এখানে পাপিষ্ঠা বলতে শৈবালিনীকে নির্দেশ করা হয়েছে। উপন্যাসের তৃতীয় খণ্ডের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে নূতন পরিচয় অংশে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।

নবাব মীরকাসেমের নিকট উপস্থিত হয়ে শৈবালিনী প্রতাপের সম্যক পরিচয় দানের পর তিনি নিজের সম্পর্কে মিথ্যার আশ্রয় নেন। তিনি নিজেকে প্রতাপের স্ত্রী রূপসী রূপে পরিচয় দিলেন। এই কারণে তাঁকে পাপিষ্ঠা বলা হয়েছে।

ইংরাজ অতর্কিতে প্রতাপে গৃহ আক্রমণকে দলনীসহ প্রতাপকে বন্দি করে নিয়ে গেলে, শৈবালিনী তা চাক্ষুস প্রত্যক্ষ করেছিলেন, কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করেননি। এদিকে ব্রষ্মচারীর পত্র পেয়ে নবাব প্রতাপের বাসায় শিবিকা পাঠালেন দলনী ও কুলসমকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। গৃহে শৈবালিনী ছাড়া অন্য কেউ ছিলেন না। নবাবের অনুচররা তাঁকে বেগম বলে ঠাওরালেন। শৈবালিনী যখন শুনলেন তাঁকে কেল্লায় যেতে হবে, তখন অনায়াসে তাঁর মাথায় দুরভিসন্ধি উপস্থিত হয়। তিনি অজানিত এক আশায় তাড়িতা হয়ে কোনো আপত্তি না করে শিবিকাতে আরোহণ করলেন। নবাবের নিকট হাজির হয়ে কপটতা অবলম্বন করে পরিচয় দিতে থাকলেন– তিনি ব্রাহ্মণকন্যা, রাজভৃত্যগণ তাঁকে এখানে নিয়ে এসেছেন। এবং দলনী ও কুলসমের পরিণতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর পর প্রতাপের বন্দিদশাও গোপন করলেন না। শেষে জানালেন প্রতাপ তাঁর স্বামী, এখানে এসেছিলেন সরকারে চাকরি করবেন বলে। কিন্তু অকস্মাৎ ইংরাজদের রোষে পড়ে প্রতাপ ধৃত হন। তিনি প্রতাপের স্ত্রী রূপসী, নবাবের নিকট এসেছেন দরবার করতে। অর্থাৎ শৈবালিনী এসেছেন রাজসমীপে তিনি বলতে এসেছেন- প্রতাপের স্ত্রী রূপসী তাঁর পরিচয়। মূলতঃ শৈবালিনীর এই দুরভিসন্ধির আসল অর্থ হল– নবাবের সহায়তায় প্রতাপকে উদ্ধার করা।

আক্ষরিক অর্থে শৈবালিনী দৈহিক দিক থেকে পাপিষ্ঠা নন, তিনি ফষ্টর কর্তৃক অপহ্তা হয়ে গঙ্গাবক্ষে একই নৌকায় ফষ্টরের সঙ্গে অবস্থান করলেও কোনো সময়ের জন্য ফষ্টরকে স্পর্শ করতে দেননি। ব্রাহ্মণের মেয়ে বলে বিধর্মীর ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলতে তিনি নিজেই রান্না করে খেতেন। সর্বদা একখানা ধারালো ছুরি তিনি নিজের কাছে গচ্ছিত রাখতেন। যদি কখনো অসতর্ক মুহূর্তে ফষ্টর কর্তৃক আক্রান্ত হন, আত্মরক্ষার জন্য ছুরিটি তিনি ফষ্টরের বুকে বসিয়ে দেবেন। এদিক থেকে বিচার করলে শৈবালিনী নিষ্কলুষ। দৈহিক শুচিতা রক্ষা করতে তিনিকে এমন সাবধান ভাবে রেখেছিলেন তাতে বিস্ময়ের উদ্রেক করে।

কিন্তু মানসিক দিক থেকে শৈবালিনী কিন্তু দ্বিচারিতার শিখর দেশে নিজেকে প্রতিস্থাপন করেছে। বাল্য হতে তিনি প্রতাপকে ভালোবাসতেন, উভয়ের বিবাহ অনিশ্চিত জেনে একসাথে ডুবে মরতে গিয়ে প্রতাপ ডুবেছিলেন কিন্তু শৈবালিনী জীবন ও যৌবনের মোহে না ডুবে ফিরে এসেছিলেন। এতো দ্বিচারিতার নামান্তর। তারপর চন্দ্রশেখরের মতো সুপুরুষকে স্বামীরূপে পেয়েও ক্ষণিকের জন্য ভুলতে পারেননি প্রতাপ কে। তিনি অন্তকরণে জেনেছিলেন প্রতাপ ভিন্ন তাঁর ইহজগতে কোনো সুখ নেই। প্রতাপের জন্যেই তিনি অজানিত আকাঙ্ক্ষায় ফষ্টরের সঙ্গে রাতের অন্ধকারে কূলত্যাগিনী হয়েছিলেন। বিধর্মীর সঙ্গে গঙ্গাবক্ষে তিনি অবস্থান করেছেন। আবার নিজেকে রূপসী সাজিয়ে স্বামী প্রতাপকে উদ্ধারের জন্য ছলনা করে নবাবের নিকট এসেছেন দরবার জানাতে। হয়তো তাঁর এই আগমনের মধ্যে বিশেষ মহত্ব ছিল কিন্তু এমন মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া তো দ্বিচারিতা নামান্তর। সব মিলিয়ে শৈবালিনী দৈহিক দিক থেকে শুচিতা রক্ষা করে চললেও মানসিক দিক থেকে তিনি যথার্থই পাপিষ্ঠা রূপে সুঅঙ্কিত।