‘দশরথের প্রতি কেকেয়ী’-পত্রে রামায়ণের সর্ব নিন্দিত নারী কেকেয়ীকে আমরা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য বোধে উদ্দীপ্ত হতে দেখি। চারিত্রিক গুণাবলীর বিচারে কেকেয়ী অবশ্যই সমালোচনার উর্ধে নন, তথাপি তাঁর প্রতি কবি মধুসূদনের সহানুভূতি ছিল আন্তরিক। তিনি পুত্র স্নেহে অন্ধ, স্বার্থ পরায়ণ ও প্রতিহিংসা কাতর তথাপি তাঁর ব্যক্তিত্ব অনস্বীকার্য।

দশরত তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রামচন্দ্রে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন। যখন রাজ্যভিষেকের বিশাল আয়োজন চলতে থাকে, সমস্ত রাজপুরী যখন উৎসবে মাতোহারা ও মগ্ন তখন দাসী মন্থরা কুপারমর্শ দেয় রানী কেকেয়ীকে। তার প্ররোচনায় বাণী কেকেয়ী রাজার পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভয়ংকর দুটি বর চেয়ে বসেন। সেই বর দুটি হল—

দশরথের সমস্ত কাকুতি মিনতি ব্যর্থ হয়। কেকেয়ী জানিয়ে দেন বর দুটি না পেলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। কিন্তু মধুসূদন ‘দশরথের প্রতি কেকেয়ী’ পত্রকাব্যে দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

  • ১। বৃদ্ধ রাজা দশরথের স্ত্রৈণতা।

  • ২। রাজার সত্যভঙ্গ করার অভিমান বুকে নিয়ে কেকেয়ী আত্মহত্যা করার প্রতিজ্ঞা। আত্মহত্যার পূর্বেই বিশ্বজনকে তিনি জানিয়ে যেতে চান রঘুকুলপতি দশরথের ধর্মভ্রষ্টতার কথা। কেননা প্রাচীন রঘুকুলের বিপুল গৌরবের মূলে ছিল সত্যরক্ষার ঐকান্তিক প্রয়াস। কুলমান নয়, কেকেয়ীর কাছে এখানে বড়ো হয়ে উঠেছে তাঁর ভয়ঙ্কর ক্ষোভ। মধুসূদন রামায়ণের চরিত্র কৈকেয়ীকে নিয়ে এক চমৎকার শিল্প সৌন্দর্য নির্মাণ করেছেন এই পত্রিকায়।

কেকেয়ী দশরথকে তীব্র বিদ্রুপ করে বলেছেন যে তিনি পরম অধর্মাচারী। অনেকের মতে এটি অনুযোগ পত্রিকা কিন্তু এখানে আমরা কেন অনুযোগকারিণী নয়, কেকেয়ীকে এক বিদ্রোহিণী নারী রূপে দেখতে পাই। কেকেয়ী চরিত্রটি ব্যক্তিত্বের অহমিকায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, মর্ম পীড়িতা নারীর অন্তরের অভিমান প্রতিপঙক্তিতে ফুটে উঠেছে। এখানে এক প্রগতিশীলা নারীর আপন অধিকার প্রতিষ্ঠার সচেতনতা পরিলক্ষিত হয়। এদিক থেকে কেকেয়ী চরিত্রটি অভিনবত্ব লাভ করেছে।

দাসী মন্থরার মুখে কৌশল্যার পুত্র রামের রাজ্যাভিষেক উৎসব হচ্ছে শুনে কেকেয়ী ব্যঙ্গাত্মক প্রশ্নবাণে দশরথকে জর্জরিত করে তুলেছেন—তিনি হঠাৎ উৎসবের কারণ জানতে চেয়েছেন। রাণী কেকেয়ী জিজ্ঞাসা করেন যে, রাজা দশরথ কোনো শত্রুনিবাশ করার জন্য কি অকালে এই যজ্ঞ শুরু করেছেন, নাকি রাজার কোনো পুত্র জন্মগ্রহণ করেছে। কিংবা কোনও কন্যার বিবাহ স্থির হয়েছে।

অথবা বৃদ্ধা রাজা কি এই বয়সে কোনো রসবতী নারীর মধুর সহচার্য লাভ করেছেন—

পাইলা কি পুনঃ এবয়সে— 

রসবতী নারী ধনে, কহ রাজ ঋষি।

এভাবে কেকেয়ী তাঁর অন্তরের বেদনাকে তীব্র তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের দ্বারা উৎসারিত করে দিয়েছেন। দশরথ নিজ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে রামকে সিংহাসনে বসাচ্ছেন, বঞ্চিত হচ্ছে তাঁর পুত্র ভরত। পুত্রের দাবী ভুলুণ্ঠিত এতে কেকেয়ীর অনুযোগ স্বাভাবিক। কিন্তু সেই সঙ্গে সত্য ভ্রষ্ট ধর্ম চ্যুত দশরথকে ধর্ম মহিষী হিসাবে তিনি ধর্মপথে পরিচালিত করার দায়িত্ব বোধে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। কঠোর ভাষণে অপ্রিয় সত্য বাক্য বলেছেন তিনি—

“অসত্যবাদী রঘুকুল পতি !

নিলর্জ্জ ! প্রতিজ্ঞা তিনি ভাঙেন সহজে।

ধর্মশব্দ মুখে, গতি অধর্মের পথে।”

তীব্র অভিযোগ অনুযোগ ব্যঙ্গের জ্বালা ও প্রতিহিংসা পূর্ণ কটুক্তিতে এই কবিতা অগ্নি স্বাবী। তাঁর চরিত্রে পুত্র স্নেহ সর্বাধিক পুত্রের স্বার্থহানি ঘটায় কেকেয়ী ন্যায় অন্যায় রুচিশীলতা বর্জন করে দশরথকে বারবার আঘাত হেনেছেন। রামচন্দ্রের গৌরবও তিনি স্বীকার করেননি—

কি বিশিষ্ট গুণ

দেখে রামচন্দ্র দেব, ধর্ম নষ্ট কর 

অভীষ্ট পূর্ণিতে তার, রঘু শ্রেষ্ঠ তুমি।

পূর্ব প্রতিশ্রুতি স্মরণ করে দেওয়া সত্ত্বেও দশরথের চৈতন্যোদয় না ঘটলে কেকেয়ী দেশদেশান্তরে ঘুরে পথিক গৃহস্থ রাজা-কাঙাল-তাপস যেখানে যাকে পাবেন তার কাছে বলে বেড়াবেন—‘পরম অর্ধচারী রঘুকুল পতি। এমন কি শুকসারী পুষেও একথা শিখিয়ে দেবেন। পল্লি বালাদেরও একথা শোনাবেন। এভাবে সত্যভ্রষ্ট দশরথের কথা সর্বত্র ব্যক্ত করে তিনি পাপ পুরী অযোধ্যা ত্যাগ করে চিরতরে চলে যাবেন। ভরতকে পাঠিয়ে দেবেন মাতুলালয়ে।

ক্রুদ্ধ রুক্ষ্ম রূদ্র কেকেয়ী পত্রটি যনে এক দুরন্ত বহ্নিশিখা। কেকেয়ী এক কঠিন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যময়ী চরিত্র হয়ে উঠেছে মধুসূদনের হাতে। দৃপ্ত রৌদ্ররসের জীবন্ত প্রতিমূর্তি কেকেয়ী রূপটি তাতে কোনো সংশয় নেই।