ভূমিকা: রাজ্য সচিবালয়ের প্রশাসনিক-প্রধান হিসেবে মুখ্যসচিব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রত্যেক রাজ্যে যেমন একটি স্থায়ী সচিবালয় থাকবে, প্রশাসনে নিরবচ্ছিন্নতা বা ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য এবং সচিবালয়কে পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের জন্য প্রশাসনিক-প্রধান হিসেবে মুখ্যসচিবের একটি কার্যালয় থাকবে। মুখ্যসচিব হলেন সচিবালয়ের এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও অপরিহার্য উপাদান, যাকে ব্যতিরেকে সচিবালয়ের পরিচালনা কল্পনা করা সম্ভব নয়।
রাজ্য মুখ্যসচিবের মনােনয়ন: রাজ্য সচিবালয়ের মুখ্যসচিবকে মনােনীত করেন মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী। প্রয়ােজনে মুখ্যমন্ত্রী মুখ্য সচিব নিয়ােগের পূর্বে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য ক্যাবিনেট সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন। তবে এইরূপ পরামর্শ করতে মুখ্যমন্ত্রী বাধ্য নন। সাধারণভাবে দেখা যায়, মুখ্য সচিব পদে নিয়ােগের ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। অঙ্গরাজ্যের মুখ্যসচিবের ভারতীয় জনপালনকৃত্যক (আইএএস) সদস্যদের মধ্য থেকে নিয়োগ করা হয়।
মুখ্যসচিবের ক্ষমতা ও কার্যাবলি
(1) মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান পরামর্শদাতা: রাজ্য সচিবালয়ের মুখ্যসচিব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান পরামর্শদাতারূপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাজ্য প্রশাসনের যে-কোনাে নীতি সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে মুখ্যমন্ত্রী প্রথা অনুসারে মুখ্যসচিবের সঙ্গে পরামর্শ করে থাকেন।
(2) মন্ত্রী পরিষদের সচিব: মুখ্য সচিব রাজ্য ক্যাবিনেটের তথা মন্ত্রীসভার সচিব হিসেবে কাজ করেন। মন্ত্রীপরিষদে মুখ্য সচিব যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলি পালন করে থাকেন সেগুলি হল মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলােচনার মাধ্যমে মন্ত্রীসভার বৈঠকের জন্য আলােচ্য বিষয়সূচি প্রস্তুত করা, সভার কার্যবিবরণী প্রস্তুত করে তা নথিভুক্ত করা, ক্যাবিনেট সাব-কমিটি গুলিকে সাহায্য করা ইত্যাদি।
(3) সচিবালয়ের সামগ্রিক তত্ত্বাবধায়ক: মুখ্যসচিবের উপর রাজ্যের সকল সচিবালয়ের সাধারণ তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মীদের বদলি বিষয়ে তার কার্যকরী ভূমিকা লক্ষ করা যায়। তা ছাড়াও কেন্দ্রীয় নথি সংরক্ষণের কর্মী, সচিবালয়ের গ্রন্থাগারের কর্মী, নিরাপত্তা বিভাগ ও অন্যান্য শ্রেণির কর্মীদের উপর মুখ্য সচিব নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা প্রয়ােগ করে থাকেন।
(4) রাজ্য প্রশাসনের প্রধান সমন্বয়কারী: মুখ্যসচিবের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল রাজ্যের শাসন সংক্রান্ত নীতি ও সরকারি পরিকল্পনাগুলির মধ্যে সমন্বয়সাধন ঘটানাে। রাজ্য সরকারের সকল বিভাগের মধ্যে সহযােগিতা বৃদ্ধির জন্য মুখ্য সচিব সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকেন। সচিবালয়ে যেসকল সচিব নিযুক্ত থাকেন তাদের প্রধান রূপে মুখ্য সচিব বিভাগীয় কমিটিগুলির সভায় সভাপতিত্ব করে থাকেন। প্রশাসনিক সমন্বয়কারীরূপে মুখ্যসচিবের হাতে যেসব দায়িত্ব রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয়, আন্তঃরাজ্য সমন্বয়, সচিবালয়ের বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়, রাষ্ট্রকৃত্যকের আধিকারিকদের সঙ্গে মন্ত্রীদের সমন্বয় ইত্যাদি।
(5) মুখ্যসচিব হলেন রাজ্য রাষ্ট্রকৃত্যকের প্রধান: রাজ্য রাষ্ট্রকৃত্যকের প্রধান হিসেবে মুখ্যসচিব খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। প্রশাসনিক সংস্কার কমিটির মতে, মুখ্যসচিব সচিবালয়ের যেসকল কর্মীদের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তারা হলেন রাজ্য সচিবালয়ের সচিবগণ, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সর্বভারতীয় কৃত্যকের আধিকারিকবৃন্দ (আই এ এস), রাজ্য রাষ্ট্রকৃত্যকের আধিকারিকগণ ও অন্যান্য সরকারি কর্মচারীবৃন্দ। বলাবাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনকাঠামাের মধ্য থেকে মুখ্যসচিব পর্যায়ক্রমে আঞ্চলিক পরিষদের সচিবের দায়িত্বও পালন করে থাকেন।
(6) জরুরিকালীন অবস্থায় প্রশাসনের প্রধান পরিচালক: রাজ্যে জরুরিকালীন অবস্থা বা ৩৫৬ নং ধারা অনুসারে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থাজনিত পরিস্থিতিতে মুখ্যসচিবের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাজ্যপাল যখন রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধিরূপে রাজ্য শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন রাজ্য প্রশাসনের যাবতীয় কাজকর্ম মুখ্যসচিবের নির্দেশে পরিচালিত হয়। বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ বা অন্য কোনাে প্রাকৃতিক দুর্যোগে অথবা কোনাে সংকটকালীন পরিস্থিতিতে সমগ্র রাজ্য প্রশাসনকে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করার দায়িত্ব মুখ্য সচিব পালন করে থাকেন।
ড. এস আর মাহেশ্বরীর ভাষায়, জরুরি পরিস্থিতিতে বা সংকটকালীন সময়ে মুখ্য সচিব রাজ্যের স্নায়ু কেন্দ্র রূপে কাজ করেন (“In times of emergency crisis he constitutes the nerve centre of the state.“)!
মুখ্যসচিবের পদমর্যাদা
প্রথমে মুখ্য সচিব কিন্তু সর্বোচ্চ বা প্রধান আধিকারিকরূপে চিহ্নিত হননি। মূলত ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে মুখ্যসচিবকে কেন্দ্রীয় মুখ্যসচিবের মতাে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মুখ্য সচিব গন পারস্পরিক স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন হয়ে সচিবের ডাকা বিভিন্ন সভা ও সম্মেলনে উপস্থিত হন। মুখ্যসচিব বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রের সঙ্গে প্রশাসনিক যােগসূত্রকারক হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকেন। রাজ্য প্রশাসনিক ব্যবস্থায় মুখ্যসচিবের ক্ষমতা ও পদমর্যাদা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
উপসংহার: রাজ্যের মুখ্যসচিবের ভূমিকা ও পদমর্যাদা বিশ্লেষণ করে স্পষ্টতই বােঝা যায় যে, রাজ্য প্রশাসনে সর্বোচ্চ পদাধিকারী কে মুখ্যসচিবের পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্য প্রশাসন পরিচালনায় তার অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে। রাজ্য সরকারের সাফল্য অনেকাংশে মুখ্যসচিবের ইতিবাচক ভূমিকার উপর নির্ভরশীল। মুখ্যসচিবের উপরোক্ত ভূমিকা পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয় যে, অঙ্গরাজ্যের মুখ্য সচিব কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবের সমান ক্ষমতা ও পদমর্যাদা ভােগ করে থাকেন।
Leave a comment