যে-কোনাে শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। স্বাধীনতার পরে ভারতে যে পাঠক্রম প্রচলিত ছিল, তাই শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধনে ব্যর্থ হওয়ায় মুদালিয়র কমিশন (১৯৫২-৫৩ খ্রি.) উচ্চতর মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সাতটি প্রবাহের সুপারিশ করে। এই সাতটি প্রবাহ হল—
- প্রচলিত কলা বিভাগ (Humanities),
- বিজ্ঞানমূলক বিষয়সমূহ (Science),
- কারিগরি বা যন্ত্রবিজ্ঞান (Technical),
- বাণিজ্যিক (Commercial),
- কৃষি বিভাগ (Agriculture),
- চারুকলা (Art and Craft),
- গার্হস্থ্য বিজ্ঞান।
উপরোক্ত সাতটি বিভাগ থেকে যে-কোন একটি বিভাগের অন্তর্গত যে-কোনাে তিনটি বিষয় নির্বাচন করে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণ করতে পারবে। এই সাতটি প্রবাহ উল্লেখ করে কমিশন আরও বলে যে, প্রচলিত পাঠক্রম শুধুমাত্র পুথি কেন্দ্রিক এবং অত্যন্ত সংকীর্ণ, ফলে তা কখনোই শিক্ষার্থীর চাহিদা পূরণ করতে সমর্থ নয়। তাই কমিশন এমন ধরনের পাঠক্রম প্রবর্তনের পক্ষে মতামত জানায় যে, পাঠক্রমে একাধিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে; যা সময় উপযােগী শুধু নয়, শিক্ষার্থীর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক এককথায় সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবে। এই সকল প্রচেষ্টার অন্তরালে ছিল প্রচলিত সেই সময়ের ত্রূটিপূর্ণ শিক্ষা পাঠ্যক্রম যেগুলো এই মুদালিয়র কমিশন নিম্নলিখিত ভাবে চিহ্নিত করে—
(১) বৈচিত্র্যহীন পাঠক্রম: কমিশনের মতে, প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রম পুথিকেন্দ্রিক, যান্ত্রিক এবং বৈচিত্র্যহীন। বাস্তব জীবনের সঙ্গে এই পাঠক্রমের কোনো যোগ নেই। তাই এই শিক্ষা গ্রহণে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ পায় না।
(২) ত্রূটিপূর্ণ শিক্ষাদান পদ্ধতি : প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষার শিক্ষাদান পদ্ধতি নিষ্প্রাণ এবং মনোবৈজ্ঞানিক নয়। এখানে শিক্ষার্থীদের স্মৃতিশক্তি চর্চার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়।
(৩) ব্যক্তিত্ব বিকাশে অসমর্থ : প্রচলিত মাধ্যমিক স্তরের পাঠক্রম শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক নয়, কারণ এখানে ব্যবহারিক শিক্ষার বিশেষ কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
(৪) বয়ঃসন্ধিকালের চাহিদা পূরণে অক্ষম : বয়ঃসন্ধিকালে শিক্ষার্থীদের দেহ-মনে অভাবনীয় কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এর ফলে তাদের মধ্যে নানারূপ চাহিদার সৃষ্টি হয়। প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রম শিক্ষার্থীদের ওই চাহিদাপূরণে অসমর্থ ছিল।
(৫) ত্রূটিপূর্ণ মূল্যায়ন ব্যবস্থা : প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষার পরীক্ষা ব্যবস্থা রচনা ধর্মী এবং মুখস্থ ভিত্তিক। বছরে দুটি বা একটি পরীক্ষার ফলের দ্বারা শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মূল্যায়ন হয় না।
উচ্চবিদ্যালয় বা উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর চাহিদা, রুচি, যোগ্যতা, প্রবণতা অনুযায়ী বহুমুখী বিষয় থেকে কয়েকটি বিষয় হবে মূল বিষয় এবং কয়েকটি হবে ঐচ্ছিক বিষয়। মূল বিষয়গুলি সকলকেই গ্রহণ করতে হবে। ছাত্ররা তাদের ব্যক্তিগত রুচি এবং প্রবণতা অনুযায়ী ঐচ্ছিক বিষয়গুলি নির্বাচন করবে। কমিশন উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলির জন্য যে পাঠ্যবিষয় নির্ধারিত করেছে তা দুটি ভাগে বিভক্ত—
(A) মূল বিষয় :
(১) ভাষা শিক্ষা : ভারতে সর্বস্থানে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হবে আঞ্চলিক ভাষা বা মাতৃভাষা বা প্রাচীন ভাষা। নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে ২টি ভাষা শিখবে।(এছাড়া নিচে প্রদত্ত ভাষা তালিকা থেকে যে কোনো একটি )। নিম্ন বুনিয়াদি স্তরে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা দুটি শিখবে তবে একটি বছরের মধ্যে ২টি ভাষা শেখানো যাবে না। যারা আগে ইংরেজি পড়েনি তাদের জন্য প্রাথমিক ইংরেজি ভাষা শেখাতে হবে এবং হিন্দি বাদে একটি ভারতীয় ভাষা শেখাতে হবে। একটি ইউরোপীয় ভাষা শিখাতে হবে (ইংরেজি বাদে)।
(২) সাধারণ বিজ্ঞান এবং গণিত : প্রথম দুই বছর ব্যাপী শিখতে হবে।
(৩) সমাজবিজ্ঞান : এটি সাধারণ পাঠ হিসেবে প্রথম দুবছরের জন্য গণ্য হবে।
(৪) হস্তশিল্প : কাঠের কাজ, টাইপের কাজ, দর্জির কাজ, সূচিশিল্প ইত্যাদি হস্তশিল্পি বাছাই করে শেখানো হবে।
(B) ঐচ্ছিক বিষয় :
নিম্নলিখিত বিভাগগুলির যে-কোনাে একটি এবং ওই বিভাগের অন্তর্গত যে-কোনাে তিনটি বিষয় শিক্ষার্থীরা নির্বাচন করতে পারবে এবং তা গ্রহণ করতে পারবে। এই বিভাগগুলি হল— (১) প্রচলিত কলা বিভাগ, (২) বিজ্ঞান বিভাগ, (৩) কারিগরি বিভাগ, (৪) বাণিজ্য বিভাগ, (৫) কৃষি বিভাগ, (৬) চারুকলা বিভাগ এবং (৭) গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বিভাগ।
(উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলি ছাড়া আরও একটি অতিরিক্ত বিষয় শিক্ষার্থীরা নিতে পারবে।)
তবে এই সকল নীতি নির্ধারণের পর কমিশন বলেছেন পাঠক্রম ভালো হলেই শুধু হবে না তার জন্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ভঙ্গির প্রয়োজন, এই দৃষ্টিভঙ্গি এই সকল নীতি এর সঠিক প্রয়োগ মাধ্যমে সাফল্য আনবে।
Leave a comment