পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ
পৃথিবীতে, মানবজাতির অস্তিত্বকে অব্যাহত রাখার ব্যাপারে মানুষকেই উপযুক্ত উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করতে হবে। তারজন্য পরিবেশ দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি রোধ করা আবশ্যক। পরিবেশ দূষণ বর্তমানে পৃথিবীতে মানুষের সুস্থ ও স্বাভাবিক অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। পরিবেশ দূষণের বর্তমান ভয়াবহ অবস্থা একদিনে বা দুদিনে হয়নি। মানুষই অজ্ঞতাবে পরিবেশকে অপব্যবহার বা অতিব্যবহার করেছে ক্রমাগত। প্রকৃতির সাধারণ নিয়মকে মানুষ আকচার অমান্য করেছে। তারফলে প্রকৃতির স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। পরিবেশ দূষণ এভাবে চলতে থাকলে মানবজাতির পক্ষে তা অতিমাত্রায় ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে। এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সাবধানবানী উচ্চারণ করেছেন। এ বিষয়ে মানুষকেই সতর্ক হতে হবে। পরিবেশদূষণ রোধ করতে হবে। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ সালের ১৪ই জুন সুইডেনের স্টকহোম (Stock Holm) শহরে আয়োজিত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের পরিবেশ সম্পর্কিত এক আলোচনা সভায় মন্তব্য করেন : “Modern man must reestablish his unbroken link with nature and with life. He must again learn to make the energy and to recognise, as did the ancients in India centuries ago, that we can take from the earth and atmosphere only so much as one put back into them.” এ বিষয়ে বিভিন্ন সদর্থক ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থদির কথা বলা হয়। পরিবেশ দূষণ বিরোধী বিভিন্ন ব্যবস্থার মধ্যে কতকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উপযুক্ত জাতীয় শিল্পনীতি অবলম্বন করা আবশ্যক: জাতীয় স্বার্থ ও পরিবেশগত স্বার্থ সংরক্ষণের স্বার্থে সহায়ক শিল্পনীতি গ্রহণ করা দরকার। কারণ পরিবেশ দূষণের একটি বড় কারণ হল অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন। সুতরাং সঠিক জাতীয় শিল্পনীতি গ্রহণ করা এবং কঠোরভাবে তা কার্যকর করা দরকার।
অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন বন্ধ করা দরকার: পরিবেশ দূষণের জন্য অনিয়ন্ত্রিত নগরায়নের দায়িত্বও কম নয়। শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে নগরায়নের প্রক্রিয়া লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদ্যমান শহরগুলির পরিধি প্রসারিত হচ্ছে এবং নতুন নতুন শহরের সৃষ্টি হচ্ছে। আকারে প্রকারে শহরগুলির বৃদ্ধির উপর কার্যকর তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। অবিন্যস্তভাবে গড়ে উঠা শহরগুলি আশপাশের এলাকার পরিবেশকে দুষিত করছে। এর বিহিত করা বাঞ্ছনীয়। তারজন্য নগরায়ন প্রক্রিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিব্যবস্থা আরোপ করা আবশ্যক।
দূষণ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র লাগানোর ব্যাপারে গাড়ির মালিককে কঠোরভাবে নির্দেশ দিতে হবে: বাস ট্রাক-ট্যাক্সির মত যানবাহন থেকে নির্গত ক্ষতিকর ধোঁয়া পরিবেশকে দূষিত করে। বিষাক্ত ধোঁয়ার নির্গমন রোধ করা দরকার। তারজন্য গাড়িতে উপযুক্ত যন্ত্র লাগাতে হবে। সে ব্যাপারে গাড়ির মালিকদের উপর যথাযথ আইনী নির্দেশ থাকা আবশ্যক।
শহরের পয়ঃপ্রণালীর পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন: শহরগুলির বিদ্যমান নর্দমা নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালভাবে ঝালাই করে দেখা দরকার। শহরের নর্দমাগুলি এসে পার্শবর্তী নদী-নালা, খালে-বিলে এসে পড়ে। তারফলে জল ও পরিবেশ দূষিত হয়। এটা রোধ করা দরকার। তারজন্য নর্দমার জল নদী-নালা, খালে-বিলে মিশে যাওয়ার আগে পরিশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে।
অজৈব ও অবক্ষয়হীন আবর্জনা বর্জ্য্যসমূহকে পৃথক ভাবে সংগ্রহ করে দূরবর্তী কোন জায়গায় স্থানান্তরিত করতে হবে: অবাঞ্ছিত অজৈব পদার্থ বলতে টিন, প্লাসটিক ব্যাগ, বোতল, বাক্স প্রভৃতিকে বোঝায়। এই সব জিনিসকে স্বতন্ত্রভাবে একটা ডাস্টবিনে রাখতে হবে। পৌর কর্তৃপক্ষ পৃথকভাবে এগুলিকে সংগ্রহ করবে এবং দূরবর্তী কোন জায়গায় নিয়ে ফেলবে। তাছাড়া এই সব জিনিসের ব্যবহার যথাসম্ভব হ্রাস করার ব্যাপারে মানুষকে যত্নবান হতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সরকারও সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রসমূহে প্লাসটিক ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করবে।
অবক্ষয়হীন পদার্থসমূহের পুনর্ব্যব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে: অবক্ষয়হীন পদার্থসমূহের ব্যবহার হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে এগুলিকে পুনর্ব্যবহারের উপযোগী করার ব্যাপারেও উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করতে হবে। এরকম উদ্যোগ-আয়োজনকে মানুষ সাহায্য-সমর্থন যোগাবে।
প্রত্যহ আবর্জনা পরিস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে: ময়লা ফেলার জায়গায় জড়ো করা ধুলো ময়লা, আবর্জনা ও বাতিল করা জিনিসপত্র প্রতিদিন পরিস্কারের ব্যবস্থা থাকবে। এ ব্যাপারে পৌর প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। গৃহস্থরা যাবতীয় আবর্জনা ও বর্জ্য অতিঅবশ্যই সুনির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলবে, যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলবে না।
ওজন স্তরের সুরক্ষার ব্যাপারে বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে: মাটি থেকে কুড়ি-তিরিশ কিলোমিটারের মধ্যে পৃথিবীর পরিমণ্ডল একটি আস্তরণের দ্বারা আবৃত আছে। এই আস্তরণটিকে বলে ‘ওজন স্তর’ (Ozon layer)। এই ওজন স্তর পৃথিবীর চতুর্দিকে বর্তমান। এই স্তর কয়েক কিলোমিটার পুরু। সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া থেকে এই আস্তরণ পৃথিবীর প্রাণীকূলকে রক্ষা করে। এই আস্তরণের অবক্ষয় পৃথিবীর জীবজগতের পক্ষে আত্মহত্যার সামিল। সুতরাং প্রাণরক্ষক এই ওজন স্তরটির সুরক্ষার ব্যাপারে সর্বপ্রকারে সম্যক উদ্যোগ-আয়োজন অবলম্বন করা অপরিহার্য। এই উদ্দেশ্যে পরিমণ্ডলে আণবিক বিস্ফোরণ নিষিদ্ধ করা দরকার; উর্দ্ধ পরিমণ্ডলে শব্দের থেকে দ্রুতগামী বিমানের উড়ান নিষিদ্ধ করা দরকার প্রভৃতি।
পরিবেশ সংরক্ষণে বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগঠিত প্রচারকার্য পরিচালনা: জাতীয় স্তরে পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কিত প্রচার ও আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে। এই কাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষেকে সামিল হতে হবে। এই কাজে যাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আবশ্যিক তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন : রাজনীতিক নেতা, বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা, কৃষক নেতা, শ্রমিক নেতা, ছাত্র নেতা প্রভৃতি। মনে রাখতে হবে যে, ভারতীয়দের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও নিরক্ষর। পরিবেশকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে এদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। পরিবেশ দূষনের বিপদ সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তুলতে হবে।
অরণ্য সংরক্ষণে উৎসাহ দিতে হবে: পরিবেশ সংরক্ষণে বনাঞ্চলের সদর্থক ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করতে হবে। বিদ্যমান বনাঞ্চল সমূহের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে উপযুক্ত সরকারী অবস্থা অবলম্বন করতে হবে। একটি গাছ কাটার আগে দুটি গাছ লাগাতে হবে। এই স্লোগানকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। সরকারী উদ্যোগে ‘বনমহোৎসব’ পালন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারী অফিস, হাসপাতাল, কলকারখানা প্রভৃতি সংস্থা-সংগঠনের খোলা জায়গায় বাগান, পার্ক প্রভৃতি গড়ে তুলতে হবে।
পরিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ আর্থনীতিক সাহায্য-সহযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে: পরিবেশগত স্বার্থ সুরক্ষার ব্যাপারে স্থানীয় সংস্থা-সংগঠনগুলিকে আর্থনীতিক সাহায্য-সহযোগিতা সরবরাহ করতে হবে। তারজন্য আলাদা অর্থভাণ্ডার থাকা দরকার। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় বাজেটে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।
পরিবেশ সচেতনতা শিশুদের মধ্যে গড়ে তোলা দরকার: আজকের শিশু আগামী দিনের দায়িত্বশীল নাগরিক। শিশু ও যুবশক্তি জাতির মেরুদণ্ড। এদের মধ্যে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। স্কুল-কলেজে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিশু কালের এই শিক্ষা নিকট ভবিষ্যতে পরিবেশের সুরক্ষায় সাহায্য করবে।
পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে: পরিবেশের সম্যক সুরক্ষার ব্যাপারে জনসাধারণকে সুশিক্ষিত করে তুলতে হবে। ১৯৭৭ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ তার একটি বিশেষ সংস্থার মাধ্যমে উদোগ-আয়োজন গ্রহণ করেছিল। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের এই বিশেষ সংস্থাটির নাম হল ইউনেপ’ (UNEP– United Nations Education Programme)।
পরিবশে বিষয়ক শিক্ষা প্রসঙ্গে কতকগুলি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য :
-
(ক) স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান;
-
(খ) উন্নত বিজ্ঞানের কারণে বায়ু, জল ও মৃত্তিকার অবক্ষয় সম্পর্কিত পরিবেশ বিজ্ঞানের সক্রিয়তা;
-
(গ) পরিবেশের উপর যন্ত্র বিজ্ঞানের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে পরিবেশমূলক যন্ত্র বিজ্ঞানের আলোচনা।
Leave a comment