউইনবাদ প্রভৃতি আধুনিক আদর্শের প্রসার ঘটে। জেরেমি বেন্থাম (১৭৪৮-১৮৩২ খ্রি.), টমাস পেইন (১৭৩৭-১৮০৯ খ্রি.), চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২ খ্রি.), জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-১৮৭৩ খ্রি.) প্রমুখ পাশ্চাত্য চিন্তাবিদের মতাদর্শ বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতিকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে।

[2] প্ৰাচ্যবিদ্যার চর্চা: পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাবে বাংলায় প্রাচ্যবিদ্যার ব্যাপক চর্চা শুরু হয়। কলকাতাকে কেন্দ্র করে এই চর্চা এগিয়ে চলে। প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার উদ্দেশ্যে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে স্যার উইলিয়াম জোন্স কলকাতায় এশিয়াটিক সােসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার, কানিংহাম, প্রিন্সেপ, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রমুখ তাদের গবেষণার মাধ্যমে দেশবাসীর সামনে প্রাচীন ভারতের অতীত গৌরবের কাহিনি তুলে ধরেন।

[3] মনীষীদের ভূমিকা: আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তরা বাংলার সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এবিষয়ে সবচেয়ে অগ্রগণ্য হলেন বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত রাজা রামমােহন রায়। পরবর্তীকালে ডিরােজিও, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ মনীষী বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলার ভাবধারার সংস্কার ঘটান।

[4] জ্ঞানের বিকাশ: নবজাগরণের প্রভাবে বাংলার শিক্ষা, সাহিত্য, চিত্রকলা, সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি সার্বিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের চেতনা দেশবাসীর মধ্যে প্রচার করেন। তাঁর আনন্দমঠ উপন্যাসের সন্তানদল জ্ঞানের সঙ্গে ভক্তির, ধর্মের সঙ্গে কর্মের সমন্বয়ের যে আদর্শ তুলে ধরে তা জাতিকে এগিয়ে যাওয়ার সঠিক পথ দেখায়। বিভিন্ন বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়। ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের চর্চার যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। এর ফলে বাঙালি জাতি মননে রাজনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটে। এই চেতনা শীঘ্রই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরােধিতা শুরু করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হন এই চেতনার রাজমুকুট।

[5] বিজ্ঞানে অগ্রগতি: পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের প্রভাবে বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটে। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ক্রেস্কোগ্রাফ ও বেতারযন্ত্র আবিষ্কার করে বিজ্ঞান জগতে নবদিগন্ত উন্মােচন করেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রসায়ন গবেষণায় খ্যাতি অর্জন করেন। পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বসু কোয়ান্টাম তত্ত্বের গবেষণা ও বােসন। কণা আবিষ্কার করে বিশ্বের দরবারে ভারতীয় বিজ্ঞানের উৎকর্ষ তুলে ধরেন। বাঙালি চিকিৎসক উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী কালাজ্বরের ঔষধ আবিষ্কার করে খ্যাতি অর্জন করেন। বিখ্যাত পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহা সাহা সমীকরণ প্রকাশ করে খ্যাতি অর্জন করেন।

[6] সংগঠন প্রতিষ্ঠা: বাংলায় নবজাগরণের সময় পাশ্চাত্যের অনুকরণে এখানে শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন (১৮০০ খ্রি.), কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০ খ্রি.), হিন্দু কলেজ (১৮১৭ খ্রি.), ক্যালকাটা স্কুলবুক সােসাইটি (১৮১৭ খ্রি.), কলকাতা মেডিকেল কলেজ (১৮৩৫ খ্রি.), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭ খ্রি.) প্রভৃতি।

উপসংহার: উনবিংশ শতকে বাংলার সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক জগতের জাগরণকে আচার্য যদুনাথ সরকার দ্বিধাহীনভাবে ‘নবজাগরণ’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, “পেরিক্লিসের যুগের এথেন্স যেমন সমগ্র গ্রিসের শিল্প ও সংস্কৃতির শিক্ষাকেন্দ্র ও জন্মদাত্রী ছিল, তেমনি ব্রিটিশ শাসনাধীনে সমগ্র ভারতের কাছে বাংলাও ছিল ঠিক তাই।” অধ্যাপক সুশােভন সরকার, অম্লান দত্ত প্রমুখ বাংলার জাগরণের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করেও একে ‘নবজাগরণ বলে মেনে নিয়েছেন।