পরিবেশের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব
আর্থনীতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন হল পৃথিবীতে একধরনের আধিপত্যাধীন অর্থব্যবস্থার সর্বজনীন ক্রিয়াশীলতা ও বিস্তার। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে এই প্রক্রিয়ার সূত্রপাত ঘটেছে। ‘কাঠামোগত পুনর্গঠন কর্মসূচী’ (structural adjustment programme)-র মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়া আপাতত পরিণতি লাভ করেছে ‘গ্যাট’ (GATT General Agreement on Tariff and Trade) চুক্তিতে। এই অর্থব্যবস্থা হল বিশ্বজনীন। এর ভিত্তি হল স্বাধীন বা মুক্ত বাণিজ্য। স্বাধীন বাণিজ্য ক্রিয়ায় সকল বিশ্বের সকল দেশ অংশগ্রহণ করবে। আন্তর্জাতিক প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যক্রিয়ার শর্তাদির প্রবল চাপে জাতীয় উৎপাদনের ধারা বা কাঠামো যাবে বদলে। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর সকল দেশের আর্থনীতিক ব্যবস্থার উপর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের শর্তসমূহ চেপে বসবে।
বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়নশীল দেশসমূহে প্রতিকূল পরিণাম পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বৈদেশিক ঋণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে আদান প্রদান ঘটেছে। তার ফলে সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণের অধিকার অনেকাংশে আঞ্চলিক স্তর থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে উপনীত হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশসমূহে পরিকাঠামোগত সংস্কার নীতির প্রবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সংস্কার নীতিসমূহের প্রয়োগের পরিণামে জনজীবনে বহু ও বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতার সৃষ্টি হচ্ছে। উন্নয়নে উদ্যোগী দেশগুলিতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে সরকারী সাহায্যের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। অথচ পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে অধিকাংশ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কর্মসূচী অব্যাহত থাকছে। পরিকাঠামোগত সংস্কার নীতি ও কর্মসূচীর পরিপ্রেক্ষিতে উন্নতিকামী দেশগুলিতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে সরকারী বরাদ্দ হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রতিকূল প্রভাব প্রথম পড়ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপর এবং তাদের মহিলাদের উপর। কারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারী বরাদ্দ হ্রাস পেলে ব্যক্তিগত ব্যয় বৃদ্ধি পায়। দরিদ্রদের পক্ষে তা সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না। আবার পরিবারের শিক্ষা স্বাস্থ্যের প্রাথমিক দায়িত্ব মহিলাদের উপরই বর্তায়। শিশুর শিক্ষা ও শিশুকে মানুষ করার দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে মহিলারাই গ্রহণ করে। পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যের দিকেও মহিলাদেরই নজর রাখতে হয়।
উন্নয়নকামী দেশগুলির উপর বিশ্বায়নের প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে ইতিমধ্যে সমাজতত্ত্ববিদরা বিবিধ সমীক্ষা সম্পাদন করেছেন। সংশ্লিষ্ট সমীক্ষা সূত্রে এক হতাশাজনক সামাজিক-মানবিক পরিস্থিতির পরিচয় পাওয়া যায়। বিশ্বায়নের পরিকাঠামোগত সংস্কার কর্মসুচীর কারণে বিবিধ মানবিক সূচক নিম্নমুখী। উন্নয়নকামী দেশগুলিতে রোগ-অসুখের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে, আগেকার দিনের রোগ-অসুখের প্রত্যাবর্তন ঘটছে। কম ওজনের শিশু জন্মাচ্ছে এবং শিশু মৃত্যুর হার বাড়ছে। শিক্ষার হার ও মান হ্রাস পাচ্ছে। পৃথিবীর ধনী ও দরিদ্র দেশসমূহের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যেও ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বিদ্যমান ব্যবধান দিনে দিনে বাড়ছে। আবার সম্পদশালীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দরিদ্র এবং দরিদ্রদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্পদশালীর মধ্যেও পার্থক্য ক্রমান্বয়ে লক্ষণীয় হয়ে উঠছে।
এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশসমূহের স্বাস্থ্য খাতে সরকারী ব্যয়বরাদ্দ বিশেষভাবে হ্রাস পাচ্ছে। স্বাস্থ্য প্রকল্পসমূহে সরকারী ব্যয় সংকোচের কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারসমূহের সদস্যদের, বিশেষতঃ মহিলাদের স্বাস্থ্য হানি ঘটছে। সংক্রামক ব্যাধির এবং অন্যান্য ব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর হারও বাড়ছে।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে খাদ্যে সরকারী ভরতুকী ব্যাপকভাবে কাটছাট করা হচ্ছে। তার ফলে গরীব মানুষের মধ্যে অনাহার-অপুষ্টি বাড়ছে। বিশেষতঃ দরিদ্র পরিবারের মহিলা ও শিশুদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত সমস্যা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্বায়নের পরিকাঠামোগত সংস্কারনীতির প্রতিকূল প্রভাব সব থেকে বেশী পড়েছে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র মহিলাদের উপরে। দরিদ্র মহিলাদের দুঃখ-দুর্দশা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলির গরীব শ্রেণীর মহিলাদের মধ্যে অপুষ্টি জনিত সমস্যাদি এবং মৃত্যুর হারের আধিক্য আজকের নয়, বরাবরের। স্বভাবতই বিশ্বায়নের সংস্কার নীতির প্রতিকূলতার শিকার হয়েছেন বিশেষভাবে এই শ্রেণীর মহিলারা।
বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতি হিসাবে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলির আর্থনীতিক ব্যবস্থায় বিশ্বের বহুজাতিক সংস্থাসমূহের দাপট বেড়েছে এবং কর্তৃত্ব কায়েম হয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উন্নতিকামী দেশগুলির কলকারখানাসমূহের পরিস্থিতি-পরিমণ্ডল অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। শিল্পমালিকরা কারখানার পরিবেশকে স্বাস্থ্যসম্মত করার বিষয়টিকে অবহেলা বা উপেক্ষা করেন। স্বাস্থ্যহানির শিকার হয় দরিদ্র শ্রমিকরা। বিশ্বায়নের সংস্কারনীতির কারণে কলকারখানায় নারী শ্রমিকদের বিধিবহিঃকরণ ও প্রান্তিকরণ ঘটেছে। স্বভাবতই এই সমস্ত দেশের মহিলাদের অপুষ্টিজনিত সমস্যা অধিক এবং মৃত্যুর হারও অধিক।
সাম্প্রতিককালে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রসদ নিষ্কাশনের গতি-ধারা ও পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের ভোগের প্রক্রিয়ায় উচ্ছৃঙ্খলতা এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষিত হচ্ছে এবং পরিবেশের অবক্ষয় ঘটছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষয়-দূষণ ক্রমান্বয়ে সংকটের দিকে অগ্রবর্তী হচ্ছে। পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার বিচারে মানুষের জীবনধারার এবং মানুষের ক্রিয়াকর্মের বাঞ্ছিত পরিবর্তন প্রয়োজন। পরিবেশ সংরক্ষণের সহায়ক কর্মসূচী প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা প্রয়োজন। অন্যথায় প্রাকৃতিক পরিবেশের অবক্ষয় আটকান যাবে না। মানুষ প্রজাতিসহ সমগ্র জীবজগতের লালন-পালনের ক্ষমতা প্রকৃতি অবশেষে হারাবে।
Leave a comment