অথবা, ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশী যুদ্ধের পটভূমি বিশ্লেষণ কর।
উপস্থাপনাঃ ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত পলাশীর যুদ্ধ বাংলার ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের সূচনা করে। এ যুদ্ধে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়, অপরদিকে এদেশবাসীর চরম ভাগ্য বিপর্যয় আর ইংরেজ রাষ্ট্র শক্তির গােড়াপত্তন ঘটে। আর. সি. মজুমদার বলেন- The Battle of Polassey paned the wgy for British conquest for Bengal and eventually the whole of India.
পলাশী যুদ্ধের কারণসমূহঃ
১. রাজনৈতিক কারণঃ নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে নবাব সিরাজুদ্দৌলা বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত হন। এদিকে আলীবর্দী খানের প্রথম কন্যা ও ঢাকার প্রাদেশিক শাসনকর্তার বিধবা স্ত্রী ঘসেটি বেগম এবং পূর্ণিয়ার শাসনকর্তার পুত্র শওকত জঙ্গ নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
২. প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের সমর্থনদানঃ আলীবর্দী খানের কন্যা ঘসেটি বেগম, দৌহিত্র শওকত জঙ্গ সিরাজুদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ইংরেজদের সাথে আঁতাত করে। ফলে নবাব ইংরেজদের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন।
৩. কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয়দানঃ রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস প্রচুর ধনসম্পদসহ পালিয়ে কলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয় গ্রহণ করে। সিরাজুদ্দৌলা কৃষ্ণদাসকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি করলে ইংরেজরা তা অগ্রাহ্য করায় সিরাজের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে।
৪. অর্থনৈতিক কারণঃ ইংরেজরা বাণিজ্য সংক্রান্ত যেসব সুযােগ সুবিধা পেয়েছিল, তার অপব্যবহারে নবাবের অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে থাকে। নবাব সেসব সুযােগ। সুবিধা সংকুচিত করলে তারা সিরাজ বিদ্বেষী হয়ে ওঠে।
৫. ইংরেজদের উপঢৌকন প্রেরণে অনীহাঃ প্রচলিত প্রথানুযায়ী নতুন নবাবকে স্বীকৃতি প্রদানপূর্বক আনুগত্যের নিদর্শনসূচক উপঢৌকন দেয়ার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। অন্যান্য ব্যবসায়ীরা সে রেওয়াজ পালন করলেও ইংরেজরা তা থেকে বিরত থাকে। ফলে নবাব সিরাজুদ্দৌলা ইংরেজদের প্রতি ক্ষুব্ধ হন।
৬. বাণিজ্যিক সুবিধার অপব্যবহারঃ কোম্পানিকে প্রদত্ত বাণিজ্যিক সুবিধার অপব্যবহার করে কোম্পানি কর্মচারীরা ব্যক্তিগতভাবে সে সুবিধা গ্রহণপূর্বক বিনা শুল্কে ব্যবসায় শুরু করে। এর প্রতিবাদ করলে নবাবের সাথে ইংরেজদের বৈরিতা আরাে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৭. ইংরেজ কর্তৃক নবাবের দূত অপমানিতঃ ইংরেজদের কাসিম বাজার কুঠি পরিদর্শনের জন্য নবাব দূত নারায়ণ সিংকে পাঠালে এ দৃত রজার ড্রেক কর্তৃক অপমানিত হয়। এতে নবাব ইংরেজদের প্রতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে কাসিম বাজার কুঠি দখল করেন।
৮. কাল্পনিক অন্ধকূপ হত্যাঃ নবাবের চরিত্রকে কলঙ্কিত করার জন্য ইংরেজ লেখক ডাক্তার হলওয়েল কাল্পনিক অন্ধকূপ হত্যার আবিষ্কার করেন। তার মতে, নবাব কলকাতা দখলের সময় ১৮X১৪ একটি ক্ষুদ্র কক্ষে ১৪৬ জন ইংরেজকে আটকে রাখেন। ফলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ২৩ জন ছাড়া বাকি সবাই মারা যায়। ইতিহাসে এটাই Block hole tragedy তথা অন্ধকূপ হত্যা নামে পরিচিত। তবে ঐতিহাসিকগণ একে একটা মস্ত বড় ধাপ্পাবাজি এবং কাল্পনিক বলে মন্তব্য করেছেন।
৯. দুর্গ নির্মাণঃ ইংরেজরা সিরাজুদ্দৌলার আদেশ উপেক্ষা করে দুর্গ নির্মাণ শুরু করে। ফলে নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
১০. কলকাতা দখলঃ সিরাজুদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করলে ইংরেজ গভর্নর ও তার অনুচরগণ ভীত হয়ে পালিয়ে ফলতা নামক স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করে।
১১, কলকাতা পুনরুদ্ধারঃ ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ক্লাইভ সহজে কলকাতা পুনরুদ্ধার করেন। ফলে নবাব ইংরেজদের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেন।
১২. আলীনগর সন্ধি ভঙ্গঃ লর্ড ক্লাইভ ও নৌ-সেনাপতি ওয়াটসন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করলে নবাব অগত্যা ইংরেজদের সাথে এক সন্ধি সূত্রে আবদ্ধ হন। একে আলী নগরের সন্ধি বলে। তারপরও ইংরেজরা সন্ধি ভঙ্গ করে নবাবের বাধা সত্ত্বেও ফরাসিদের বাণিজ্য কেন্দ্র চন্দননগর দখল করে।
১৩. মীর জাফরের সাথে ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধ ঘােষণাঃ আলী নগরের সন্ধি ভঙ্গ করে ইংরেজরা মীর জাফরের সাথে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। যুদ্ধের ব্যয় ও ক্ষতিপূরণ বাবদ এক কোটি পঁচাত্তর লক্ষ টাকার প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ইংরেজরা মীর। জাফরকে বাংলার মসনদে বসানাের প্রতিশ্রুতি দেয়। এভাবে সর্বদিক থেকে ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতে ক্লাইভ সামান্য অজুহাতেই নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে।
পলাশী যুদ্ধের ঘটনাঃ উপরিউক্ত কারণসমূহের প্রেক্ষিতে ১৭৫৭ সালের ২২ জুন ক্লাইভের আগমনের খবর পেয়ে নবাব সিরাজুদ্দৌলা ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে পলাশীর প্রান্তরে উপস্থিত হন। ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী পলাশীর আমবাগানে ইংরেজ ও নবাবের বাহিনী পরস্পরের মুখােমুখি হয়। নবাবের সেনাপতি মীর জাফর, রায় দুর্লভ প্রমুখের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে ক্লাইভের ইংরেজ বাহিনী সামরিক শক্তিতে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও সহজেই জয় লাভ করে। এমনি বিয়ােগান্ত নাটকের মাধ্যমে ২৩ জুন সকাল ৮টায় পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। পরে নবাব বিহারের উদ্দেশ্যে পলায়নকালে রাজমহলের নিকট ধরা পড়েন এবং ২ জুলাই তাকে মুর্শিদাবাদে হত্যা করা হয়। নবাব সিরাজুদ্দৌলার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই বাংলা তথা ভারতবর্ষের মানুষ প্রায় দুই শতাধিক বছরের জন্য ইংরেজদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়।
পলাশী যুদ্ধের ফলাফলঃ
১. মুসলিম শাসনের অবসানঃ পলাশীর যুদ্ধ ৬ ঘণ্টা স্থায়ী হলেও এর প্রভাব ছিল লােমহর্ষক। কারণ এর ফলে ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে।
২. রাজনৈতিক ফলাফলঃ ঐতিহাসিক আর. সি. মজুমদার বলেন, পলাশী যুদ্ধের রাজনৈতিক ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। কারণ এ যুদ্ধে নবাবের পরাজয়ের ফলে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা তথা গােটা ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা সূর্য প্রায় দু’শ বছরের জন্য অস্তমিত হয়।
৩.মীর জাফরের ক্ষমতালাভঃ পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের ফলে ইংরেজদের তাবেদার বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর কিছু দিনের জন্য বাংলার মসনদে আরােহণ করে।
৪. ইংরেজদের হাতের পুতুলঃ এ যুদ্ধের ফলে মীর জাফর এবং তার পরবর্তী নবাবগণ ইংরেজদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়।
৫. কোম্পানির মর্যাদা বৃদ্ধিঃ পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজের পরাজয়ে ইংরেজ কোম্পানির মান-মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং তারা কৃপা অনুগ্রহ বিতরণের ক্ষমতা অর্জন করে।
৬. লুণ্ঠনের রাজত্ব কায়েমঃ পলাশী যুদ্ধ জয়ের ফলেই বক্সারের যুদ্ধে তারা নবাব শুজাউদ্দৌলাকে পরাজিত করতে সমর্থ হয়। পরিণামে ইংরেজ কর্মচারী এবং হিন্দু বেনিয়ারা মিলে এ দেশে লুণ্ঠনের রাজত্ব কায়েম করে।
৭. ব্যবসায়-বাণিজ্যে ইংরেজদের আধিপত্যঃ ব্যবসায়-বাণিজ্যে ইংরেজদের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলার শিল্প-বাণিজ্য ও বণিকদের সমাধি রচিত হয়। ঐতিহাসিকগণ বলেন- The bottle of Palassey may be truly said to have decided fate french in India.
৮. ফরাসিদের পরাজয়ঃ এ যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা দাক্ষিণাত্যে ফরাসিদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। তাছাড়া স্থানীয় বলিষ্ঠ মুসলিম শাসক হায়দার আলী এবং টিপু সুলতানকেও তারা পরাজিত করে।
৯. কোম্পানির পরগনা ও অর্থ লাভঃ এ যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাবের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ লাভ করে। এছাড়া নতুন নবাব কোম্পানিকে নগদ এক কোটি টাকা ও চব্বিশ পরগনা এলাকা দান করেন।
১০. যুগের পরিবর্তনঃ পলাশী যুদ্ধের ফলাফল পর্যালােচনা করে ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার একে শিক্ষা, সাহিত্য, সমাজ, ধর্ম ও রাজনীতিতে এক রেনেসাঁ বলে উল্লেখ করেন। কেননা পলাশী যুদ্ধের পর থেকে ভারতবর্ষের ইতিহাসে মধ্যযুগের অবসান ঘটে এবং আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয়।
১১. অন্যান্য ধ্বংসযজ্ঞঃ এ যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে অন্যান্য ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে রয়েছে- (ক) বিশ্বনন্দিত রেশম শিল্পের পতন ঘটে। (খ) বাংলা পরিণত হয় গ্লাসগাে ও ম্যানচেস্টারের বন্দি বাজারে। (গ) ভূমি নীতির ফলে সৃষ্টি হয় জমিদার ও মধ্যস্বত্ব শ্রেণি। (ঘ) রায়ত হয় জমিদারের করুণাপ্রার্থী ইত্যাদি।
উপসংহারঃ পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয় এবং বাংলায় ব্রিটিশ প্রভুত্বের সূত্রপাত ঘটে। ঐতিহাসিক আর, সি, মজুমদার বলেন- If pgved the way for British conquest for Bengal and eventually the whole of India.
Leave a comment