ধ্রুপদী উদারনীতিবাদের বিকাশের ধারা ব্যাহত হতে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে। এই সময় পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংকটের সৃষ্টি হয়। এই সংকট উদারনীতিবাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। মার্কসীয় দর্শনে উদারনীতিবাদকে বুর্জোয়া ব্যবস্থার ধারক ও বাহক হিসাবে অভিযুক্ত করা হয়। সমাজতন্ত্রবাদ, জনকল্যাণমূলক মতবাদ, সমাজকল্যাণের আদর্শ প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে উদারনীতিবাদের পরিমার্জন বা সংস্কার সাধনের দাবি উঠে। আচরণবাদী রাষ্ট্রদার্শনিকরা উদারনীতিবাদকে নতুন রূপে প্রতিপন্ন করতে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করেন। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার সমর্থক-প্রবক্তারা পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থার সমস্যাদির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে উদারনীতিবাদের সংস্কার সাধনের ব্যাপারে সক্রিয় হন। সাবেকি উদারনীতি ছিল নেতিবাচক। পরিমার্জিত নতুন উদারনীতি সদর্থক প্রকৃতি প্রাপ্ত হয়। গাউবা এ বিষয়ে বলেছেন: “Liberal theory, in later phase, was transformed from negative to positive liberalism.”

নেতিবাচক উদারনীতিবাদ উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে স্বীকার ও সমর্থন করেছে। তারফলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশ ও বিস্তার ঘটে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদের বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় জনসাধারণের মধ্যে অসাম্য-বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থায় শ্রমিক-কৃষক ও ভোক্তাদের উপর শোষণ-পীড়ন কায়েম হয়। মেহনতী মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের অভাব-অনটনও বাড়তে থাকে। দীন-দরিদ্র শ্রমজীবী জনতা প্রতিবাদে মুখর হয়। শ্রমিক শ্রেণীর সমস্যাদির সমাধানের ব্যাপারে সমাজতন্ত্রীরা চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। উদারনীতিবাদের সমর্থক-প্রবক্তারা এই সময় অনুধাবন করতে সমর্থ হন যে স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের উপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করার ফলে সমাজে শোষণ-পীড়নের সৃষ্টি হয়েছে। এ রকম অবস্থায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে উদারনীতিবাদের বক্তব্য পরিমার্জনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এবং বিংশ শতাব্দীতেও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়-তৃতীয় দশক থেকে উদারনীতিবাদ পরিমার্জিত নতুন রূপে প্রতীয়মান হয়। আধুনিক উদারনীতিবাদ স্বাধীনতা, মানবিকতা ও জনকল্যাণের সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে গেছে এবং সাম্প্রতিক কালের নতুন সমস্যাদির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। উদারনীতিবাদের অন্তর্ভুক্ত আধুনিক বিষয়াদির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: জনগণতন্ত্র, সামাজিক-স্বার্থগোষ্ঠীসমূহের বিকাশ, সামাজিক পরিকল্পনা, গ্রামীণ-নগর পরিকল্পনা, মিশ্র অর্থনীতি, শিল্পের বিকাশ, আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার প্রভৃতি। নতুন উদারনীতিবাদে অবাধ বাণিজ্য ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নীতিতে আস্থা রাখা হয়নি। আধুনিক উদারনীতিবাদ সমাজবাদ ও সমষ্টিবাদের উপাদানের দ্বারা পরিপুষ্টি লাভ করেছে। নতুন উদারনীতিবাদে বিশ্বাস করা হয় যে, ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ সাধনের মাধ্যমে সামাজিক প্রগতি সুনিশ্চিত হতে পারে না। প্রয়োজনীয় আর্থ-সামাজিক সংস্কার এবং জনকল্যাণ ও সামাজিক প্রগতির প্রয়োজনে রাষ্ট্রের বিশেষ দায়-দায়িত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আচরণবাদী মতবাদের উপাদানসমূহের দ্বারাও আধুনিক উদারনীতিবাদ সমৃদ্ধ হয়েছে। নতুন উদারনীতিবাদে শান্তিপূর্ণ পথে সমাজ পরিবর্তনের ধারণা এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতার সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা সংমিশ্রণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। জোডকে অনুসরণ করে অধ্যাপক জোহারী তাঁর Contemporary Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন : “…contemporary liberalism has faith in the value of the free expression of individual parsonality, men’s ability to make that expression valuable of themselves and to the society, and the upholding of those institutions and policies that protect and foster both free expression and confidence in that freedom.”

ইতিবাচক উদারনীতিতে রাষ্ট্র: সাধারণ মানুষের কাছে সাবেকী উদারনীতির গুরুত্ব ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে হ্রাস-প্রাপ্ত হয়। এই সময় কতিপয় ব্যক্তির হাতে সম্পদ-সামগ্রী অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত হয়। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের দুঃখ-দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই অবস্থা সাবেকী-উদারনীতির প্রতিকূল পরিণতি হিসাবে পরিগণিত হয়। ইতিহাসের এই রকম এক অধ্যায়ে মিল (J.S. Mill), গ্রীণ, ম্যাকাইভার, ল্যাস্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ্‌গণ রাষ্ট্রের প্রচলিত নেতিবাচক ধারণার পরিবর্তে ইতিবাচক ধারণার প্রচলন করেন। তা ছাড়া এ প্রসঙ্গে আর যাদের নাম উল্লেখ করা দরকার তাঁরা হলেন হবহাউস, হেনরি জোনস, জেমস মিল, বেথাম, সিডনী ওয়েব ও বিয়াত্রিস ওয়েব, হ্যারল্ড ল্যাস্কি, লিওসে, আরনস্ট বার্কার, কোল প্রমুখ চিন্তাবিদগণ।

আধুনিক উদারনীতিবাদের প্রবক্তারা ব্যক্তিবর্গের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক কাজকর্মে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণের উপর জোর দিয়েছেন। তাঁদের কাছে রাষ্ট্র ‘অপরিহার্য অন্যায় নয়, সামাজিক ঐক্য সাধনের মাধ্যম বিশেষ’। বলা হয় যে, রাষ্ট্র সমগ্র জনসম্প্রদায়ের কল্যাণ সাধনের স্বার্থে সদর্থক ভূমিকা পালন করবে। স্বভাবতই আধুনিক উদারনীতিবাদ হল সদর্থক উদারনীতিবাদ। পশ্চিম ইউরোপই প্রথমে আধুনিক উদারনীতিবাদের অনুকূল ক্ষেত্র হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। পরবর্তীকালে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও আধুনিক উদারনীতিবাদের বিকাশ ও বিস্তার ঘটে।

আধুনিক উদারনীতিবাদীদের অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্রকেই মানুষের অনাহার-দারিদ্র্য, অশিক্ষা-অজ্ঞতা, রোগ-ব্যাধি প্রভৃতি প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সক্রিয় ও সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। এবং এক্ষেত্রে রাষ্ট্র সাংবিধানিক পথে সংসদীয় গণতান্ত্রিক উপায় পদ্ধতি অবলম্বন করবে। ব্যক্তির বৌদ্ধিক ও নৈতিক গুণাবলীর এবং ব্যক্তিত্বের সম্যক বিকাশ রাষ্ট্রের মধ্যেই সম্ভব। রাষ্ট্র হল একটি সামাজিক ও নৈতিক প্রতিষ্ঠান। আধুনিক উদারনীতিবাদের প্রবক্তাদের মতানুসারে স্বাধীনতা সীমাহীন ও বিমূর্ত হতে পারে না। সামাজিক পটভূমিকে বাদ দিয়ে কোন ব্যক্তির পক্ষে এককভাবে স্বাধীনতা ভোগ সম্ভবপর নয়। রাষ্ট্র সামাজিক কল্যাণ সাধনের স্বার্থে প্রয়োজনবোধে ব্যক্তির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে। তারফলে সামগ্রিক বিচারে ব্যক্তির বৌদ্ধিক, আত্মিক ও নৈতিক উৎকর্ষ সাধন সম্ভব হবে। স্বভাবতই আধুনিক উদারনীতিবাদীরা ‘রাষ্ট্রের থেকে স্বাধীনতা’ এই ধারণার পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রের মাধ্যমে স্বাধীনতা’ এই ধারণার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

সমগ্র সমাজ ও জনসাধারণের সামগ্রিক কল্যাণ সাধন ও উন্নয়নের উদ্দেশে আধুনিক উদারনীতিবাদীরা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণার উপর জোর দেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা সংস্কারমূলক উপায়-পদ্ধতি অবলম্বনের পরামর্শ প্রদান করেন। জনকল্যাণমূলক ধারণা ও কর্মসূচীসমূহকে আধুনিক উদারনীতিবাদে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে উদারনীতিবাদী আদর্শসমূহকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে কতকগুলি উপায় পদ্ধতির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই সমস্ত উপায়-পদ্ধতি বা কর্মসূচীসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: মানুষের আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শিল্পসংস্থা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের জাতীয়করণ; একচেটিয়া প্রকৃতির বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ; প্রগতিশীল হারে কর আরোপের ব্যবস্থা প্রভৃতি।

মিল: মিল ‘যুগসন্ধিক্ষণের চিন্তানায়ক’ হিসাবে পরিচিত। ব্যক্তির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার যেমন তিনি বিজ্ঞাপিত করেছেন, তেমন শ্রমিক সংঘের অধিকারও তিনি মেনেছেন; পণ্যদ্রব্য বণ্টনে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কামনা করেছেন এবং সমষ্টিগত মঙ্গলকে পরিমাণগত দিক থেকে বিচার না করে তার গুণগত রূপটি অনুধাবন করতে বলেছেন। মিলের মতানুসারে সামাজিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ দরকার। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের বাধাগুলিকে দূর করার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কল্যাণের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মিল সাধারণভাবে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের বিস্তারে আগ্রহী ছিলেন না। তবুও তিনি যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে মেনে নিয়েছেন। সম্পত্তির উত্তরাধিকারের উপর নিয়ন্ত্রণ, একচেটিয়া কারবারের উপর নিয়ন্ত্রণ, কাজের সময় সীমা নির্ধারণ, শিশুদের স্বার্থে প্রয়োজনীয় কারখানা আইন প্রণয়ন, আবশ্যিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রে মিল রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকার কথা বলেছেন। জে. এস. মিল হিতবাদীদের মতই বলেছেন যে, সরকারের সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক হিতসাধনের স্বার্থে। রাজনীতিক সংগঠনের আধার হিসাবে মিল মানুষের ইচ্ছাশক্তিরও আগ্রহের কথা বলেছেন। ব্যক্তি মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও সদ্গুণসমূহের বিকাশ সাধনই হল সরকারের উদ্দেশ্য। সরকারের কর্তৃত্বের ভিত্তি হল সর্বসাধারণের সম্মতি ও সহযোগিতা। গাউবা তাঁর An Introduction to Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন। “J. S. Mill is the most brilliant of the nineteenth century liberal thinkers. He played an important role in drawing a distinction between the political and economic spheres, and in working out the implications of liberal theory in these spheres…..In this way, Mill gave a positive direction to liberal theory.”

গ্রীণ: গ্রীণ (T. H. Green) মূলত একজন ভাববাদী দার্শনিক। কিন্তু তিনি ইংল্যাণ্ডের দীর্ঘদিনের উদারনীতিক ঐতিহ্যকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। ‘জনগণের সম্মতিই হল রাষ্ট্রের ভিত্তি, শক্তি নয়’ (“Will, not force, is the basis of the state.”) – এ হল গ্রীণের এক বিখ্যাত উক্তি। তিনি রাষ্ট্রকে সামাজিক নৈতিকতার সর্বশ্রেষ্ঠ আধার হিসাবে বিজ্ঞাপিত করেও, রাষ্ট্রের ভিত্তিতে জনগণের সমর্থনভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সর্বশক্তিমান বলে মনে করেছেন। রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধিকে সঙ্কুচিত করার কোন পরিকল্পনা তিনি সমর্থন করেন নি। তাঁর মতে রাষ্ট্র হল সমষ্টিগত মঙ্গল (common good) -এর প্রকাশ। গ্রীণের এই ধারণা থেকে বোঝা যায় যে, বিংশ শতাব্দীতে উদারনীতি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের তত্ত্ব (welfare state)-এর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। উদারনীতির এই নতুন ধারার সূচনাকালে গ্রীণ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে অপরিহার্য ও সর্বশক্তিমান বলে গণ্য করেছেন। গ্রীণের মতানুসারে রাষ্ট্র নিজেই নিজের লক্ষ্য নয়। রাষ্ট্র হল ব্যক্তিবর্গের পরিপূর্ণ নৈতিক বিকাশের হাতিয়ার বিশেষ। তাঁর মতে ব্যক্তিবর্গের প্রকৃত লক্ষ্য হল স্বাধীনতার প্রকৃত উপলব্ধি। স্বাধীনতার প্রয়োজন হয় সাধারণ ইচ্ছা (general will) তথা সদিচ্ছা (good will)-র প্রতিষ্ঠার জন্য। রাষ্ট্র এ রকম সদিচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ না করে এর পথের বাধাগুলিকে দূর করবে। রাষ্ট্র ইতিবাচক স্বাধীনতার রক্ষক হিসাবে ভূমিকা পালন করবে। তাঁর মতে নাগরিকগণ কেবলমাত্র রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার জন্যই রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে পারে। অধ্যাপক গাউবা মন্তব্য করেছেন: “T. H. Green is another outstanding exponent of positive liberalism. He sought to revise the liberal theory of the state under the influence of the idealist theory, derived from the teachings of Rousseau, Kant and Hegel.”

ম্যাকাইভার: ম্যাকাইভার রাষ্ট্রের হাতে অসীম ক্ষমতা দেওয়ার বিরোধী। বিভিন্ন নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতাটুকু রাষ্ট্রের আছে। রাষ্ট্র হল সমাজের এজেন্ট হিসাবে নাগরিক অধিকারসমূহের স্রষ্টা। রাষ্ট্র কিন্তু সমাজের জনসাধারণের থেকে বড় হতে পারে না। ম্যাকাইভার নৈতিকতা, ধর্ম, প্রথা, সংস্কৃতি প্রভৃতির উপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে সমর্থন করেন নি। গাউবা মন্তব্য করেছেন: “R. M. Maclver is another twentieth century exponent of positive liberalism. With a strong sociological background, MacIver traces the evolution of the state from primitive social structures to its fuller development as a modern democratic state.”

ল্যাস্কি: ল্যাস্কি তাঁর The State in Theory and Practice গ্রন্থে বলেছেন যে রাষ্ট্র হল একটি ‘জাতীয় সমাজ’ (national society)। সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গ ও গোষ্ঠীসমূহের উপর বলপ্রয়োগের আইনসঙ্গত ক্ষমতা রাষ্ট্রের আছে। রাষ্ট্রের এই ক্ষমতাই হল সার্বভৌমত্ব। রাষ্ট্রকে সমাজস্থ নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষা করতে হয়। বহুত্ববাদী ল্যাস্কি গোড়ার দিকে আধুনিক উদারনীতিক মতবাদকে সমর্থন করেছেন। শেষ অবধি ল্যাঙ্কি মার্কসীয় মতাদর্শের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। অধ্যাপক ল্যাস্কি সম্পর্কে অধ্যাপক গাউবার অভিমত হল: “Laski has further developed the liberal theory of the state in the light of his experience of the momentous events which shook the world in the first half of the twentieth century.” অধ্যাপক গাউবা আরও বলেছেন: “Laski, therefore, proceeded to indentify certain positive characteristics and tendencies of the ‘modern state’ which held some promise for the underprivileged sections.”

জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রতত্ত্ব: মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মানবতাবাদী ও শ্রেণীহীন-শোষণহীন সমাজব্যবস্থার আদর্শ এবং রাশিয়ার ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্যের প্রতিক্রিয়া হিসাবে উদারনীতিক তত্ত্বের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। এ রকম এক পরিস্থিতিতে উদারনীতির সমর্থক সমাজতত্ত্ববিদ, অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রতত্ত্ব গড়ে তোলেন। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রতত্ত্বে পরিপূর্ণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও পরিপূর্ণ সমাজতন্ত্রবাদের অস্বীকৃতি এবং উভয় মতবাদের সংমিশ্রণের ভিত্তিতে এক মাঝামাঝি ব্যবস্থার কথা বলা হয়। এ ধরনের রাষ্ট্রতত্ত্বের উদ্দেশ্য হল জনকল্যাণ সাধনের হাতিয়ার হিসাবে রাষ্ট্র গড়ে তোলা। এই মতবাদ অনুসারে মিশ্র অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে জনকল্যাণ সাধনের কথা বলা হয়। জনকল্যাণকর রাষ্ট্রতত্ত্বে উদারনীতিক গণতন্ত্রের মৌল নীতিগুলি নিহিত আছে। উদাহরণ হিসাবে, নাগরিকদের রাজনীতিক ও পৌর অধিকারসমূহ এবং রাজনীতিক সাম্যের স্বীকৃতি, সার্বিক প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি, ন্যায় বিচার ও নিরপেক্ষ আদালতের প্রতিষ্ঠা, একাধিক রাজনীতিক দলের অবস্থান, সাংবিধানিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরকারের পরিবর্তন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া আর্থনীতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, শিল্পবাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ এবং কিছু কিছু জাতীয়করণ, গতিশীল করব্যবস্থা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।