পরিবেশ ও মানবাধিকার
সাম্প্রতিককালে সভ্য সমাজজীবনে ও বিদ্বজনমহলে ‘পরিবেশ’ এবং মানবাধিকার এই দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনার আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। পরিবেশ সংরক্ষণে পরিবেশবিদরা এবং মানবাধিকারের সুরক্ষায় মানবাধিকারের কর্মীরা অনেকাংশে অভিন্ন লক্ষ্যে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করছেন। পরিবেশ ও মানবসম্পদ সংরক্ষণে আধুনিককালে আইনমূলক সাহায্য-সহযোগিতার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, পরিবেশ ও মানবাধিকারের বিষয়টি গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। পরিবেশ ও মানবাধিকার সংরক্ষণ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। অধুনা মানবাধিকার সম্পর্কিত চুক্তিসমূহের মাধ্যমে ভদ্রপরিবেশে ও ভদ্রভাবে বসবাসের অধিকার, সুস্বাস্থ্যের অধিকার প্রভৃতির কথা বলা হয়। এই সমস্ত অধিকারের সুরক্ষার সুবাদে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিও নিশ্চয়তা লাভ করে। শারীরিক ও মানবিক কল্যাণ সাধনের জন্য সরকারকে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করতে হয়। সুস্বাস্থ্যের অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য সরকারকে বিষাক্ত ও প্রতিকূল পরিবেশ প্রতিহত করার ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হয়। মনে রাখা দরকার যে পরিবেশের অবক্ষয় ঘটলে মানবাধিকার বিপন্ন হয়ে পড়ার আশংকা দেখা দেয়।
সাংস্কৃতিক অধিকারের অনুপস্থিতিতে পরিবেশগত অবক্ষয়ের আশংকা অমূলক নয়। পরিবেশ রক্ষার উপর সংস্কৃতি নির্ভরশীল। সামাজিক অংশগ্রহণের অধিকার সুনিশ্চিত হলে পরিবেশ সংরক্ষণ সরকারের পক্ষে সহজ হয়। এই পরিবেশের সুরক্ষার উপর সংস্কৃতির নির্ভরশীলতা অনস্বীকার্য। সামাজিক ও রাজনীতিক অধিকারে অংশগ্রহণ পরিবেশের সুরক্ষায় সাহায্য করে। অনুরূপভাবে আবার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থনীতিক অধিকার মানবিক কল্যাণ সাধনে সাহায্য করে।
মানবজাতির সুরক্ষার স্বার্থে স্বীকৃত নীতিসমূহ বাস্তুতন্ত্র, প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে সাহায্য করে। রাজনীতিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে মানুষ বাস্তুতান্ত্রিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়। শিক্ষার অধিকার ভোগ সুনিশ্চিত হলে পরিবেশ সচেতনতা স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়। তেজস্ক্রিয়তার বিষাক্ত অবস্থা থেকে মানুষের সুরক্ষার জন্য গৃহীত ব্যবস্থার মাধ্যমে অন্যান্য প্রাণী বা সমগ্র পরিবেশের সুরক্ষার ব্যবস্থা হয়।
পরিবেশের সুরক্ষার স্বার্থে মানবাধিকারের সদর্থক ভূমিকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। জীবন ও সম্পদের অধিকার সম্যকভাবে সংরক্ষিত হলে পরিবেশের সুরক্ষা সহজ হয়ে যায়। সামাজিক ও রাজনীতিক অধিকারসমূহ সুরক্ষিত অবস্থায় থাকলে পরিবেশগত বিচারে যথাযথ রাজনীতিক পরিবেশ অব্যাহত থাকে। সাম্য, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, জীবন, মতপ্রকাশ ও আইনমূলক সহযোগিতার ক্ষেত্রে মানবাধিকারের অবতারণা করলে পরিবেশগত বিচারে অবক্ষয়ের বিষয় এসে যাওয়া স্বাভাবিক। অনুরূপভাবে আবার পরিবেশের অবক্ষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরোধ আন্দোলনের উপর আঘাত আসে। এ রকম অবস্থায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তথ্যাদির যথাযথ আদান প্রদান বাধাপ্রাপ্ত হয়।
পরিবেশের অবক্ষয় মানুষের স্বাস্থ্য এবং জীবন ও জীবিকার উপর প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সুরক্ষিত পরিবেশে মানুষের সুখ-স্বস্তি সুনিশ্চিত হয় সুতরাং পরিবেশের সুরক্ষা মানবাধিকারের জন্য আবশ্যক। অনুরূপভাবে আবার মানবাধিকারের আইনানুগ সুরক্ষার ব্যবস্থা পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সাহায্য-সহযোগিতা করে। পরিবেশ সম্পর্কিত বিষয়াদিতে একেবারে নতুন ধারার অধিকারের কথা বলা দরকার। পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগের জন্য বিদ্যমান অধিকারসমূহের বিকাশ ও বিস্তার বাঞ্ছনীয়। আবার বিদ্যমান অধিকারসমূহ সংরক্ষণের ধারাতেই পরিবেশ প্রসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে পরিবেশের বিষয়টিকে মানবাধিকারের দিক থেকে আলোচনা করা যায় এবং এ ধরনের আলোচনার উল্লেখযোগ্য সুবিধা আছে।
পরিবেশ ও মানবাধিকারের গভীর পারস্পরিক সংযোগ-সম্পর্ক সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে বিরোধিতার আশঙ্কা আছে। বাস্তবে মাঝে মাঝে এ ধরনের বিরোধ বাধতেও দেখা যায়। বলা হয় যে, আর্থনীতিক ক্ষেত্রে উন্নতি সাধনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য, সম্পদ, সংস্কৃতি এবং জীবন ও সুস্থভাবে জীবনযাপনের মানবাধিকার অর্জন করা আবশ্যক। সমালোচকদের অভিমত অনুযায়ী সে ক্ষেত্রে বিদ্যমান পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের অবক্ষয় অনিবার্য হয়ে পড়বে। মানবাধিকারের প্রবক্তারা মানুষের অস্তিত্বের বিষয়টি জীবজগৎ ও বাস্তুতন্ত্রের উপরে রাখেন। অপরদিকে অগ্রাধিকারের বিষয়টিকে নিয়ে পরিবেশবিদরা প্রশ্ন উত্থাপনের পক্ষপাতী মানবাধিকারের প্রবক্তাদের অভিযোগ অনুযায়ী পরিবেশবিদরা মানুষের প্রয়োজনের বিষয়টিকে প্রায়শই ভুলে যান। পরিবেশবিদরা মূলত প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রাণী ও আগামী প্রজন্মের মৌলিক চাহিদাসমূহের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন।
Leave a comment