প্রশ্নঃ ‘পসকনিসপ্রবা’ (POSDCORB) কাকে বলে? পসকনিসপ্রবা’র গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা কর। 

পসকনিসপ্রবা (POSDCORB): লুথার এইচ. গুলিক সকল প্রশাসনিক সংগঠনের কর্মকাণ্ড বিশেষ করে তাদের ব্যস্থাপনা কর্মকাণ্ডের বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করার জন্য এ সংক্ষিপ্ত শব্দসমূহ ব্যবহার করেছেন। তিনি “Notes on the Theory of Organigation” নামক গ্রন্থে ১৯৩৭ সালে তার প্রবন্ধে “President’s Committee on Government Reorganigation” যা এর সভাপতি লুইস ব্রাউনলোর নামানুসারে ব্রাউনলো কমিটি (Brownlow Committee) নামে খ্যাত। তাতে গুলিক একজন প্রশাসনিক সংস্থার প্রধান নির্বাহীর সাতটি প্রধান কাজ ব্যাখ্যা করেন। এই সাতটি কাজ ‘পসকনিসপ্রবা’ (POSDCORB)-এর মাধ্যমে তুলে ধরেন। গুলিক এক্ষেত্রে হেনরী ফেয়ল (Henri Fayol) এবং লিন্ডাল উরউইক (Lyndall Urwick) দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। ফেয়ল ছিলেন একজন ফরাসি খনি প্রকৌশলী (১৮৪১-১৯২৫), আর উরউইক ছিলেন একজন ব্রিটিশ শিল্প প্রকৌশলী। গুলিক এ দু’জনের সমন্বয়ে ১৯৩৭ সালে “Papers on the Science of Administration” রচনা করেন।

পসকনিসপ্রবা’র গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ প্রশাসনিক সংগঠন ও ব্যবস্থাপনায় লুথার গুলিক-এর ‘পসকনিসপ্রবা’ (POSDCORB)- এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। বিভিন্ন দিক থেকে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য উল্লেখের দাবি রাখে।

প্রথমত, একদিক থেকে গুলিকের ‘পসকনিসপ্রবা’-এর আবেদন ম্যাক্স ওয়েবারের আদর্শ-প্রকৃতির আমলাতন্ত্রের চেয়ে অধিক সুনির্দিষ্ট; অপরদিকে ফ্রেডারিক ডব্লিউ টেলরের সাংগঠনিক কর্মফলাফলের উপর গুরুত্বারোপ থেকে সাধারণ প্রকৃতির। আসলে এর লক্ষ্য হচ্ছে প্রশাসনিক তত্ত্বের নীতিমালাকে প্রশাসন ব্যবস্থায় বাস্তব রূপ দেয়া।

দ্বিতীয়ত, ‘পসকনিসপ্রবা’–এর মৌল উদ্দেশ্য হচ্ছে কিভাবে সংগঠনের কাঠামোকে আরও বেশি সুগঠিত করা যায় এবং নির্বাহীদের ভূমিকাকে কিভাবে অধিকতর স্পষ্ট করে বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করা যায় সেদিকে সচেষ্ট হওয়া।

তৃতীয়ত, এর মাধ্যমে স্টাফ কর্মকাণ্ডকে লাইন কর্মকাণ্ডের জন্য অধিক পরিমাণে সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদর্শন করা সহজতর হয়। ফলে প্রশাসনিক সংগঠনের যাবতীয় কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন হতে পারে।

সাম্প্রতিককালে গুলিক নির্দেশিত ‘পসকনিসপ্রবা’-এর সমালোচনা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, বিশ্লেষণের হাতিয়ার হিসেবে আধুনিক সংগঠনে যত ধরনের স্টাফ কর্ম বা নির্বাহী কর্ম সম্পাদিত হয়ে থাকে তার সবগুলো ‘পসকনিসপ্রবা’–এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, উপাত্তসমূহের প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং মূল্যায়ন এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কাজেই এটি যথেষ্ট ব্যাপক (Comprehensive) নয়।

কোন কোন সমালোচক এমনও বলেন যে, গুলিক-এর পরিকল্পনায় নেতৃত্বের অবমূল্যায়ন (Undervalued) করা হয়েছে।

যা হোক, ‘পসকনিসপ্রবা’- এর কিছু কিছু ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এর গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। গুলিক যখন এ ধারণা প্রদান করেন সে সময় ও প্রেক্ষাপটে তা সত্যিই ছিল এক অভিনব ধারণা। এটি সনাতন সংগঠনের মধ্যে বাস্তবতার ছোঁয়া দেন এবং প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনাকে শিক্ষানবিসদের জন্য সরল সহজ ও বোধগম্য করে তোলেন। এর নানাবিধ অন্তর্মুখিতা সত্ত্বেও বিভিন্ন সরকারি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে এর ক্রমবর্ধমান প্রভাব দিন দিনই বেড়ে চলেছে এবং অনেক বেশি পরিমাণে স্বীকৃতি পেয়ে চলেছে। 

চ্যান্ডলার এবং প্ল্যানো (Chandler and Plano)- এর সাথে সুর মিলিয়ে আমরাও বলতে চাইঃ “POSDCORB served as a convenient starting point for a generation of writers interested in dealing with different expects of administration. They added to, subtracted from, and amended the acronym to meet their needs. POSDCORB was indeed a seminal idea. [The Public Administration Dictionary, John Wiley & Sons. N. Y. 1982. P. 216]

অধ্যাপক ফিার এবং প্রেসথাস (Pfiffner and Presthus) লোক প্রশাসন পাঠের তিনটি উপায়ের সাথে আমাদেরকে পরিচিত করতে চেয়েছেন। 

প্রথমত, শাসনতান্ত্রিক— আইনগত ঐতিহাসিক উপায় (Constitutional- legal-historical Approah)— যা আইনগত উপায়টা নিয়ে নামার অধিকার ও কর্তব্যের উপর নির্ভরশীল এবং যা শাসনতান্ত্রিক বিধান. বা নজির হতে সৃষ্ট এবং যা আইনগত মতামত এবং সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তবে এ পদ্ধতি লোক প্রশাসন সম্পর্কে অতি ক্ষুদ্ৰ ধারণা প্রদান করে; কারণ এটি লোক প্রশাসনকে সরকারি আইনের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করে। 

দ্বিতীয়ত, সাংগঠনিক-বর্ণনামূলক উপায় (Structural- Descriptive Approach)— যা সংগঠনের গঠন প্রণালী, সরকারি কর্মচারীবৃন্দের ব্যবস্থাপনা, অর্থ প্রশাসন প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে। লোক প্রশাসন পাঠের এ উপায়টি উদ্ভাবন করেন এল.ডি.হোয়াইট (L.D.White) যখন তিনি প্রশাসনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ব্যাখ্যা দান করেন। 

তৃতীয়ত, সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক উপায় (Socio- Psychological Approach)— যা সাম্প্রতিককালে লোক প্রশাসন পাঠে ব্যহৃত হচ্ছে। এ সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক উপায়টির ক্ষেত্র ব্যবহারিক বা আচরণগত বিজ্ঞানের (Behavioural Science) প্রসারের সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোন প্রশাসনিক সংগঠনের সাথে সম্পর্কযুক্ত মানুষের আচার-আচরণ নিয়ে আলোচনা করাই এর প্রধান কাজ। লোক প্রশাসনের এ পদ্ধতি সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাবিদ এবং সামাজিক মনস্তাত্ত্বিকবিদদের ক্রিয়াকলাপ হতে উদ্ভূত হয়েছে। এ পদ্ধতি প্রশাসনের বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করতে সচেষ্ট থাকে।

ডোয়াইট ওয়াল্ডো (Dweight Waldo) লোক প্রশাসনকে অতি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, “সরকারের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য লোক এবং উপকরণসমূহের সংগঠন ও ব্যবস্থাপনার নাম লোক প্রশাসন।” (Public Administration is the organization and management of man and materials to realise the purpose of government.) ডোয়াইট ওয়াল্ডোর এ সংজ্ঞায় লোক প্রশাসনের সঠিক অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় এবং এতে যথেষ্ট বাস্তবতার ছাপ পরিলক্ষিত হয়। তথাপি লোক প্রশাসনের এ সংজ্ঞাকে অধুনা অপর্যাপ্ত বলে গণ্য করা হয়।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ হতে এ কথা স্পষ্টতই বলা যায় যে, লোক প্রশাসনের অধিকাংশ শিক্ষাগত পাঠ সরকারি আইন (Public Law) হতে উদ্ভূত অর্থাৎ সরকারি নিয়মাবলি যা বাইরের জগতের সাথে প্রশাসকদের সম্পর্ক নির্ধারণ করে। এটি লোক প্রশাসন পাঠের একটি অতি প্রয়োজনীয় দিক। লোক প্রশাসকগণ সরকারি আইনমাফিক কাজ করেন এবং তা কার্যকর, উন্নতি বিধান এবং বিধিবদ্ধ করার কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু কেবলমাত্র সরকারি আইন (Public Law) দ্বারা লোক প্রশাসনের প্রকৃত ব্যাখ্যা প্রদান করা সম্ভব নয়।

যে কোন সরকার ব্যবস্থায় লোক প্রশাসন একটি জটিল ব্যাপার। প্রথমত, যে ব্যক্তিবর্গ নিয়ে প্রশাসন ব্যবস্থা গঠিত তাদের মাধ্যমে প্রশাসন ব্যবস্থাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়, যেমন— কয়েক লক্ষ কর্মচারী; জনগণকে নিয়ে গঠিত দলের মাধ্যমে, যেমন— অর্থনীতিবিদগণ, রাজনীতিবিদগণ, শিক্ষক শ্রেণী, প্রশাসনিক কর্মচারী শ্রেণী; সংগঠনের মাধ্যমে, যথা— বিভিন্ন বিভাগ এবং সংস্থা, শাখা ও ইউনিট; আইনগত কাঠামোর মাধ্যমে, যেমন— শাসনতন্ত্র, সংবিধি এবং নির্বাহী আদেশ এবং সর্বোপরি এর পদ্ধতির মাধ্যমে, যেমন— উন্নত ব্যবস্থাপনা, কর্মচারী শ্রেণী বিভক্তিকরণ এবং হিসাব নিয়ন্ত্রণ। উপরন্তু, প্রশাসকগণ আইন ও গণসংযোগ, কর্মসূচির উদ্দেশ্য, চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী, জন সমর্থন, সামাজিক উদ্দেশ্য প্রভৃতির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। আর এগুলো সবই লোক প্রশাসনের অংশবিশেষ।

এছাড়া লোক প্রশাসন পাঠের অন্যান্য উপায়গুলোও অনুরূপভাবে প্রয়োজনীয়। কর্মচারীবৃন্দ অর্থাৎ সরকারি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ প্রশাসনের কার্যকারিতার জন্য একান্ত অপরিহার্য। প্রশাসন ব্যবস্থা সর্বদাই ব্যক্তিবর্গকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে। যেহেতু তারা সকলেই সমাজের সৃষ্টি এবং সমাজ তাদের আচার-আচরণে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে, সেহেতু এটি আজ প্রয়োজনীয় যে, প্রশাসন ব্যবস্থা সমাজের ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিটি প্রশাসকের লোকগত আচার-আচরণ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক, কেননা প্রশাসনিক কাজ নির্ধারণে তাদের লোকত্ব এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সংগঠন (Organization), কর্মদক্ষতা এবং আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মে নিয়োগ লোক প্রশাসনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোন কোন লেখকের মতে, সরকারি কাজের পূর্ণ ব্যাখ্যা সংগঠনের চার্ট হতে লাভ করা যায়। এটি প্রশাসনিক সংগঠনের কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক দিক। এছাড়া প্রত্যেক আনুষ্ঠানিক সংগঠনের (Formal Organization) মধ্যে কিছু সংখ্যক রীতিবিরুদ্ধ বা অনিয়মিত দল (Informal Groups) বা সংস্থা, অনিয়মিত সম্পর্ক এবং কর্মাভ্যাস গড়ে উঠে, তাদের অনিয়মিত সংগঠন (Informal Organization) বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, প্রত্যেক নিয়মিত সংগঠনের মধ্যে অনিয়মিত সংগঠনের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে।

তদুপরি, ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিও (Techniques of Management) লোক প্রশাসনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক, যাকে প্রশাসনের সর্বস্ব বলা যেতে পারে। সরকারি কাজের দ্রুত প্রসার এবং জটিলতার সাথে সাথে ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির গুরুত্বও যথেষ্ট পরিমাণে বেড়ে চলেছে।

আবার লোক প্রশাসনকে একটি প্রক্রিয়া (Process) এবং রাজনৈতিক বিষয় (Politics) বলে উল্লেখ করা যায়। পরিবর্তন ও ক্রমোন্নতি সব সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ধর্ম। লোক প্রশাসন যেহেতু সমাজ এবং সমাজের মানুষকে নিয়ে আলোচনা করে, মানুষের সৃষ্ট আইনের অধীনে কাজ করে এবং মানুষের প্রয়োজন মিটায়, সেহেতু অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান হতে এটি কোন প্রকার ব্যতিক্রম নয়। সুতরাং লোক প্রশাসনকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে এর পরিবর্তনশীল চরিত্র (Dynamic character) সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। হ্যারল্ড স্টেইন (Harold Stein)- এর ভাষায় বলতে হয়, “Insight into public administration requires an awareness of its dynamic character.” [Stein. H., Public Administration and Policy Development, p. 3.]

বিভিন্ন প্রশাসনিক সংগঠনের কাজ ও ক্ষমতা বিভক্ত করে দেওয়া, এদের অভ্যন্তরীণ সব রাজনৈতিক সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি করা এবং ঐসব সমস্যাদির সমাধান খুঁজে বের করা লোক প্রশাসনের অন্যতম কাজ। হ্যারল্ড স্টেইন (Harold Stein) বলেছেন, “The concept of Public Administration as politics is designed particularly to refer to the administrator’s understanding and pursuit of his objectives and his relations with the social environment outside his agency that affects or is capable of affecting its operations.” 

এভাবে আমরা দেখি যে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হতেই লোক প্রশাসনের সূচনা হয়।