এই কথাটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের অন্যতম রূপক নাটক গুরুর প্রাণবন্ত চরিত্র পঞ্চক বলেছে। নববর্ষের সজল হাওয়ায় মনের সমস্ত ক্লেশ, ক্ষোভ দূর হয়ে যাবার জন্য পঞ্চক গান ধরেছে। আকাশের ঘন নীল মেঘের মধ্যে সে তার মুক্তির পথ দেখতে পেয়েছে। তাই সে নৃত্যসহকারে গান ধরেছে এবং অচলায়তনের অন্য ছাত্রদেরও মাতিয়ে তুলেছে। তার জন্য তার দাদা মহাপক তাকে তিরস্কার করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন সুভদ্রের উত্তরের জানলা খুলে দেখবার জন্য উত্তরের অধিষ্ঠাত্রী একজটা দেবী প্রচণ্ড রেগে গিয়ে শাপ দিয়েছেন, ফলে অচলায়তনের অধিবাসীদের বুদ্ধিভ্রম ও মতিভ্রম ঘটেছে। মহাপঞকের ধারণা যে পাথর দিয়ে অচলায়তন প্রতিষ্ঠিত, সেগুলি আর বাঁধনে থাকবে না।

এই পরিস্থিতিতে পঞ্চক বলেছে পাথরগুলাে পাগল হয়েছে, তাই তারা গান গেয়ে ছুটে বেরিয়ে যাবে, আর বদ্ধ থাকবে না। প্রচণ্ড নিয়মনীতির বেড়াজালে অত্যাচারিত হতে হতে একদিন তারা তাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি হারিয়ে পাগল হয়ে যায় জীবনের আনন্দধারায় ফেরবার জন্য। জীবন যখন পিছু হটতে হটতে সংকীর্ণতার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখনই সে সবকিছুকে ভেঙে খােলা আকাশে বেরিয়ে আসতে চায় নতুন করে বাঁচবার জন্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গুরু’ নাটকে দেখা যায়, অচলায়তনের প্রথা ও শাস্ত্রনির্দেশিত পটভূমিতে নাট্যকারের মুক্ত জীবনবােধের প্রতীক হয়েই পঞ্চকের আগমন ঘটেছে। নাটকে তার নিম্নলিখিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করা যায়-

প্রথাবিরােধিতা : ‘গুরু’ নাটকের একেবারে গােড়া থেকেই পঞ্চক প্রথাবিরােধী। সে গান করে, পুথিপত্র সব ফেলে দিয়ে গুরুর আগমনের জন্য অপেক্ষা করে থাকে।

যুক্তিবাদিতা ও নির্ভীকতা : যুক্তি দিয়ে পঞ্চক সবকিছুকে গ্রহণের পক্ষপাতী ছিল বলেই মহাময়ূরী দেবীর পুজোর দিন কাঁসার থালায় ইঁদুরের গর্তের মাটি রেখে তার ওপর পাঁচটা শেয়ালকটা পাতা আর তিনটে মাষকলাই সাজিয়ে আঠারাে বার ফু দিয়েছে। পঞ্চক নির্ভীক ছিল বলেই অচলায়তনের বেশিরভাগ প্রথা ভাঙতে তার মধ্যে কোনাে ভয় দেখা যায় না।

সহানুভূতিশীলতা: সহানুভূতিশীলতা ছিল বলেই সুভদ্রের কান্না পঞ্চক কিছুতেই সহ্য করতে পারেনি। আচার্যকে সঙ্গে নিয়ে সে সবসময় সুভদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে মানসিক শক্তি জুগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।

মুক্তিপ্রিয়তা : অচলায়তনের বদ্ধ জীবনে পঞ্চক ভেতরে ভেতরে হাঁপিয়ে উঠেছিল বলে প্রায়শ্চিত্তের মধ্যে সে খুঁজে পেত একঘেয়েমির অবসান। তাই অন্ত্যজ শূনকদের মধ্যে গিয়ে নেচে ওঠায় বা দর্ভকপল্লিতে নির্বাসিত হয়ে তার মধ্যে বেঁচে থাকার সীমাহীন আনন্দ প্রকাশ পায়।

যে পঞ্চক একদা ছিল অচলায়তনের ‘মূর্তিমান বিঘ্ন’ বা দুর্লক্ষণ, নাটকের শেষে দেখা যায়, সেই পঞ্চকই হয়ে ওঠে অচলায়তনের জানলাগুলাে ভেঙে ফেলে সম্পূর্ণ নতুন আদর্শের একটি শিক্ষায়তন গড়ে তােলার অন্যতম প্রধান কারিগর।

মুক্ত আকাশের আলাে ও বাইরের ম্লেচ্ছজাতির মেলামেশা আটকাবার জন্য অচলায়তনের প্রাচীর বাড়তে বাড়তে একসময় আকাশ ছুঁয়েছিল। পঁয়ত্রিশ হাত উঁচু পাঁচিলকে আশি হাত উঁচুতে পরিণত করার জন্য লােকও লাগিয়েছিল তারা। এমন কোনাে পথ খােলা রাখেনি তারা যেখান দিয়ে সহজেই গুরু প্রবেশ করতে পারেন। গুরু তাই তাঁর অনুবর্তী শূনকদের সঙ্গে নিয়ে অচলায়তনের সকল প্রাচীর ভেঙে ফেলে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেন। তিনি নিশ্চিন্ত মুক্ত মনে খােলা আকাশের নীচে ঘুরে বেড়ান, শূনকদের বা অন্ত্যজ জাতি দর্ভকপল্লির বাসিন্দাদের সঙ্গে গান করতে, মিশতে বা একসঙ্গে খেতে পিছপা হন না। তাই অচলায়তনের পাথরের অটল প্রাচীর গুরুর সহযােদ্ধা শূনকদের হাতে নিশ্চিহ্ন হয়, লােহার সিংহ দরজা ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। সেখানে খােলা আকাশের মুক্ত আলাে দেখে অচলায়তনিকরা বিস্মিত হলেও পরে আনন্দে নেচে ওঠে। তারা চারদিক থেকে আলাে আসতে দেখেছে, পাখির গান শুনতে পেয়েছে, যার শব্দ তাদের আয়তনের পােষা ময়নার শেখানাে বুলির মতাে একেবারেই নয়। অচলায়তনের। প্রাচীর ভেঙে পড়ায় আনন্দে তাদের ছুটতে ইচ্ছে করছে কারণ আজ তাদের কোনাে নিয়ম মানতে হবে না, মন্ত্র পাঠ করতে হবে না। এতদিনে তাদের প্রকৃত ছুটি হয়েছে, আকাশ-আলাের মধ্যে তাদের যথার্থ মুক্তি ঘটেছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘গুরু’ নাটকে প্রাণচঞল চরিত্র পঞক এই কথাটি বলেছে। অচলায়তন একটি শিক্ষা সম্বন্ধীয় আশ্রমের নাম যেখানে কেবলমাত্র উচ্চশ্রেণির সন্তানেরাই শিক্ষাগ্রহণের সুযােগ পায়। নিয়মনীতির বেড়াজালে সেই আয়তন এতটাই আবদ্ধ হয়ে পড়েছে যে, বাইরের আলাে বা খােলা হাওয়া দেখলে এরা ভয় পায়, তাই একে অচলায়তন নাম দেওয়া হয়েছে। যাকে আদর্শ করে এই আয়তন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই গুরুর আগমন বার্তায় আশ্রমের সকল সদস্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। বালকদের কারও মনে ভয়, কারও মনে জেগে উঠেছে পুলক। তখনই এক বালক এই কথাটি বলে উঠেছে যা শুনে মনে হয় গুরু সম্পর্কে তাদের কোনাে ধারণাই জন্মায়নি।

আশ্রমের নিয়মবদ্ধ জীবন থেকে পঞ্চক একটু আলাদা। সে এসব নিয়মের বিন্দুমাত্র তােয়াক্কা করে না। কারণ সে এগুলিকে একেবারেই বিশ্বাস করে না। গুরুকে সেও দেখেনি। তবে তার ধারণা গুরু বিশাল, মহৎ। তাই তাকে এই ক্ষুদ্র আশ্রমের ঘেরাটোপে ধরবে না। তার ধারণা গুরু এলে তাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তাদের জীবনের সঠিক পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। গুরুর আগমন ঘটবে সকল বাধাবিঘ্ন ছিন্ন করে মুক্ত পথে আনন্দের পসরা বয়ে। তাই তাঁকে মানুষের ক্ষুদ্র সংস্কারাচ্ছন্ন মনে ধরে রাখা যাবে না।

“অচলায়তনে এবার মন্ত্র ঘুচে গান আরম্ভ হবে।” -মন্ত্ৰ ঘুচে গান বিষয়টি ব্যাখ্যা করাে।

“আমাদের সমস্ত লাভ সমাপ্ত, সমস্ত সঞ্চয় পর্যাপ্ত।” বক্তার এই মন্তব্যের কারণ কী?

“আমাদের সমস্ত লাভ সমাপ্ত, সমস্ত সঞ্চয় পর্যাপ্ত।” বক্তার এই মন্তব্যটি কতটা সমর্থনযোগ্য বলে তুমি মনে কর?

“আমি তার কান্না আমার বুকের মধ্যে করে এনেছি।” -বক্তা কে? কোন্ প্রসঙ্গে কাকে উদ্দেশ্য করে বক্তা একথা বলেছেন? এই বক্তব্যের মধ্যে বক্তার চরিত্রের কোন দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে?

সুভদ্রের উত্তর দিকের জানলা খােলা অচলায়তনে কোন প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল?

“পৃথিবীতে জন্মেছি পৃথিবীকে সেটা খুব কষে বুঝিয়ে দিয়ে তবে ছাড়ি।”- মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করাে।

“পৃথিবীতে জন্মেছি পৃথিবীকে সেটা খুব কষে বুঝিয়ে দিয়ে তবে ছাড়ি।”—মন্তব্যটি শুনে শ্রোতার মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?

“উনি গেলে তােমাদের অচলায়তনের পাথরগুলাে সুদ্ধ নাচতে আরম্ভ করবে, পুথিগুলাের মধ্যে বাঁশি বাজবে।” -মন্তব্যটির তাৎপর্য আলােচনা করাে।

“যিনি সব জায়গায় আপনি ধরা দিয়ে বসে আছেন তাঁকে একটা জায়গায় ধরতে গেলেই তাঁকে হারাতে হয়।” মন্তব্যটির মর্মার্থ আলােচনা করাে।

“আজ কোনাে নিয়ম রক্ষা করা চলবে বলে বােধ হচ্ছে না।”- কেন এই দিনে নিয়ম রক্ষা করা সম্ভব নয় বলা হয়েছে?

“ও আজ যেখানে বসেছে সেখানে তােমাদের তলােয়ার পৌঁছােয় না।” -সেখানে তলােয়ার না পৌঁছানাের কারণ কী?

“খােলা জায়গাতেই সব পাপ পালিয়ে যায়।” -মন্তব্যটির মধ্য দিয়ে বক্তা কী বােঝাতে চেয়েছেন?

“দুজনে মিলে কেবলই উত্তর দক্ষিণ পুৰ পশ্চিমের সমস্ত দরজা জানলাগুলাে খুলে খুলে বেড়াব।” -বক্তা এই মন্তব্য করেছেন কেন?

“পঞ্চকদাদা বলেন অচলায়তনে তাঁকে কোথাও ধরবে না।” -মন্তব্যটির প্রসঙ্গ ও তাৎপর্য আলােচনা করাে।

“…তফাতটা এই যে, তােমরা বােঝা বয়ে মর, আমি হালকা হয়ে বসে আছি।” -বক্তা এই মন্তব্যটির মধ্যে দিয়ে কী বােঝাতে চেয়েছেন?

“অচলায়তনে এবার মন্ত্র ঘুচে গান আরম্ভ হবে।” -অচলায়তনে মন্ত্রের প্রভাব কেমন ছিল?

“তােমার জয়জয়কার হবে সুভদ্র। তিনশাে পঁয়তাল্লিশ বছরের আগল তুমি ঘুচিয়েছ।”- এই কথার মধ্যে দিয়ে বক্তা কী বােঝাতে চেয়েছেন?

“তুচ্ছ মানুষের প্রাণ আজ আছে কাল নেই, কিন্তু সনাতন ধর্মবিধি তাে চিরকালের।”- এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে বক্তা কী বােঝাতে চেয়েছেন?

“…নিয়ে এস হৃদয়ের বাণী। প্রাণকে প্রাণ দিয়ে জাগিয়ে দিয়ে যাও।”- মন্তব্যটির প্রসঙ্গ ও তাৎপর্য আলােচনা করাে।

“তােমাদের হাতে দিয়ে আমার যে শান্তি আরম্ভ হল তাতেই বুঝতে পারছি গুরুর আবির্ভাব হয়েছে।” -মন্তব্যটির মাধ্যমে বক্তা কী বােঝাতে চেয়েছেন?

“কিন্তু দেখছি হাজার বছরের নিষ্ঠুর মুষ্টি অতটুকু শিশুর মনকেও চেপে ধরেছে, একেবারে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিয়েছে রে।” – বক্তা এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে কী বলতে চেয়েছেন?

“পৃথিবীতে জন্মেছি পৃথিবীকে সেটা খুব কষেবুঝিয়ে দিয়ে তবে ছাড়ি।” -বক্তার এই মন্তব্যের তাৎপর্য আলােচনা করাে।

“এমন জবাব যদি আর-একটা শুনতে পাই তা হলে তােদের বুকে করে পাগলের মতাে নাচব…”— এ কথা বলার মধ্যে দিয়ে বক্তা কী বােঝাতে চেয়েছেন?

“তাকে বাঁধছি মনে করে যতগুলাে পাক দিয়েছি সব পাক কেবল নিজের চার দিকেই জড়িয়েছি।”— মন্তব্যটির তাৎপর্য আলােচনা করাে।

“তুমি যে আমার সঙ্গে লড়াই করবে— সেই লড়াই আমার গুরুর অভ্যর্থনা।”—বক্তা এই কথার মধ্যে দিয়ে কী বােঝাতে চেয়েছেন?

‘গুরু’ নাটকে ‘গুরু’-র ভূমিকাটি বিশ্লেষণ করাে।

একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কীভাবে ‘অচলায়তন’ হয়ে ওঠে?