ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার মৌলিক কার্যাবলির মধ্যে পরিকল্পনা হচ্ছে প্রথম ও মুখ্য কাজ। এটি এক বিশেষ ধরনের সিদ্ধান্ত বা সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের সাথে সম্পর্কিত। L.A. Allen এর ভাষায় অর্থাৎ “পরিকল্পনা হলো ভবিষ্যতকে বন্দী করার একটি ফাঁদ”। শুধু ব্যবসায় জগতেই নয়, পরিকল্পনা বিষয়টি সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ব্যবসায় জগতে, প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে পরিকল্পনা হচ্ছে লক্ষ্যভিত্তিক অগ্রযাত্রার পথিকৃত।যেমন, একজন ছাত্র তার শিক্ষা জীবনের শুরুতে মনে মনে কল্পনা করে নেয় কর্মজীবনে সে কোন পেশা গ্রহণ করবে এবং তার পছন্দসই পেশা অর্জনের জন্য তাকে কি ধরনের লেখাপাড়া করতে হবে, কেমন পরিশ্রম করতে হবে, খরচ কোথা থেকে আসবে, এর জন্য সে কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার পড়ালেখা সমাপ্ত করবে ইত্যাদি। তাকে আগে থেকেই কল্পনা করে রাখতে হবে। এবং এই সব কর্ম পদ্ধতি কোন প্রক্রিয়ায় সম্পাদন করবে তা পূর্বেই ঠিক করা হচ্ছে পরিকল্পনা

এ পোস্টে পরিকল্পনা কী তা জানার পাশাপাশি পরিকল্পনা প্রণয়নের পদক্ষেপসমূহ এবং পরিকল্পনার প্রকারভেদ সম্পর্কে আমরা আলোচনা করবো।

 

পরিকল্পনা কী বা কাকে বলে :-

পরিকল্পনা হচ্ছে ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের অগ্রিম সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি প্রক্রিয়া। অর্থাৎ ভবিষ্যতে কোন কাজ কখন, কিভাবে, কার দ্বারা সম্পাদন করা হবে এসব বিষয়ের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচিকে পরিকল্পনা বলে।

বিভিন্ন মনিষী পরিকল্পনাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস পেয়েছেন। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনার সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো –

পরিকল্পনা কাকে বলে? এ সম্পর্কে টেরী এবং ফ্রাংকলিন বলেন, “পরিকল্পনা হলো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্যাবলী অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ কি করতে হবে এ সম্পর্কে ধারণা তৈরী ও বিষয়বস্তু নির্দিষ্ট করা।”

পরিকল্পনা কি? এ সম্পর্কে এইচ আইরিচ ও এইচ. কুঞ্জ (H. Weihrich and H. Koontz)- বলেন , “নির্বাচিত ব্রত বা উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের বিকল্প কর্মপন্থা হতে উত্তম কর্মপন্থা নির্বাচন করাকে পরিকল্পনা বলে”

ডাব্লিউ. এইচ. নিউম্যান (W. H. Newman)-এর মতে, “কী করা হবে তার অগ্রিম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাকে পরিকল্পনা বলে।”

পরিকল্পনা বলতে কি বুঝায়? আর. এন. ফার্মার ও ব্যারি এম. রিচম্যান (R. N. Farmer & Barry M. Richman)-এর মতানুসারে, “সংগঠিত কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে পরিকল্পনা বলে।”

 

সুতরাং কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্য ভবিষ্যতে কোন কাজ কখন, কার দ্বারা, কীভাবে সম্পাদিত হবে এ সম্বন্ধে পূর্ব অভিজ্ঞতা ও প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গৃহীত কার্যসূচি প্রণয়নের প্রক্রিয়াকে পরিকল্পনা বলে।

পরিকল্পনার প্রকারভেদ :-

যে কোনো প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন প্রকার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। পরিকল্পনা কত প্রকার ও কি কি এ সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থাকার ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। এগুলোতে তিনটি ভিত্তিতে বিভক্ত করে নিয়ে আলোচনা করা হলো:

প্রকৃতি বা উদ্দেশ্যভিত্তিক পরিকল্পনা কত প্রকার ও কি কি :-

১. লক্ষ্য (Goal) :-

কোনো প্রত্যাশিত ও সুনির্দিষ্ট ফল অর্জনের জন্য যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় তাকে লক্ষ্য বলে।

উদাহরণস্বরূপ- ২০২৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রশাসনিক ব্যয় ১০% কমাতে হবে- এটি একটি লক্ষ্য। লক্ষ্য একটি সুনির্দিষ্ট বিন্দুকে নির্দেশ করে এবং এতে পৌঁছাবার জন্য সংগঠিতকরণ, কর্মীসংগ্রহ, নেতৃত্বদান ও নিয়ন্ত্রণ কার্য সম্পাদন করা হয়।

লক্ষ্য- এর পাঁচটি উপাদান থাকে – সুনির্দিষ্ট, পরিমাপনযোগ্য, যথোপযুক্ত, বাস্তবসম্মত, নির্দিষ্ট সময়, এগুলো সংক্ষেপে SMART হিসেবে পরিচিত।

উদ্দেশ্য, অভিপ্রায়, সীমারেখা, কোটা, আদর্শমান, মিশন ইত্যাদি লক্ষ্যের পরিধির অন্তর্ভুক্ত।

২. স্থায়ী পরিকল্পনা (Standing plan) :-

একই ধরনের সমস্যা বার বার উদ্ভুত হলে সেসব মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে দীর্ঘমেয়াদের জন্য যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় তাকে স্থায়ী পরিকল্পনা বলে।

অর্থাৎ কোন প্রতিষ্ঠানে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রণীত যে পরিকল্পনা একই ধরনের ক্ষেত্রে বার বার ব্যবহার করা হয় তাকে স্থায়ী পরিকল্পনা বলা হয়। নীতি, পদ্ধতি, রীতি বা পন্থা ইত্যাদি স্থায়ী পরিকল্পনার আওতাভুক্ত। একটি সমস্যা সমাধান হয়ে গেলেও এ পরিকল্পনা ত্যাগ করা হয় না।

 

৩. একার্থক পরিকল্পনা (Single use plan) :-

বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় তাকে একার্থক পরিকল্পনা বলে।

উদ্দেশ্য সাধিত হলে এ পরিকল্পনারও সমাপ্তি ঘটে। অর্থাৎ কোনো প্রতিষ্ঠানের বিশেষ কোন সমস্যা সমাধানকল্পে অথবা বিশেষ কোনো ঘটনা মোকাবেলা করার লক্ষ্যে যখন বিশেষ ধরনের মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় তাই একার্থক পরিকল্পনা। এ ধরনের পরিকল্পনা বার বার ব্যবহার করা হয় না।

সময় বা মেয়াদভিত্তিক পরিকল্পনার প্রকারভেদ :-

১. স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা (Short term plan) :-

স্বল্পকাল স্থায়ী পরিকল্পনাকে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা বলা হয়। এ পরিকল্পনা সাধারণত ১ বছর মেয়াদি হয়। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা দুই প্রকারের হয়। যথা- এ্যাকশন প্লান, রি-এ্যাকশন প্রান।

২. মধ্যম মেয়াদি পরিকল্পনা (Intermediate term plan) :-

মধ্যম মেয়াদের পরিকল্পনা সাধারণত ১ বছর থেকে ৫ বছর মেয়াদের জন্য করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ যে সমস্ত পরিকল্পনা এক বছরের অধিক সময়ের জন্য প্রণয়ন করা হয়, তাদেরকে মদ্যমেয়াদি পরিকল্পনা বলে। মধ্যম ও প্রথম স্তরের ব্যবস্থাপকদের জন্য এরূপ পরিকল্পনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

৩. দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা (Long term plan) :-

দীর্ঘমেয়াদের জন্য এ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। সাধারণত ৫ বছরের বেশি সময়ের জন্য কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলে তা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে অভিহিত হয়ে থাকে।

সে সমস্ত পরিকল্পনা দীর্ঘ মেয়াদের জন্য প্রণয়ন করা হয়, তাদেরকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বলে।

অবশ্য কোনো কোনো বৃহৎ কোম্পানি ১৫/২০ বছরের জন্যও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল মোটরস কর্পোরেশন এদের মধ্যে একটি।

 

কাঠামোভিত্তিক পরিকল্পনার শ্রেণিবিভাগ :-

১. কার্যভিত্তিক পরিকল্পনা (Functional plan) :-

যে পরিকল্পনা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কার্যের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হয় তাকে কার্যভিত্তিক পরিকল্পনা বলে।

যেমন- প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন, ক্রয়বিক্রয় ইত্যাদি বিভিন্ন কাজের জন্য আলাদা আলাদা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এসব পরিকল্পনা তৈরির প্রক্রিয়া হচ্ছে কার্যভিত্তিক পরিকল্পনা প্রক্রিয়া।

 

২. বিভাগীয় পরিকল্পনা (Departmental plan) :-

প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগের জন্য পৃথক পৃথক পরিকল্পনা তৈরি করা হলে সেগুলোকে বিভাগীয় পরিকল্পনা হিসেবে অভিহিত করা হয়। তবে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যের ভিত্তিতে পরিকল্পনা প্রণীত হলে সেক্ষেত্রে কার্যভিত্তিক পরিকল্পনা ও বিভাগীয় পরিকল্পনা একই হয়।

৩. আঞ্চলিক পরিকল্পনা ( Regional or geographical plan) :-

সাধারণত বৃহদায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কিংবা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এ ধরনের পরিকল্পনা তৈরি করে থাকে। আঞ্চলিক বা ভৌগোলিক পরিকল্পনা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অঞ্চল বা শাখার জন্য প্রণীত পরিকল্পনা।

৪. সামগ্রিক পরিকল্পনা (Master plan) :-

প্রতিষ্ঠানের সকল বিভাগ বা অঞ্চলের পরিকল্পনাকে একত্রিত করে। কেন্দ্রীয়ভাবে যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় তাকে সামগ্রিক পরিকল্পনা বা মাস্টার প্লান বলে।

যে কোনো প্রতিষ্ঠানের মাস্টার প্লান সামগ্রিক পরিকল্পনা নামে পরিচিত।

পরিকল্পনার পদক্ষেপ সমূহ :-

পরিকল্পনা হলো ভবিষ্যত-মুখী অর্থাৎ অতীতের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে কী করা হবে তা নির্ধারণ করা হয় পরিকল্পনা প্রক্রিয়ায়। পরিকল্পনায় অনেকগুলো স্তর বা ধাপ রয়েছে। এগুলোকে পরিকল্পনার পদক্ষেপও বলা যায়। পরিকল্পনা প্রণয়ন করার সময় এ পদক্ষেপগুলোকে ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করা হয়। পদক্ষেপ সমূহ নীচে চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।