ভূমিকা: বিশ্ব সভ্যতার অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্য পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতা বন্ধ হওয়া জরুরি। এই সরল সত্য অনুধাবন করে তাই অধুনা শান্তি প্রতিষ্ঠার একাধিক পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে।
[1] প্রেক্ষাপট: পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতা শুরু হওয়ার অনেক আগেই নিরস্ত্রীকরণের উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরােসিমায় ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৬ আগস্ট ও নাগাসাকিতে ৯ আগস্ট আণবিক বােমার বিস্ফোরণ ঘটালে সার্বিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণের প্রচেষ্টা শুরু হয়।
[2] পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই সােভিয়েত ও মার্কিন উভয় তরফেই পারমাণবিক বােমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর ফলে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে যাতে পারমাণবিক যুদ্ধে বিশ্বের ধ্বংসসাধনের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই ধ্বংস প্রক্রিয়া MAD (Mutually Assured Destruction) তত্ত্ব নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে সােভিয়েত ও মার্কিন একে অপরকে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রথম আঘাত হানার ভয় দেখিয়ে নিবৃত্ত করার নীতি নেয়। এই নীতির নাম Policy of Nuclear Deterrence। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতার অগ্রগতিকালে শক্তিসাম্য ত্রাসের সাম্য (Balance of Terror) নামে পরিচিতি লাভ করে।
[3] শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ
-
আণবিক শক্তি কমিশন গঠন: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভার প্রস্তাব অনুসরণে একটি পরমাণু শক্তি কমিশন (Atomic Energy Commission) গঠন করা হয়। এই কমিশন আণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বিস্তারিত পরিকল্পনা রচনার সিদ্ধান্ত নেয়।
-
জেনেভা নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন: রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে জেনেভাতে এক নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন বসে। এই সম্মেলনে নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টি তদারকির জন্য ১০টি সদস্য রাষ্ট্রকে নিয়ে এক কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে সদর্থক আলােচনার প্রস্তাব রাখে।
-
পরবর্তী সম্মেলনসমূহ: রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে, তারপর ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে আণবিক অস্ত্র রােধের লক্ষ্যে একাধিক পদক্ষেপ গৃহীত হয়। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে সােভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মহাকাশে ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।
-
বারুচ পরিকল্পনা: মার্কিন রাষ্ট্রপতি টুম্যান বিশিষ্ট শিল্পপতি তথা কূটনীতিবিদ বার্নার্ড বারুচকে পারমাণবিক শক্তি কমিশনের প্রতিনিধি মনােনীত করেন। বারুচ নিরস্ত্রীকরণ সম্পর্কিত এক পরিকল্পনা কমিশনে পেশ করেন (১৯৪৬ খ্রি., ১৫ জুন) যা ‘বারুচ পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত। এর দ্বারা একটি আন্তর্জাতিক আণবিক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (International Atomic Development Authority বা IADA) গঠন করে পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের উৎস এবং পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে বেশ কিছু প্রস্তাব রাখা হয়।
-
আইজেনহাওয়ার পরিকল্পনা: মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার পারমাণবিক দ্রব্যের শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের লক্ষ্যে রাষ্ট্রসংঘে এক পরিকল্পনা পেশ করেন। এই পরিকল্পনায় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সামরিক ঘাঁটিগুলির আলােকচিত্র ও ব্লু প্রিন্ট বিনিময়ের উল্লেখ করেন। এ ছাড়াও তিনি রাষ্ট্রসংঘের তত্ত্বাবধানে এক আন্তর্জাতিক শক্তি কমিশন গঠনের কথা বলেন।
-
সােভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোগ: সােভিয়েত ইউনিয়নও পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুন গ্রোমিকো পরিকল্পনা নামে এক প্রস্তাব পেশ করে।
-
সাধারণ সভায় নিরস্ত্রীকরণে প্রস্তাব পেশ: ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে সােভিয়েত ইউনিয়ন সাধারণ সভার নিরস্ত্রীকরণ কমিশনের উপসমিতির কাছে এক প্রস্তাব পেশ করে। এই প্রস্তাবে বিভিন্ন দেশের সামরিক খাতের খরচের পরিমাণ কমানাের কথা বলা হয়।
-
সােভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধানের উদ্যোগ: সােভিয়েত রাষ্ট্রপতি ক্রুশ্চেভ জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সভায় সর্বাত্মক নিরস্ত্রীকরণের প্রস্তাব তােলেন। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি ব্রেজনেভ কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র সীমিতকরণের লক্ষ্যে মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান রিচার্ড নিকসনের সঙ্গে মস্কোতে সল্ট-১ চুক্তি (২৬ মে, ১৯৭২ খ্রি.) এবং পরবর্তী মার্কিন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টারের সঙ্গে ভিয়েনায় সল্ট-২ (১৮ জুন, ১৯৭৯ খ্রি.) চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পরবর্তীকালে সােভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান মিখাইল গরবাচভ মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশের সঙ্গে START-I (১৯৯১ খ্রি., ৩১ জুলাই) নামে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এই চুক্তিতে সােভিয়েত ও মার্কিন উভয় রাষ্ট্রের অস্ত্রসম্ভারের অস্ত্রসংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। পরবর্তী রুশ প্রজাতন্ত্রের প্রধান বরিস ইয়েলৎসিন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বুশের সঙ্গে START-II চুক্তি সম্পাদন করেন (১৯৯৩ খ্রি., জানুয়ারি)। এই চুক্তিতে উভয় দেশ নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার অর্ধেকেরও বেশি নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে সম্মত হয়।
উপসংহার: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত রাশিয়া মূলত এই দুই দেশের নেতৃত্বে পারমানবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতা শুরু হয়। আবার এই দুই দেশের উদ্যোগেই মূলত বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হয়।
Leave a comment