সমলোচক অনিলবরণ রায় একদা মন্তব্য করেছিলেন—সেটি আমাদের দেশে সম্প্রতি একটা প্রতিভার আবির্ভাব হইয়াছে, সেট একেবারে মৌলিক। শ্রীযুক্ত জগদীশ গুপ্ত তাঁর ছোটোগল্পে যে ধারা প্রবর্তিত করিয়াছেন, কি প্রাচ্য কি পাশ্চাত্য, কি প্রাচীন, কি আধুনিক কোথাও তুলনা নাই।” আসলে জগদীশ গুপ্ত বিজ্ঞানী সুলভ নির্মোহ দৃষ্টি ভঙ্গি দিয়ে পারিবারিক সমাজকে প্রত্যক্ষবাদের বশবর্তী না হয়েই তিনি সমাজ বাস্তবতাকে সাহিত্যের পাতায় বিশ্লেষণী রূপ দিতেন। আমাদের চারপাশের অতি পরিচিত জীবনের মধ্যে যে এত জটিলতা, এত ক্রুরতা, এত শয়তানী আছে জগদীশ গুপ্তের নির্মোহ বাস্তবতার গল্পগুলি তার সঙ্গে পাঠকের পরিচিত করেছে। তার বিখ্যাত ‘পয়োমুখম্’ গল্পটি এই অভিধান ভূষিত। গল্পটিতে একদিকে যেমন লেখক কৃষ্ণকান্তের বিকৃত অর্থলিপ্সা, অলজু নিমর্মতা ও বিভৎস নিষ্ঠুরতাকে চিত্রিত করেছেন, তেমনি কৃষ্ণকান্তের পুত্র ভূতনামের মধ্য দিয়ে শুভবুদ্ধি, আত্মসচেনতা সর্বোপরি এক পতিবাদী মানসিকতাকে ধীরে ধীরে নিকশিত করে তুলেছেন। গল্পের পরিণতিতে কৃষ্ণকান্তের পরায়জয়ই সচেতন নিরাভরণ প্রকাশ গল্পকাহিনিতে অধিকতর গুরুতে পেলেও ভূতনাথের সচেতন মানসিকতার ক্রম উন্মোচন গল্প পাঠকের নজর এড়ায় না।
‘পয়োমুখম্’ গল্পে একটি নিটোল কাহিনি আছে। কবিরাজ শ্রীকৃষ্ণকান্ত সেনশর্মার পরিবারকে কেন্দ্র করে এ গল্পের প্লট নির্মিত। কৃষ্ণকান্তের পরিবারের চার সদস্য। স্ত্রী মাতঙ্গিনী ও দুইপুত্র ভূতনাথ ও দেবনাথ। কৃষ্ণকান্তের জ্যেষ্ঠপুত্র ভূতনাথ একটু নির্বোধ প্রকৃতির। পড়াশুনায় তার বিশেষ আগ্রহ নেই। “তাই ষোলো সতেরো বৎসর পর্যন্ত বিদ্যালয়ে তামাসা করি কাটাইয়া সর্বাপেক্ষা সহজবিদ্যা আয়ুবেদ আয়ত্ত কারীতে বদ্ধ পরিকর সে নিশ্চয় হয় নাই—সম্মত হইয়াছে।” আসলে ভূতনাথের ভবিষ্যত্ত সম্পর্কে আশংকান্বিত হয়ে কিছুটা জোর করে কৃষ্ণকান্ত ভূতনাথকে আয়ুবেদ শেখাতে শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে কৃষ্ণকান্ত ভূতনাথের বিবাহ স্থির করলেন। কৃষ্ণকান্ত বিষয়ী লোক। তিনি জানতেন নির্বোধ পুত্রের বিবাহে বিশেষ বরপণ আদায় হবে না। তার প্রচুর অর্থলিপ্সাকে চরিতার্থ করতে মিথ্যা প্রচার করলেন—“ভূতনাথ কালিমাতার বিখ্যাত প্রবীন কবিরাজ শ্রী গোপালকৃষ্ণ দাশগুপ্ত মহাশয়ের প্রিয়ছাত্র।” এই মিথ্যা বিজ্ঞাপনে যথারীতি ভূতনাথকে বিবাহ হয়ে গেল—“স্ত্রী মনিমালিকা ন বছরের—পণ সর্বসাকুল্যে সাতশত টাকামাত্র।” এখান থেকে ভূতনাথের চরিত্রের উত্তরণ সূচিত হল। দাম্পত্য জীবনের মাধুর্য ও সরসতার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটল। কিন্তু ভূতনাথের দাম্পত্য সুখ বেশিদিন স্থায়ী হল না—মাত্র একদিনের জ্বরে ভুগে ভেদ বমি করে মনিমালিকা মারা গেল।
অচিরেই কৃষ্ণকান্ত ভূতনাথের দ্বিতীয়বার বিবাহ দিতে মনস্থ করলেন। তাঁর শুদ্ধি—“স্বয়ং শিব দুবার বিবাহ করিয়াছিলেন।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মনির মৃত্যুর পশ্চাতে কৃষ্ণকান্তের দুরভিসন্ধি ছিল বিস্তর হয়ত তিনি একটু তৎপর হলেই মমি বাঁচতো। যাইহোক, প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর আটদিনের মধ্যে কৃষ্ণকান্ত অর্থলোভ ভূতনাথের জন্য পাত্রী নির্বাচন করে রেখেছিলেন। সুতরাং ভূতনাথের দ্বিতীয় বিবাহ হয়ে গেল—“এবার পণ; একশত টাকা।” ভূতনাথের দ্বিতীয় স্ত্রী অনুপমা যথেষ্ট সুন্দরী তবে স্বভাব চরিত্রে রূঢ় ও মুখরা। তার রূপে সবাই মুগ্ধ হলেও স্বভাবের রূঢ়তার সবাই অসন্তুষ্ট। কারণ “অনুপমা যে মনি নয়”। একদিকে রূপাশক্ত ও অন্যদিকে কলহের কশাঘাত ভূতনাথের দিনকাটতে লাগল। কিন্তু কৃষ্ণকান্তের অর্থলিপ্সার ক্ষান্তি নেই। টাকার অঙ্কেই জীবনের পরিমাপ করতে তিনি অভ্যস্ত। তাই অল্পদিনের মধ্যে অনুপমা— মনিমালিকার মতোই অসুস্থ হয়ে পড়ল, প্রথমে জ্বর জ্বরত্ত—তারপর ভেদবমি-অবশেষে—“অনুপমা মনিমালিকার অনুগমম করিল।” লেখক তাঁর ইঙ্গিত ধর্মী ভাষায় মণি ও অনুর মৃত্যুকে এমনভাবে ভাবেন না বর্ণনা করলেন—“মনি মরিয়াছিল, বৈশাখের কাঁচা আম খাইয়া, অনুপমা মরিল, অজীর্ণ রোগের ওপর জিদবশে অতিরিক্ত গুরুপাক দ্রব্য উদ্রস্থ করিয়া।” প্রসঙ্গত জেনে রাখা দরকার অনুপমার মৃত্যু কৃষ্ণকান্তের পরিবারের সকলে কান্নাকাটি করলেও কৃষ্ণকান্তের মধ্যে কোনরকম শোক বা অশ্রু স্পষ্ট রূপে প্রতিভাত হয়নি।
অনুপমার মৃত্যুর পর ভূতনাথ কেমন পরিণতি হয়ে উঠল। কারণ, অনুকমার মৃত্যু ভূতনাথের মনে গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। এই শূন্যতা থেকে মুক্তি পেতে ভূতনাথ আয়ুবের্দ শাস্ত্রের মধ্যে আশ্রয় পেতে চেয়েছে। ফলে সে খুব দ্রুত কলাপ, মুগ্ধবোধ এবং পরবর্তী অন্যান্য গ্রন্থগুলি অধ্যায়ন সমাপ্ত করে সে একজন পুরোপুরি করিরাজ হয়ে উঠেছে। কেবল কবিরাজ নয় ভূতনাথের মনে কিছুটা প্রতিবাদী মানসিকতার লক্ষণগুলি প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। আগের দুটি বিবাহে ভূতনাথ পিতৃকাব্যে শিরোধার্য বলে মেনে মিলেও তৃতীয়বার বিবাহে অসম্মত হলে কৃষ্ণকান্ত তাকে ভর্ৎসনায় অভিযোগে অনুযোগে নাস্তামাহদ করে। ছাড়ল। ভূতনাথ থেকে অচল কৃষ্ণকান্তের কাছে হার মানতে হল।” পিতৃদেবের অবিশ্রান্ত তাড়নায় মরিয়া হইয়াই একদিন বলিয়াই দিল যা ইচ্ছে করুন।” কৃষ্ণকান্ত এই সম্মানটুকুর জন্য ছিলেন পণ ও পাত্রী উভয়ই নির্দিষ্ট ছিল। সুতরাং ভূতনাথের বিবাহ হয়ে গেল—পণ আটশত টাকা ও স্ত্রী বীণাপানি। বীণাপানি কালো, তাই আপন গুণের দ্বারা পরিবারের সকলের মন জয় করে নিল। কিন্তু মাঝে মাঝে কৃষ্ণকান্তের নামে মানি অর্ডারে টাকা আসে। একদিন তাও ভূতনাথ জানলো—বীণাপানি কালো, তাই তার বাবা প্রতি মাসে কৃষ্ণকান্তবাবুকে দশটি করে টাকা খেসারত দেন। ভূতনাথের মনে সন্দেহ জাগে, তার আগের দুজন স্ত্রীর মৃত্যুর কারণও যেন তার মনে নাড়া দেয়। তাই নিজের তাৎপরায়তা শ্বশুরকে টাকা পাঠানো বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়। অর্থাৎ ভূতনাথ এখন আত্ম সচেতন।
গল্পের অন্তীমাংশে দেখাযায় বীণাপানির জ্বর। সাতঙ্গিনী বিপদের আশংকায় ঈশ্বরকে স্মরণ করেন। সর্বক্ষণ পুত্রবধূর কাছে এসে থাকেন। কিন্তু তাঁর মুহূর্তের অনুপস্থিতির সুযোগ কৃষ্ণকান্ত কাপড়ের আড়ালে লুকানো থল থেকে ঔষুধ দিয়ে যান বীণাপানিকে। কিন্তু এবার ভূতনাথ সতর্ক। কৃষ্ণকান্ত ঘর থেকে বেরোনো মাত্রই ভূতনাথ এসে হাজির। শ্রীকে জিজ্ঞাসা করে সে বাবার দেওয়া ঔষধ খেয়েছে কিনা। এদিকে কৃষ্ণকান্ত বড়োই তৃপ্ত, কারণ বীণাপানির মরণবান তার হাতে সে তুলে দিতে পেরেছে। আবার বর পণ, আবার অর্থাগমের পথ যে দুর্গম। কিন্তু এ স্বপ্ন তার সার্থক হল না। পিতার অমানবিকতা অর্থলিপ্সা এবং জঘন্য নরহত্যার বিরুদ্ধে জলন্ত প্রতিবাদে উদ্ভাভিত হয়ে ভূতনাথ বাবার সম্মুখে হাজির হয়ে বলে—“এ বৌটার পরমায়ু আছে, তাই কলেরায় মরলাম বাবা, পারেনতো নিজেই খেয়ে গেলুম।” কাহিনির অন্তীমে ভূতনাথের এই বিদ্রুপ যেমন বাবা কৃষ্ণকান্তকে অশ্রদ্ধায় অবজ্ঞায় বিদ্ধ করেছে তেমনি সে বিদ্রূপ কসাইকে নিবৃত্ত করে জীবন বাঁচতে পারার মহত্বে আনন্দে উজ্জ্বল।
সর্বোপরি, গল্পটির নামকরণও বিশেষ তাৎপর্যবহ, পয়োমুখম্ নামটি বিধকুম্ভের অনুসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। যে কুম্ভ বা কলস বিষ বা গরলে পূর্ণ অথচ তার মুখটি পয় বা অমৃত দিয়ে ঢাকা থাকে সেরূপ কুম্ভ বা কলসকে ‘পয়োমুখম্’ বলা যায়। এ গল্পে কৃষ্ণকান্ত চরিত্রটি হল পয়োনম বিষকুম্ভ, কবিরাজের ছদ্মবেশে নিজের অর্থ লিপ্সার চরিতার্থতায় তিনি একের পর এক হত্যালীলা চালিয়ে গেছেন অথচ আচার অনাচারে কাউকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করতে দেননি। তাই কৃষ্ণকান্তের নিষ্ঠুর কসাইরূপী চরিত্রের অনুকরণে গল্পের নামকরণ অর্থবহ হয়েছে এবং লেখকের নির্মোহ বাস্তব দৃষ্টি সুন্দর ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
Leave a comment