ব্রহ্মাণ্ডের সৌরমণ্ডলব্যাপী অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র বর্তমান। অন্য কোন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে এখনও নিঃসন্দেহ হওয়া যায়নি। কিন্তু পৃথিবীতে প্রাণ হল অনন্য সাধারণ সম্পদ। অনুকূল পরিবেশেই পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে এবং প্রাণীর উদ্ভব, বিবর্তন ও সমৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। পৃথিবীর পরিবেশ প্রতিকূল হয়ে পড়লে প্রাণের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। এই পৃথিবী মানুষের আবাস ভূমি। জীবজগতের সঙ্গে উদ্ভিদ জগতের প্রয়োজনীয় সব কিছুই পৃথিবীতে বর্তমান। এখানে স্থলভাগ আছে, জলভাগ আছে, বায়ুমণ্ডল আছে, আছে জীবনের যাবতীয় শক্তির উৎস স্বরূপ অফুরন্ত সূর্যালোক, সহনীয় উষ্ণতা, নদ-নদী-গিরিপর্বত, বিবিধ খনিজ পদার্থ, উর্বর মৃত্তিকা এবং বহু ও বিভিন্ন উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণী সমৃদ্ধ অরণ্যভূমি। বংশানুক্রমে এখানে বসবাসের ও জীবনযাপনের যাবতীয় রসদ মজুত আছে। এই সুবাদে পরিবেশের আলোচনা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।
পরিবেশের ধারণা
ইংরেজী ‘environment’ শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে ফরাসী শব্দ ‘environir’ থেকে। ঘিরে থাকা অর্থেই ফরাসী ‘environir’ শব্দটির প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। এ দিক থেকে বিচার করলে মানুষের ‘পরিবেশ’ হল সেই সমস্ত উপাদানের সমন্বয়, যা মানুষকে ঘিরে থাকে, মানুষের উপর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ ব্যুৎপত্তিগত অর্থে পারিপার্শ্বিক অবস্থাকেই পরিবেশ বলা হয়। সাধারণভাবে পরিবেশ বলতে বোঝায় মানুষের চারপাশের ঘরবাড়ী, মাটি, জলহাওয়া, গাছপালা, জীবজন্তু, মানুষজন সবকিছুই। মানবসমাজের পারিপার্শিক সেই সমস্ত দৃশ্য ও অদৃশ্য উপাদানসমূহকে নিয়ে পরিবেশ গড়ে উঠে, যেগুলি মানুষের জীবন-জীবিকা ও বাস্তবসম্মত যাবতীয় কার্যকলাপের উপর প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই প্রভাব-প্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ হতে পারে, আবার পরোক্ষ হতে পারে। সমাজবিজ্ঞানী পার্ক (C. C. Park) এর অভিমত অনুযায়ী পরিবেশ বলতে নির্দিষ্ট কোন সময়ে ও স্থানে মানুষকে ঘিরে থাকা সামগ্রিক অবস্থাকে বোঝায়।
বস্তুত পরিবেশ হল একটি ব্যাপকভাবে অর্থবহ শব্দ। পারিপার্শ্বিক সব কিছুই পরিবেশের ধারণার অন্তর্ভুক্ত। মানুষের পরিচিত জগতের অন্তর্ভুক্ত সব কিছু নিয়েই রচিত হয় পরিবেশ। মানুষের পরিচিত জগতের মধ্যে মানুষ ছাড়াও আছে বিভিন্ন রকমের পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, গাছপালা, মাটি, জল, বাতাস, আলো, উত্তাপ, কলকারখানা, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট প্রভৃতি। এ সবের ভিত্তিতেই পরিবেশ গড়ে উঠে। জীব, উদ্ভিদ, আলো, বাতাস, জল, মাটি, তাপ প্রভৃতির সক্রিয় অবস্থানই পরিবেশ হিসাবে পরিগণিত হয়। বাস্তুতান্ত্রিক সামগ্রিক আলোচনায় পরিবেশের ধারণার মধ্যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রাকৃতিক জগৎ যেমন আসে, তেমনি মানুষের সৃষ্ট বিজ্ঞান-প্রযুক্তির জগৎ এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়াদিও আসে। পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত প্রাণী ও উদ্ভিদ হল সজীব উপাদান। অপরদিকে আলো, বাতাস, জল, মাটি, তাপ প্রভৃতি হল অজীব উপাদান।
পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা
জীবনের জন্য পরিবেশ অপরিহার্য। পরিবেশের উপাদানসমূহের উপর জীবনের নির্ভরশীলতা অনস্বীকার্য। খাদ্যের জন্য প্রাণীকে পরিবেশের উপর নির্ভর করতে হয়। জীবনধারণের উপযোগী খাদ্যের জন্য অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের উপর, বসবাসের জন্য মাটি, অন্যান্য সজীব ও অজীব উপাদানসমূহের উপর, নিশ্বাস প্রশ্বাসের জন্য বাতাসের অক্সিজেনের উপর প্রাণীকে একান্তভাবে নির্ভর করতে হয়। পরিবেশের এই সমস্ত উপাদান স্থির নয়, পরিবর্তনশীল। তবে সূর্যালোকের ক্ষেত্রে এ কথা খাটে না। পরিবেশের এই সমস্ত উপাদানের পরিমাণের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটলে অথবা উপাদানগুলির বিশুদ্ধতার বা গুণগত মান হ্রাস পেলে সংশ্লিষ্ট পরিবেশের মধ্যে বসবাসকারী প্রাণীসমূহের জীবনযাপনে বিবিধ সমস্যার সৃষ্টি হবে। অনেক প্রাণী স্থানান্তরে গমন করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে, আবার কোন কোন প্রজাতি অবলুপ্ত হয়ে যাবে। এ সবের ফলে বিদ্যমান পরিবেশের ভারসাম্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
উদ্ভিদসমূহও পরিবেশের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। মাটির জল; খাদ্য-সংশ্লেষের প্রয়োজনে অত্যাবশ্যক খনিজ লবণসমূহ বা প্রাণীর বর্জ্য পদার্থসমূহ। সালোকসংশ্লেষের প্রয়োজনে সূর্যালোক; বাতাসের অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রভৃতির উপর উদ্ভিদ নির্ভরশীল। আবার অনেক উদ্ভিদের বংশ বিস্তারের স্বার্থে পরাগ সংযোগের প্রয়োজনে পতঙ্গদের সাহায্য দরকার।
সুস্থভাবে জীবন যাপনের জন্য পরিবেশকে জানার ব্যাপারে মানুষকে উদ্যোগী হতে হবে। জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত পরিবেশ সম্পর্কে অবহিত হওয়া আবশ্যক; বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক অনুধাবন করা আবশ্যক। পরিবেশ চর্চার মূল দর্শন বা উদ্দেশ্যে আছে। পৃথিবীতে মানুষ সমেত সকল জীবের সুস্থভাবে জীবনযাপন ও সমৃদ্ধি লাভ সুনিশ্চিত হওয়া দরকার। এই উদ্দেশ্যে পরিবেশের উপাদানসমূহের পরিমাণ, মান, ভারসাম্য ও সক্রিয়তা সংরক্ষণ করা দরকার। সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের সমস্যাদির প্রকৃতি পর্যালোচনা এবং সম্যক সমাধানের ব্যাপারে উপযুক্ত উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে সকলের পরিবেশ মনস্ক হওয়া প্রয়োজন।
পরিবেশের প্রভাবকে মানুষ এড়িয়ে যেতে বা এড়িয়ে থাকতে পারে না। অনুকূল পরিবেশ মানুষের সার্বিক বিকাশের সহায়ক। অনুরূপভাবে প্রতিকূল পরিবেশ মানুষের জীবনযাপনকে বিপন্ন করে তোলে। সামগ্রিক বিচারে মানুষের অস্তিত্ব, বিকাশ এবং এমন কি বিনাশও বহুলাংশে পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। মানুষের সমগ্র জীবনধারার উপর পরিবেশের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তবে আধুনিককালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। তারফলে পরিবেশের উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ অল্পবিস্তর পরিলক্ষিত হচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাবে মানুষ আজকাল প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকূলে ব্যবহার করার ব্যাপারে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করেছে।
পরিবেশ পরিচালনা: বর্তমান বিশ্ব-ব্যবস্থায় পরিবেশের বিষয়টি বস্তুত একটি আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। উন্নত এবং উন্নয়নশীল সকল দেশই সাম্প্রতিককালে নিজেদের জাতীয় নীতিতে পরিবেশ পরিচালনা ও সংরক্ষণের বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করছে। সামাজিক বিজ্ঞানী ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে বর্তমানে পরিবেশ বিজ্ঞানী নামে পরিচিত এক শ্রেণীর বিশেষজ্ঞ পরিবেশবিদের সৃষ্টি হয়েছে। পরিকল্পনা কর্মসূচী প্রণয়নের প্রাক্কালে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত প্রভাব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশেষভাবে বিচার-বিবেচনা করেন। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৮০-৮৫) প্রণয়নের প্রাক্কালে ভারত সরকার তাঁর নীতি হিসাবে ঘোষণা করেছে: “It is imperative that we use our renewable resources of water, soil, and vegetation to sustain our economic development. Over exploitation of these is visible in soil erosion, floods, deforestation, siltation, floral and wildlife resources. The depletion of these resources tends to be irreversible…”
আধুনিককালের আর্থনীতিক পরিকল্পনায় পরিবেশ পরিচালনার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। পরিবেশ পরিচালনার পৃথক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বর্তমান। পরিবেশ পরিচালনার কতকগুলি বিশেষ উদ্দেশ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই উদ্দেশ্যগুলি হল:
-
(১) পরিবেশের মান বজায় রাখা;
-
(২) বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা করা;
-
(৩) প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার বন্ধ করা এবং সংরক্ষণ করা;
-
(৪) পরিবেশকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করা;
-
(৫) প্রাকৃতিক সম্পদের পুনঃউৎপাদন করা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় কমানো;
-
(৬) পরিবেশের উপর কোন প্রভাব ছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি তৈরী করা; এবং
-
(৭) দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে আইন ও নিয়ম তৈরী করা।
Leave a comment