শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সে থাকে অসহায়, অপরিণত ও কর্মদক্ষতাহীন। ধীরে ধীরে তার বিকাশ ঘটে। এই বিকাশ বহুমুখী ও সামগ্রিক এই বিকাশ বিভিন্ন দিক থেকে হয়, যেমন– দৈহিক বিকাশ, মানসিক বিকাশ, প্রাক্ষোভিক বিকাশ ইত্যাদি। বিভিন্ন দিকের বিকাশের ফলে ওই শিশু একদিন পূর্ণাঙ্গ, কর্মক্ষম ও সুবিকশিত সত্তায় পরিণত হয়। শিশুর আচরণধারারও নানান পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তন স্বাভাবিক নিয়মে হয়।
পরিণমন একটি অভ্যন্তরীণ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যা ব্যক্তির মধ্যে সংঘটিত হয় কোনাে বাহ্যিক উদ্দীপকের প্রভাব ছাড়াই। অর্থাৎ যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বিকাশ প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়, তাকে পরিণমন বলে।
- মনােবিদ গেসেলর মতে, স্বিকীয় ও অন্তর্জাত বৃদ্ধি হল পরিণমন। মনােবিদ কোলেনসিক-এর মতে, জন্মগত সম্ভাবনাগুলি স্বাভাবিকভাবে প্রস্ফুটিত হওয়ার ফলে শিশুর আচরণের গুণগত এবং পরিমাণগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়াই হল পরিণমন।
- থম্পসনের মতে, পরিণমন প্রক্রিয়া হল একটি বৃদ্ধির প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিশু একজন পরিণত মানুষরূপে গড়ে ওঠে।
- মনােবিদ স্কিনারের মতে, পরিণমন হল একধরনের বিকাশ, যা পরিবেশগত অবস্থার ব্যাপক তারতম্য থাকলেও মােটামুটিভাবে নিয়মমাফিক সংঘটিত হয়।
পরিণমনের বৈশিষ্ট্য
পরিণমনের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে এর কতকগুলি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। সেগুলি হল一
(১) বিকাশের প্রক্রিয়া: পরিণমন বলতে কোনাে বিশেষ আচরণ সম্পাদনের ক্ষমতাকে বােঝায় না পরিণমন হল ব্যক্তি বা শিশুর এমন এক বিকাশ প্রক্রিয়া, যার দ্বারা তার আচরণগত পরিবর্তন আসে এবং নতুন নতুন কর্মদক্ষতা সৃষ্টি হয়।
(২) স্বাভাবিক প্রক্রিয়া: পরিণমন কোনাে শর্তসাপেক্ষ প্রক্রিয়া নয়। উদ্দীপক পরিস্থিতির বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই পরিণমন শিশুর মধ্যে স্বাভাবিক নিয়মে সংঘটিত হয়। তাই পরিণমনকে স্বাভাবিক বিকাশের প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
(৩) অচেষ্ট প্রক্রিয়া: পরিণমনের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যক্তির চেষ্টার কোনাে প্রয়ােজন হয় না। পরিণমন ব্যক্তির অজান্তেই ঘটে থাকে। যেমন— কাঁচা আম গাছে থাকতে থাকতে স্বাভাবিক নিয়মে পেকে যায়। পাকানাের জন্য আম পেড়ে ঘরে গরমের মধ্যে না রাখলেও চলে। একইভাবে স্বাভাবিক নিয়মে ব্যক্তিজীবনেও পরিপক্কতা আসে।
(৪) প্রশিক্ষণনির্ভর নয়: পরিণমনের জন্য কোনােপ্রকার প্রশিক্ষণের প্রয়ােজন হয় না। এমনকি এই প্রক্রিয়া ব্যক্তি বা সমাজের ইচ্ছা, অবস্থা কোনাে কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়।
(৫) চাহিদানির্ভর নয়: পরিণমন ব্যক্তি বা সমাজের চাহিদার উপর নির্ভরশীল প্রক্রিয়া নয়। অর্থাৎব্যক্তির চাহিদা না থাকলেও পরিণমন সংঘটিত হয়। তবে পরিণমন বা পরিণমনজনিত বিভিন্ন পরিবর্তন ব্যক্তির বিভিন্ন ধরনের চাহিদাকে পরিতৃপ্ত করতে সাহায্য করে।
(৬) সহজাত প্রবণতার উপর নির্ভরশীল: জন্মসূত্রে প্রাপ্ত সম্ভাবনাগুলির বিকাশের উপর পরিণমন নির্ভরশীল। কারণ বহিঃপরিবেশ ব্যক্তির পরিণমনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
(৭) স্বাভাবিক দক্ষতা অর্জনে সহায়ক: পরিণমনের ফলে ব্যক্তির শারীরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ব্যক্তি সহজেই কোনাে বিশেষ দক্ষতা অর্জনে সমর্থ হয়।
(৮) নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক প্রক্রিয়া: পরিণমন জীবনের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে শুরু হয় এবং একটি বিশেষ পর্যায়ে শেষ হয়। তাই পরিণমনকে জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া বলা যায় না। বিভিন্ন ব্যক্তির পরিণমন বিভিন্ন পর্যায়ে শুরু হয় এবং বিভিন্ন পর্যায়ে শেষ হয়।
(৯) জৈবিক বিকাশের প্রক্রিয়া: পরিণমন নির্ভর করে ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ জৈবিক কেন্দ্রগুলির স্বাভাবিক বিকাশের উপর। বাস্তবে দেখা গেছে ব্যক্তির জৈবিক কেন্দ্রের বিকাশে কোনাে ব্যাঘাত ঘটলে তার পরিণমনও ত্রুটিপূর্ণ হয়।
Leave a comment