জগদীশ গুপ্তের সাহিত্যধারা সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে সমালোচক অনির্বরণ রায় লিখেছেন “আমাদের দেশে সম্প্রতি একটি প্রতিভার আবির্ভাব হইয়াছে, সেটি একেবারে মৌলিক। শ্রীযুক্ত জগদীশ গুপ্ত তাঁর ছোটোগল্প যে ধারা প্রবর্তিত করিয়াছেন, কি প্রাচ্য, কি পাশ্চাত্য, কি প্রাচীন, কি আধুনিক কোথাও তাহার তুলনা নাই বললেই হয়। তিনি Philosophy of Sex বা কামতত্ত্বের বিশেষ ধার ধারেন না, তিনি দেখিতেছেন ভগবান, ধর্ম, নৈতিকতা এসবই যে মিথ্যা শুধু তাহাই নহে, এ সংসারে যে বিধাতা সে এক নির্মম ক্রুর হৃদয় সন্তান …তিনি সর্বত্র দেখিতেছেন শুধু শয়তানি এবং তাহার এই অনুভূতি তাঁহার মধ্যে যে রসের সৃষ্টি করিতেছে তাহারই ভিয়ান করিয়া তিনি তাহার ছোটোগল্পগুলি রচনা করিতেছেন।” কল্লোল গোষ্ঠীর তরুণ লেখকদের তুলনায় একান্তই Antiromatic জগদীশ গুপ্ত বিজ্ঞানী সুলভ নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে সমাজ জীবনের বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং সাহিত্যের পাতায় তার বিশ্লেষণই রূপ দিতেন। আমাদের চারপাশের অতি পরিচিত জীবনের মধ্যে রয়েছে কুটিলতা, ক্রুরতা ও শয়তানি। জগদীশ গুপ্ত তাঁর গল্পগুলিতে সেই শয়তানির স্বরূপ উন্মোচন করেছেন, তবে একমাত্র সত্য যে, তাঁর গল্পে রোমান্টিক ভাবনুতাহীন নির্মম কঠোর বাস্তবের ছবি পাওয়া গেলেও বাস্তবের মধ্যে নিহিত—বিকার বিকৃতি আর মানব মনের সংগোপনে নিহিত কুপ্রবৃত্তিকে তিনি গল্পের শেষ সত্যরূপে উপস্থিত করেননি। তাঁর গল্পে শুভ-অশুভ দ্বন্দ্বের পরিণামে মানবমনের সচেতনায় জয়যুক্ত হয়েছে। ‘পয়োমুখম্’ গল্পটি জগদীশ গুপ্তের সামগ্রিক সাহিত্য ধারার একটি প্রতিনিধি স্থানীয় গল্প। এই গল্পে লেখক একদিকে কৃষ্ণকান্তের বিকৃত অর্থ লিপ্সা, অলুজ নির্মমতা ও বীভৎস নিষ্ঠুরতা যেমন চিত্রিত করেছেন, তেমনি অন্যদিকে কৃষ্ণকান্তের পুত্র ভূতনাথের মধ্য দিয়ে শুভ বুদ্ধি, আত্মসচেতনতা ও সর্বোপরি প্রতিবাদী এক মানসিকতার মধ্য দিয়ে মানবিকতার জাগরণ করিয়েছেন।

‘পয়োমুখম্’ গল্পটি লেখকের ১৯২৭ খ্রি.-এ প্রকাশিত। ‘বিনোদিনী’ নামক গল্প সংকলন গ্রন্থের অন্তর্গত। লোভ ও লালসার বশবর্তী হয়ে ভালোবাসা এবং আপাত মধুর তার অন্তরালে মানুষের মধ্যে যে এক শয়তান বাস করতে পারে, তারই কাহিনি এই গল্পটি। মূলত চরিত্র নির্ভর গল্প হলেও এর মধ্যে পাওয়া যায় এক নিটোল কাহিনি। গল্পের প্রধান চরিত্র কৃষ্ণকান্ত সেনশর্মা। তিনি সংস্কৃত পণ্ডিত এবং কবিরাজ, পরিবারের কর্তাও বটে। তার দুই পুত্র ভূতনাথ এবং দেবনাথ এবং তাঁর স্ত্রী মাতঙ্গিনীকে নিয়ে তাঁর সংসার। কনিষ্ঠ পুত্র দেবনাথ গল্পের কাহিনিতে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেনি। গল্পের মূল কেন্দ্রে রয়েছে পিতা কৃষ্ণকান্ত ও পুত্র ভূতনাথ। উভয়ের বিপরীত ধর্মী চরিত্র। লেখাপড়ার প্রতি প্রচণ্ড অনীহা ভূতনাথের, কিন্তু পিতার ব্যবস্থাদি যে তার কাছে একান্তই অকাম্য, গল্পের কাহিনিতে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কৃষ্ণকান্ত তাঁর শাসন ও দাপটের উপর এমন একটা স্নেহের প্রলেপ দিয়ে রাখেন যা ভেদ করা খুবই মুশকিল। বস্তুত একথা সত্য যে পুত্রের ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে পিতা যেখানে নিজে উদ্যোগী সেখানে তিনি সমাজ ও সংসারের কাছে নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখতে পারেন। তাই সমাজের চোখে কৃষ্ণকান্ত একজন যথার্থ মানুষ হিসাবে চিহ্নিত।

পিতৃস্নেহের দাবীর কাছে ভূতনাথকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হয় ন-বছরের মণিমালিকাকে। যৌতুক হিসাবে আসে সাতশো টাকা। ন-বছরের মণি ভূতনাথের খেলার সাথী হয়ে উঠেছিল কিন্তু যৌবনের সহচরী হয়ে উঠতে পারেনি। অবশ্য সেটা হওয়াও তখন সম্ভব ছিল না। যৌবনের ভরা বসন্তে উপনীত হওয়ার আগে মণিমাল একদিনের জ্বরে মারা যায়। মণির মৃত্যুর পর কৃষ্ণকান্ত তার পুত্রের দ্বিতীয় বিবাহ দেন। এবারে পণ পাঁচশো টাকা পাত্রী অনুপমা অত্যন্ত সুন্দরী যুবতী, স্বভাবে দুরম্ভ। অনুপমার ব্যক্তিত্ব, জিদ ও বুদ্ধি নৈপুণ্য ভূতনাথকে বার বার আঘাত করলেও, সে ভূতনাথের যথার্থ হৃদয় সঙ্গিনী হয়ে উঠতে‌ পেরেছিল, কিন্তু অনুপমাও দীর্ঘজীবন লাভ করল না, সেও একদিনের জ্বরে “মণিমালিকার অনুগমন করিল।” দ্বিতীয় পত্নীর মৃত্যুর পর বিয়ের প্রতি এবং সংসারের প্রতি ভূতনাথের আসক্তি অনেকটাই কমে যায়। সে আর বিয়ে করতে রাজী হয় না। কিন্তু কৃষ্ণকান্ত বিষয়ী মানুষ। তার ক্ষুরধার যুক্তির কাছে শেষ পর্যন্ত পরাজিত ভূতনাথ নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়ে করে ‘কালো মেয়ে’ বীণাপাণীকে।