বাংলাদেশের ইতিহাসে পাল ও সেনযুগ স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। ভারতীয় ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই দুই বংশের অধীনে ভারতের এই অংশে একটি বৃহত্তর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। স্বভাবতই বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির ওপর এই শাসনকালের বিশেষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
সমাজ : প্রাচীন বাংলার সমাজ-জীবনে ধর্ণবিন্যাস’ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গুপ্তযুগে আর্যসমাজের বৈশিষ্ট্যগুলি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও, পাল আমলে আর্যদের চতুর্বর্ণের অস্তিত্ব দেখা যায় না। তৎকালীন বাংলার বর্ণবিন্যাসের কেন্দ্রে ছিলেন ব্রাহ্মণগণ। বর্ণ হিসেবে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের উল্লেখ পাওয়া যায় না। পালযুগে বৌদ্ধধর্ম ও রীতিনীতি ব্রাহ্মণ্য-সমাজদর্শনকে ধীরে ধীরে স্বীকার করে নিয়েছিল। গৃহীবৌদ্ধগণও বর্ণশাসনকে মেনে চলতেন, যদিও বৌদ্ধধর্মে বর্ণভেদ ছিল না। সামাজিক জীবনে বৌদ্ধরাও মনুর শাসন অনুসরণ করতেন। তবে এযুগে বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ সম্পর্ক ছিল অতি সহজ ও সহনীয়। এ বিষয়ে পালরাজাদের বংশগত ঐতিহ্যের অভাবেরও কিছুটা ভূমিকা ছিল। ব্রাহ্মণদের পরেই ছিল করণ-কায়স্থদের স্থান। রাজা এবং রাজবৈদ্যগণও ‘করণ’ বলে নিজেদের পরিচয় দিতেন। পালযুগে কৈবর্তদের উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায়। তখন কৈবর্তরা যে বিশেষ প্রভাবশালী গোষ্ঠী ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় কৈবর্ত দিব্যর বিদ্রোহ ও সাফল্য থেকে। সমাজের নিম্নস্তরে ছিল মেদ, অন্ধ্র, চণ্ডাল, ডোম, শবর প্রভৃতি জাতি।
সেনযুগে বর্ণবিন্যাস অনমনীয় ও সুদৃঢ় আকার ধারণ করেছিল। ব্রাহ্মণ্যধর্মের গোঁড়া সমর্থক সেন রাজাগণ পালযুগের উদার বর্ণবিভাগকে বর্জন করে কঠোর বর্ণবিভাগ প্রবর্তন করতে সচেষ্ট ছিলেন। ব্রাহ্মণ ছাড়া সমস্ত বর্ণকেই তখন সংকর ও শূদ্র বর্ণের অন্তর্গত বলে মনে করা হত। এদের আবার উত্তম, মধ্যম ও অধম বা অন্ত্যজ—এই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করে প্রতিটি উপবর্ণের মর্যাদা ও বৃত্তি নির্দিষ্ট করা হত। সেনযুগের এই কঠোরতার অনিবার্য ফলস্বরূপ ব্রাহ্মণগণ সমাজের অন্যান্য সমস্ত শ্রেণির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। সম্ভবত, এই কারণে মুসলমান আক্রমণের সময় নিজপক্ষে গণ-সমর্থনের সম্ভাবনা নেই, লক্ষ্মণ সেন বিনা প্রতিরোধে নদিয়ায় পলায়ন করেছিলেন। এই যুগেই বাংলায় সহজিয়া ও ভাগবতধর্মী সমন্বয়কারী সাধকদের আবির্ভাব ঘটেছিল। অবশ্য সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান পেলেও প্রভাবশালী ব্রাহ্মণদের কর্তৃত্ব থেকে এঁরা সমাজকে মুক্ত করতে পারেননি। কারণ সমাজপতি ব্রাহ্মণগণ শূদ্রদের মধ্যে একাংশকে ম্লেচ্ছ বা অস্পৃশ্য ঘোষণা করে তাদের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর গড়ে তুলেছিলেন। সেনযুগে ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে ব্রাহ্মণগণ রাঢ়ীয়, বারেন্দ্রী প্রভৃতি নামে পরিচিতি লাভ করেন। আবার গ্রামের নাম অনুসারেও তাঁদের উপাধি চট্টোপাধ্যায়, ভট্টাচার্য প্রভৃতি হয়। তবে বল্লাল সেন কৌলীন্য প্রথার প্রচলন করেছিলেন কিনা, এ বিষয়ে সাম্প্রতিক কিছু বিতর্ক দেখা দিয়েছে। প্রখ্যাত গবেষক অতুল শুর তাঁর ‘বাংলায় সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন যে, একাদশ-দ্বাদশ শতকে নয়, পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে বাঙালি কুলপঞ্জিকারগণই কৌলীন্য প্রথা চালু করেছেন এবং এটিকে ঐতিহাসিক ব্যঞ্জনা দেবার জন্যই বল্লাল সেনের নাম এই ব্যবস্থার সাথে যুক্ত করেছেন। অবশ্য এই বক্তব্য অনেকে স্বীকার করেন না।
ধর্ম : পালরাজারা সাধারণভাবে বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁদের আনুকূল্যে বাংলাদেশ বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁদের আনুকূল্যে বাংলাদেশ বৌদ্ধধর্মের একমাত্র আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল। তবে ধর্ম বিষয়ে তাঁরা ছিলেন উদার ও সহিষ্ণু। তাই ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রেও তাঁরা মুক্তহৃদয় ছিলেন। হিউয়েন সাঙ বাংলাভ্রমণে এসে যেমন বৌদ্ধ বিহার দেখেছিলেন, তেমনি বহু হিন্দু-মন্দিরেরও অস্তিত্ব দেখেছিলেন। পালরাজাদের আমলে বৌদ্ধধর্ম ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের মধ্যে একটা সমন্বয়সাধনের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। পালযুগের বৌদ্ধধর্মের মধ্যে বৈদিক হিন্দুধর্মের নানা আচার অনুষ্ঠানের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বৌদ্ধধর্ম ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের পাশাপাশি তখন জৈনধর্মও স্বমহিমায় বিরাজ করত। অবশ্য ইতিপূর্বে জৈনধর্মের যে ক্ষয় শুরু হয়েছিল, পালযুগেও তা অব্যাহত ছিল।
পালযুগের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা সেনযুগে ছিল না। সেনরাজারা ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের গোঁড়া সমর্থক। সে আমলে বৈদিক ধর্ম ও সংস্কার আরও সুদৃঢ় ও প্রসারিত হয়েছিল। সেনরাজারা বৌদ্ধদের পীড়ন করেননি কিংবা তখন বৌদ্ধবিহার একেবারেই ছিল না, তা নয়। কিন্তু রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বৌদ্ধদের অতীত প্রভাব ছিল না। তখন বৌদ্ধদের ‘পাষণ্ড’ আখ্যা দেওয়া সাধারণ রীতিতে পরিণত হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যধর্মের সার্বিক প্রভাবের চিহ্ন সর্বত্র ছিল স্পষ্ট। এমনকি প্রধান প্রধান বৌদ্ধ বিহারগুলিতেও হিন্দুদেবদেবীর অবস্থান দেখা যায়। এককথায়, পালযুগের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা সেনযুগে অনেকটা হ্রাস পেয়েছিল।
পাল ও সেন যুগে বাংলার অর্থনীতি :
প্রাচীনকালের ধারা অনুযায়ী পাল ও সেন যুগে বাংলার অর্থনীতির ভিত্তি ছিল কৃষি-উৎপাদন। অবশ্য শিল্প ও বাণিজ্য থেকেও কিছু অর্থাগম ঘটত। জমির মালিক ছিলেন রাজা। তিনি কৃষকদের জমি দান-বিক্রয় ও দান করতেন। কৃষিজ উৎপাদনের মধ্যে প্রধান ছিল ধান। রামচরিতে উৎকৃষ্ট ধানের উল্লেখ পাওয়া যায়। অবশ্য সেকালের লেখগুলিতে বা সাহিত্যে ধানের বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায় না। ধান ছাড়া আখ, সুপারি, নারিকেল, সরষে, আম, কাঁঠাল, তুলো প্রভৃতি প্রচুর উৎপাদন হত। বরেন্দ্রভূমিতে তখন উন্নতমানের এলাচ উৎপাদন হত বলে জানা যায়।
শিল্প-উৎপাদনের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল কার্পাস বস্তু। এ ছাড়া কাষ্ঠনির্মিত গোরুর গাড়ি, পাল্কি, নৌকা ইত্যাদি ছিল অন্যতম শিল্পজাত দ্রব্য। মিনহাজ উদ্দিনের লেখা থেকে জানা যায়, সেযুগে দক্ষ অলংকার-শিল্পীরও অস্তিত্ব ছিল।
পাল ও সেনযুগে শিল্পীরা সংঘবদ্ধ ছিল। ‘দেওপাড়া লেখ’ থেকে ‘শিল্পীসংঘের’ (গিল্ড) কথা জানা যায়। সেখানে শূলপাণিকে ‘বারেন্দ্র শিল্পীগোষ্ঠী চূড়ামণি’ বলা হয়েছে। শিল্পীগোষ্ঠীর প্রধান নেতা মর্যাদার স্মারক হিসেবে রাজার দান গ্রহণ করতেন।
পাল ও সেন যুগে বাংলার বাণিজ্যে অবনতি ছিল লক্ষণীয়। সপ্তম শতাব্দীর পর থেকেই বাণিজ্যহ্রাসের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তখন বাণিজ্যে আরব বণিকদের আধিপত্যের সূচনা-পর্ব। ইতিপূর্বে তাম্রলিপ্ত বন্দরের যে রমরমা ছিল, এযুগে তা-ও ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল। লক্ষণীয় যে, পাল ও সেন আমলের মুদ্রার খোঁজ পাওয়া যায় না। স্বর্ণমুদ্রা ছিল না। রৌপ্যমুদ্রা পালযুগে কিছুটা প্রচলিত থাকলেও সেনযুগে তা আর ছিল না। তখন বিনিময়-মাধ্যম ছিল কড়ি।
পাল ও সেন আমলে প্রচলিত প্রধান কর ছিল চার প্রকার, যথা— ভাগ, ভোগ, কর ও হিরণ্য। ‘ভাগ’ছিল উৎপন্ন শস্যে রাজার প্রাপ্য এক-ষষ্ঠ্যাংশ ফুল, ফলমূল ইত্যাদি মাঝে-মাঝে রাজাকে দেওয়া হত। একে বলা হত ‘ভোগ’। ‘কর’ বলতে বোঝাত জনগণের আয়ের ওপর নির্ধারিত রাজার প্রাপ্য অর্থ। ‘হিরণ্য’ শব্দের প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে সন্দেহ আছে। অনুমান করা হয়, রাজা শস্যের পরিবর্তে যে নগদ মুদ্রা নিতেন, তাকেই ‘হিরণ্য’ বলা হত। সেযুগে কয়েকটি অপ্রধান করও আদায় করা হত। গোচারণভূমি, হাট, খেয়াঘাট প্রভৃতি ব্যবহারের জন্য কিছু কর প্রদান করতে হত। ‘উপরিকর’ বলে একটি করের উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্ভবত আপৎকালে প্রচলিত করের অতিরিক্ত হিসেবে এটি আদায় করা হত। অপরাধীদের কাছ থেকে শাস্তি হিসাবেও কিছু অর্থ রাজকোষে জমা পড়ত।
পাল ও সেন আমলের অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক হওয়ার ফলে তৎকালীন সভ্যতা ছিল প্রধানত গ্রামকেন্দ্রিক। গ্রামগুলি গড়ে উঠেছিল প্রধানত যেখানে জলের সুবিধা বেশি। তবে আকারে ও লোকসংখ্যার বিচারে গ্রামগুলির মধ্যে বিভিন্নতা ছিল। পাল ও সেনযুগ গ্রামপ্রধান হলেও তখন নগরের অস্তিত্বও ছিল। তাম্রলিপ্ত, কোষীবর্ষ, রামাবতী, লক্ষ্মণগড়, দণ্ডভুক্তি, কর্ণসুবর্ণ প্রভৃতি ছিল সেকালের কয়েকটি সমৃদ্ধ নগর। নগরগুলি ব্যবসাবাণিজ্য, তীর্থস্থান ও শিক্ষাসংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতির অধিকারী ছিল।
পাল ও সেন যুগে ধনবণ্টন-বৈষম্য ও তজ্জনিত সামাজিক অসাম্য ছিল। একদিকে ছিল বিত্তহীন কৃষক ও কারিগর শ্রেণি ; অন্যদিকে ছিল সমৃদ্ধ বণিক, প্রতাপশালী সামন্তশ্রেণি ও উচ্চপদস্থ রাজপুরুষবৃন্দ।
পালযুগে সাহিত্য চর্চা :
পালযুগে কাব্য-সাহিত্যের প্রধান মাধ্যম ছিল সংস্কৃত ভাষা। বানভট্ট সেকালে প্রচলিত ‘গৌড়ীয় রীতি’র উল্লেখ করেছেন। তবে নাট্যশাস্ত্রে ‘ওন্ড্র মাগধী’ নামক একটি রীতি জনপ্রিয় ছিল। পালযুগের একাধিক মন্ত্রি যেমন দর্ভপানি, কেদার মিশ্র, গুরুব মিশ্র প্রমুখ বেদ, আগমতন্ত্র ও জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশেষ বুৎপত্তির অধিকারী ছিলেন। পালযুগে বিশিষ্ট পণ্ডিত ভট্ট ভবদের ধর্মশাস্ত্র, জ্যোতিষবিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র ইত্যাদি নানা বিষয়ে সাহিত্য রচনা করেছিলেন। সিদ্ধান্ত, তন্ত্রসার ও গণিতশাস্ত্রে তাঁর বিশেষ পারদর্শিতা ছিল। জ্যোতির্বিদ্যা এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে ভট্ট ভবদেবের অসাধারণ পাণ্ডিত্যের জন্য তাঁকে ‘দ্বিতীয় বরাহ’ নামে অভিহিত করা হয়। তিনি হোরাশাস্ত্রের ওপর একটি গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। ধর্মশাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ পালযুগের আর এক পণ্ডিত ছিলেন জীমূতবাহন। সম্পত্তির উত্তরাধিকার সক্রান্ত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দায়ভাগ’। এছাড়া বিচার নিষ্পত্তি বিষয়ক গ্রন্থ ‘ব্যবহার মাতৃকা এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপযোগী দিন, ক্ষণ, ঋতু, মাস ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থ ‘কাল বিবেক’ জীমূতবাহনের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম হিসেবে স্বীকৃত।
পণ্ডিত লামা তারানাথের ভাষ্য থেকে জানা যায় যে, পাল যুগে মহাযান বৌদ্ধ আচার্যরা বৌদ্ধতন্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। নালন্দা, সোমপুরী, বিক্রমশীল ইত্যাদি মহাবিহার থেকে এই সকল বৌদ্ধতন্ত্র রচিত হয়েছিল। নালন্দা মহাবিহারের শীলভদ্র, ওদন্দপুরীর শান্তরক্ষিক, বিক্রমশীলের জ্ঞান মিশ্র প্রমুখ পণ্ডিত পালযুগে সাহিত্য চর্চা করেছিলেন। নৈয়ায়িক পণ্ডিত শান্তরক্ষিত শতাধিক (১৫০/ ৬০ টি) গ্রন্থের প্রণেতা ছিলেন বলে জানা যায়। বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ক কার্যকরণভাব সিদ্ধ’ জ্ঞান মিশ্রের বিখ্যাত রচনা। পালযুগে চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপরেও কয়েকটি গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এই আমলে জনৈক মাধব রচনা করেন ‘রোজবিনিশ্চয়’ গ্রন্থ। সুরেশ্বর তাঁর ‘শব্দপ্রদীপ’ গ্রন্থে বনযৌধির তালিকা দেন। চক্রপানি দত্ত রচনা করেন ‘চরক সংহিতা’ ও ‘সুশ্রত সংহিতা’র টীকাভাষ্য। বঙ্গ সেন বিরচিত ‘চিকিৎসাসার সংগ্রহ’ পাল আমলের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভেষজশাস্ত্র।
কালোত্তীর্ণ কাব্য সাহিত্য ‘রামচরিত’ পাল রাজাদের অনুকূল্যে রচনা করেন সন্ধ্যাকর নন্দী। দ্বিমাত্রিক এই কাব্য একদিকে রাজা রামচন্দ্রের বিবরণ, অন্যদিকে এটি পালরাজা রামপালের কীর্তি-কাহিনীর বিবরণ।
বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার সূচনা পালযুগে ঘটেছিল। সমকালীন সমাজে উচ্চশ্রেণির মানুষ সংস্কৃত ভাষায় কথা বললেও, গৌড়বঙ্গের সাধারণ মানুষের ভাব বিনিময়ের মাধ্যম ছিল। ‘অর্ধ-মাগধী’ বা ‘মাগধী-অপভ্রংশ’ ভাষা। চর্যাপদের মধ্যে এই অর্ধ-মাগধী ভাষার প্রয়োগ ঘটেছিল। তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের গূঢ় রহস্য প্রচার করার জন্য বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা ‘চর্যাপদ’ রচনা করেছিলেন। ‘চর্যাগীতি’ পয়ার ছন্দে লেখা, যার প্রয়োগ পরবর্তী কালে বৈষ্ণব সাহিত্য ও শাক্ত-পদাবলীতে দেখা যায়। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে চর্যাগীতির পুঁথি উদ্ধার করে প্রথম নিয়ে আসেন এবং গৌড়-বঙ্গে প্রচলিত কথ্য ভাষার সাথে এই সাহিত্যের ভাষার মিল বাংলা ভাষার প্রাথমিক রূপ সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পণ্ডিত শাস্ত্রী চর্যাগীতির সংকলন আবিষ্কারের পর সেগুলিকে ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’ নামে পুনঃপ্রকাশ করেন। ড.শহীদুল্লার মতে, চর্যাপদগুলি সপ্তম শতকের রচনা। কিন্তু রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন। এগুলির রচনাকাল দশম শতক। প্রায় ৫০ টি প্রাচীন চর্যাপদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। ড. মজুমদার লিখেছেন যে, চর্যাপদগুলিকে বাংলা সাহিত্যের আদিম উৎস বলা যেতে পারে। এর প্রভাবেই পরবর্তী পর্যায়ে বাংলা ভাষায় সহজিয়া গান, বৈষ্ণব পদাবলী, শাক্ত ও বাউল ধর্মী গানের উৎপত্তি ঘটেছে।’ তবে জটিল ও দুর্বোধ্য দর্শনতত্ত্বের ভারে চর্যাপদগুলির শ্রুতি মধুরতা ক্ষুন্ন হয়েছে। তাই এগুলিতে সাহিত্যগুণের পরিণত বিকাশ ঘটে নি।
সেনযুগে সাহিত্যচর্চা :
সেন রাজাদের আমলে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের লক্ষণীয় অগ্রগতি ঘটেছিল। সেন রাজারা কেবল সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না, তাঁদের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে সাহিত্যচর্চাও করতেন। রাজা বল্লাল সেন রচতি দু’টি বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুতসাগর’। এগুলিতে শ্রুতি ও স্মৃতি অনুমোদিত আচার-অনুষ্ঠানের আলোচনা ও নির্দেশিকা লিপিবদ্ধ আছে। দানসাগর এর বিষয়বস্তু দানকর্মের গুণাগুণ। অন্যদিকে ‘অদ্ভুতসাগরে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান জনিত শুভাশুভ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা আলোচনা করা হয়েছে। কবি শ্রীধর দাসের কাব্যসংগ্রহ ‘সদুক্তি কর্ণামৃত’ গ্রন্থে রাজা বল্লাল সেন, লক্ষ্মণ সেন ও কেশব সেন রচিত বহু শ্লোক পরিবেশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি ও মন্ত্রি হলায়ুধ পাঁচটি ‘সর্বস্ব’ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যথা— ব্রাহ্মণ সর্বস্ব, মীমাংসা সর্বস্ব, বৈষ্ণব সর্বস্ব, শৈব সর্বস্ব এবং পণ্ডিত সর্বস্ব। এদের মধ্যে কেবল প্রথম গ্রন্থটি পাওয়া গেছে। এই গ্রন্থে ব্রাহ্মণদের বৈদিক আচার ও স্মার্ত অনুশাসন যথাযথ অনুসরণের পরামর্শ দেওয়া আছে।
সেনযুগের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন জয়দেব। তাঁর অতি জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থটি হল ‘গীতগোবিন্দ’। রাধাকৃষ্ণের লীলাকে কেন্দ্র করে রচিত গীতগোবিন্দ মধ্যযুগে বাংলার বৈষ্ণব ধর্মের একটি সার্থক সৃষ্টি রূপে বিবেচিত হয়। বিভিন্ন প্রদেশের প্রায় চল্লিশজন টীকাকার এই কাব্যের ওপর ভাষ্য রচনা করেছেন। তবে গীতগোবিন্দ যথার্থ একটি কাব্যগুণসম্পন্ন রচনা নাকি একটি সার্থক গীতিনাট্য, এ বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। মানবিক গুণসম্পন্ন দুটি নারী-পুরুষের প্রেম কাহিনীর সাথে অতিমানবিক ও ঐশ্বরিক বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় এই কাব্যকে অনন্যতা দিয়েছে। সেনযুগের অন্যান্য সুখ্যাত সাহিত্যকারদের অন্যতম ছিলেন ধোয়ী, উমাপতি ধর, গোবর্দ্ধন ও শরণ। ধোয়ী কবি কালিদাদের ‘মেঘদূত’ কাব্যের অনুকরণে রচনা করেছিলেন ‘পরনদূত’ কাব্য। উমাপতি ধরের বিখ্যাত সৃষ্টি বিজয়সেনের ‘দেওপাড়া প্রশস্তি’, যা রাজশাহীর প্রদ্যুম্নেশ্বর মন্দিরের দেওয়ালে উৎকীর্ণ করা আছে। গোবর্দ্ধনের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হল ‘আর্যাসপ্তশতী।
পাল ও সেন যুগে শিল্পচর্চা :
শিল্পস্থাপত্য ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও পাল ও সেন যুগে বাংলাদেশে নানা পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে পাল ও সেন যুগে কোনো নতুনত্ব সাধিত হয়নি। ইতিপূর্বে প্রচলিত শিল্পভাবনাই কোনোক্রমে টিকেছিল বলা চলে। সেযুগের স্থাপত্যকর্মের মধ্যে ছিল কিছু স্তূপ, বিহার ও মন্দির। তবে এগুলির সবই কালের করাল গ্রাসে নষ্ট হয়ে গেছে। আছে শুধু সামান্য ধ্বংসাবশেষ। তা থেকেই পণ্ডিতেরা কল্পনার আলোকে সেকালের শিল্পীদের কৃতিত্ববিচারে প্রয়াসী হয়েছেন। পারসি ব্রাউন ও বিদেশি পর্যটকদের অনুমান—এযুগের স্তূপগুলি বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। এগুলির গঠন পদ্ধতি দেখে অনুমান করা যায় যে, এগুলি স্তূপের স্থাপত্য-বিবর্তনের শেষদিকের কাজ। স্তূপের চূড়া অধিক উঁচু ও চতুস্পার্শ্বের আকার বৃহৎ হওয়ার ফলে প্রথমদিকের স্তূপের থেকে এগুলির প্রভেদ ও মন্দিরশিল্পের সাথে কিছু সাদৃশ্য দেখা যায়। সেযুগের বিহার ও মন্দির বলতে সোমপুর বিহারের কিছু অবশিষ্ট এখনো দেখা যায়। বাকি সবই প্রকৃতি ও মানুষের আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। গবেষক কাশীনাথ দীক্ষিতের মতে, এই মন্দিরের স্থাপত্যরীতি ছিল সম্পূর্ণ নতুন। পূর্বে অথবা পরে এই রীতির নিদর্শন দেখা যায় না। কিন্তু অধ্যাপক সরসীকুমার সরস্বতীর মতে, এটি প্রচলিত মন্দির-রীতি অনুযায়ী নির্মিত হয়েছিল। ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে পালযুগের কিছু অবদান থাকলেও সেনযুগ এ বিষয়ে নীরব। পাল-ভাস্কর্যের ভাণ্ডার ছিল পাহাড়পুর। এখানকার মন্দিরগাত্রে উৎকীর্ণ ফলকগুলি থেকে সেযুগের ভাস্কর্যকর্মের পরিচয় পাওয়া যায়। পাল-ভাস্কর্যে গুপ্তযুগের কিছু প্রভাব থাকলেও তা মৌলিকতাবর্জিত ছিল না। মূর্তিগুলি সবই ছিল ব্রাহ্মণ্যধর্মের দেবদেবীর। অধ্যাপক সরস্বতী বৈশিষ্ট্যগত তারতম্য অনুসারে মূর্তিগুলিকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। মুর্তিগুলির সুষ্ঠু বেশবাস নমনীয়তামার্জিত রুচির পরিচায়ক। তবে তৎকালে ভাস্কর্যশিল্প ছিল। একান্তভাবে ধর্মভিত্তিক ও ধনী সম্প্রদায়ের বস্তু। এগুলি প্রকৃত অর্থে লোকশিল্প ছিল না। পালযুগের প্রখ্যাত শিল্পী ছিলেন ধীমান ও বীতপাল। স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের মতো চিত্রশিল্পেও পালযুগের কিছু অবদান ছিল। তবে এগুলিও অতীতের ধারা বহন করেছিল মাত্র, চিত্রশিল্পে এযুগ কোনো নতুন মাত্রা যোগ করতে পারেনি।
Leave a comment