বাংলা সাহিত্যের সূচনা লগ্ন থেকেই নারী চরিত্র এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়ে এসেছ। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, বৈশ্ববপদাবলী ও শাক্তপদাবলীতেও নারীর মনোবেদনা, অন্তর্দহনই মুখ্য হয়ে উঠেছে। ঊনবিংশ শতকের রেনেসাঁসের আলোকে বিদ্যাসাগর, রামমোহন যখন সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তার পেছনেও ছিল এই নারী জাতিরই দুর্দশামোচনের অভিপ্রায়। আধুনিক যুগের বাংলার সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় প্যারিচাঁদ, বঙ্কিম, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের রচনাতে নারী চরিত্রের উজ্জ্বল ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। বলাবাহুল্য, রেনেসাঁসের দীপ্ত প্রভায় সাহিত্যের এই নারীরা সহজেই হয়েছে আলোকিত রবীন্দ্রসাহিত্যে সুমিত্রা, অপর্ণা, মালিনী, চিত্রাঙ্গদা, গান্ধারী, নন্দিনী প্রভৃতি চরিত্র ছাড়াও বিনোদিনী, দামিনী, কুমুদিনী-চরিত্রে নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, নীতিজ্ঞান, আত্মমর্যাদাবোধ যেভাবে লক্ষ্য করা যায় তা পরবর্তীকালের কমলা-কিরণময়ী-সত্যবতী-নীলা (কিনুগোয়ালার গলি), মাধবীলতা (কালবেলা, সমরেশ মজুমদার) প্রভৃতি নারী চরিত্র সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছে নারী চরিত্রগুলিকে বৈশিষ্ট্যানুসারে তিনটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায়—

  • ১) সমাজ ও স্বামী কর্তৃক লাঞ্ছিতা ও অত্যাচারিতা। 

  • ২) নর-নারীর চিরন্তন প্রেমসম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠা। 

  • ৩) সামাজিক শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠা।

আমাদের আলোচ্য ‘পয়লানম্বর’ গল্পটিতে এরকমই এক ব্যতিক্রমী নারী চরিত্র অনিলা নর-নারীর চিরন্তন প্রেমের জটিলতা অপেক্ষা আত্মমর্যাদাবোধে বলিষ্ঠ এক নারীর মনস্তত্ত্বের উন্মোচনই গল্পের মূল উদ্দেশ্য। লেখক গল্পগুচ্ছের প্রথম খণ্ডের গল্পগুলি লেখার সময় পদ্মার বুকে বোটে চড়ে ঘোরার অবসর পেয়েছিলেন। ফলে পল্লীপ্রকৃতির মানুষের সাথে নিবিড় ভাবে মেশার সুযোগ পেয়েছেন। নির্জন স্বজনের নিত্য সমাগমের পালায় তিনি মানুষের সম্পর্কগুলির সহজ, সরল রূপটি প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন। যার ফলস্বরূপ মমতাময়ী চরিত্রের অভাব ঘটেনি এই পর্বের রচনাতে। তবে শুধু এই পর্বেই নয়, তার ছোটগল্পের অনেক চরিত্রেই এই মায়ামমতার সাথে চরিত্রগুলির আত্মমর্যাদাবোধ তাদের ভিন্নমাত্রা দান করেছে। যেমন, ‘খাতা’, ‘দেনাপাওনা’, ‘পয়লানম্বর’, ‘স্ত্রীর পত্র’, প্রভৃতি গল্পের নাম করা যায়।

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর উদাসীনতার প্রেক্ষিতে এক আত্মকেন্দ্রিক নায়ক স্বামীর কথনে গল্পটি বিবৃত। আর এক আত্মকেন্দ্রিকতার চরম স্বার্থপরতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বাধ্য হয়ে জীবনের সারবস্তু খুঁজে পেতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয় ব্যক্তিত্বময়ী অনিলাকে। গল্পটির নামকরণটিও তাৎপর্যমণ্ডিত। গল্পের নায়ক—কথক গ্রন্থকীট অদ্বৈতচরণ। ব্যস তার গলির দ্বিতীয় নম্বর বাড়িতে। প্রথম বা পয়লানম্বরে থাকত তার বিপরীত স্বভাবের সিতাংশু মৌলি। তৃতীয় নম্বরে এক স্বাভাবিক ভদ্রলোক। স্বাভাবিক এই কারণেই অদ্বৈতচরণের কাছে পয়লা নম্বরের লোকটি একটি উপদ্রব ছাড়া আর কিছু নয়। গাড়ি, ঘোড়া, লোক, লস্কর, নিয়ে—সে যেন দশটি মাথা, কুড়িটি হাতের পালা জমিয়েছে, যার জ্বালায় অদ্বৈতচরণের সারস্বত স্বর্গ লোকটির বেড়া রোজ ভাঙতে শুরু করেছে। বিনা সংগীতেই তার পোষ্য ঘোড়াগুলির তালটোকা, উড়ে বেহারা, ভোজপুরি বেহারা, তাঁর পাড়ে তেওয়ারি দারোয়ানের দল কেউই মিতভাষীতার পক্ষপাতী নয়। ফলে তার শান্ত, সমাহিত জীবনে অকস্মাৎ যে উপদ্রবের ঢেউ এসে আছড়ে পড়তে লাগল তা সহ্যকরা স্বাভাবিক ভাবেই কঠিন হয়ে পড়ল। অদ্বৈতচরণের স্ত্রী অনিলা বাবার বড়ো আদরের মেয়ে। তিনি মারা যাবার সময় তার দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে সরোজের লেখাপড়া ও ভরণপোষণের দায়িত্ব তার মেয়েকে দিয়ে যান। সাথে নগদ সাড়ে সাতহাজার টাকা। কিন্তু ভাই-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করার মত সময় বা ইচ্ছা কোনটিই সে গ্রন্থকীট স্বামীর কাছে দেখতে পায়নি। ফলে নিজেই সে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি রসনাচর্চাতেও পটু অদ্বৈতচরণ তার দলবল কে পূর্ণিমার আসরের দিন মাছের কচুরি-আর বিলাতি আমড়ার চাটনি তৈরীর দায়িত্ব অনিলাকে দেয়। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে তাদের কোনও আত্মিক যোগ ছিল না। ফলে মনের গভীরে কার কি খেলা চলছে, তার পরিণাম কি হতে পারে সে সম্পর্কে জানতে অদ্বৈতচরণ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। অথচ উদ্দাম, উদ্যত, পাড়ার নতুন উপদ্রব সিতাংশু মৌলি এই ফাঁকফোকর দিয়েই কবে অদ্বৈতর বিবাহিত জীবনে উঁকি মারতে শুরু করেছে তা অদ্বৈতর পক্ষে বোঝা বা জানা কোনটাই সম্ভবপর হয়নি। কারণ সে তো বোঝে শুধু নিজের টুকু। নিজের বলে দাবী করে তাদের চারদিকে স্বার্থপরতার প্রাচীর তুলে রেখেছিল সে নিজেরই অজান্তে। ফলে বাইরের লোকেরা এই প্রাচীরে ছিদ্র করে উঁকি মারবে এটাই তো খুব স্বাভাবিক। অনিলার প্রতি অদ্বৈতর অবেহলা, উদাসীনতার খবর চাপা থাকেনি। ফলে সিতাংশু মৌলির প্রলুব্ধ দৃষ্টি অনায়াসেই এসে পড়েছিল অনিলার অবহেলিত নারী জীবনে। অনিলার কাছেও এ খবর চাপা থাকে নি। ফলে অদ্বৈতর উদাসীনতার সীমা দিন দিন যত ব্যাপ্ত হয়েছে, অনিলার অভিমান হয়েছে তার থেকেও অনেক বেশি ব্যাপ্ত। আর এই উদাসীনতাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই হোক, জন্ম দিয়েছে অনিলার আত্মমর্যাদাবোধ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বোধকে, যা অনিলাকে স্বামীর কাছ থেকে বহু দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। সে কারণেই সে ভাই এর মৃত্যুর খবরও স্বামীর কাছে চেপে রেখে স্বামীর ফরমায়েস খেটে দলবলের জন্য রান্না করে দিয়েছে মাছের কচুরী আর বিলাতি আমড়ার চাটনি।

স্ত্রী প্রতি স্বাভাবিক বিশ্বাসেই অদ্বৈতচরণ কোন ও গণ্ডীতে অনিলাকে বেধে রাখেনি। কিন্তু তার চরম স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতাই তাদের দুজনের চারপাশে এক বিশাল প্রাচীর তুলে দিয়েছে। সাহিত্য রসিক অদ্বৈত এটা বুঝতে পারেনি সে বাস্তবটা বড়ো কঠিন। শুধু সাহিত্যচর্চা দিয়ে একটা গোটাজীবন, সংসার চলতে পারে না। জীবনের খাতা অনেক বড়ো। সেখানে অন্য ভাষায়, অন্য বিদ্যায়, অন্য কালিতে লিখতে হয়। সে ভাষা বা বিদ্যা কোনটাই অদ্বৈতর জানা ছিল না। তাই জীবনরসিক সীতাংশু মৌলিকে সে উপদ্রব মনে করেছে। আসলে জীবনকে উপভোগ করতে না পারার জ্বালা থেকেই এ ঈর্ষার জন্ম।

গল্পের শেষে আমরা দেখি অনিলা তার চিঠিতে বলে গেছে—আমি চললুম। আমাকে খুঁজতে চেষ্টা করো না। করলেও খুঁজে পাবে না। অনিলার এই চিঠি পড়ে অদ্বৈত প্রথমে ভেবেছে—“হঠাৎ বুঝতে পারলুম, আমি যখন একমনে নব্যতম ন্যায়ের আলোচনা করছিলুম তখন মানব সমাজের পুরাতনতম একটি অন্যায় আমার ঘরে জাল বিস্তার করছিল। ফ্রোবেয়ার, টলস্টয়, টুর্গে-নিভ প্রভৃতি বড়ো বড়ো গল্পলিখিয়েদের বইয়ে যখন এই রকমের ঘটনার কথা পড়েছি তখন বড়ো আনন্দে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম করে তার তত্ত্বকথা বিশ্লেষণ করে দেখেছি। কিন্তু, নিজের ঘরেই যে এটা এমন সুনিশ্চিত করে ঘটতে পারে তা কোনদিন স্বপ্নেও কল্পনা করিনি।” কিন্তু পরে সে যখনই অনিলার প্রয়োজনটা উপলব্ধি করতে পেরেছে তখনই তার বুকের মধ্যে হা হা করে উঠেছে। অনিলাকে লেখা সিতাংশ মৌলির চিঠিগুলি একাধিক বার পড়ে সে বুঝতে পেরেছে ক্ষণকালের ফাঁক দিয়ে যে অনিলাকে সিতাংশু বুঝেছে, আট বছরের বৈবাহিক সম্পর্কের স্বামী হয়েও সে তা পারে নি। তাই সিতাংশুর কাছে গেলে অনিলাকে চোখের দেখা দেখতে পারে—পুরুষ মনের এই স্বাভাবিক বিশ্বাস নিয়েই সে মুসৌরি যায় সিতাংশুর কাছে। কিন্তু সেখানে গিয়েই তার চমক ভাঙল। দেখতে পেল তার কাছে লেখা চিঠির অপর অংশটি, একই চিঠি সিতাংশুর কাছে ও রয়েছে। কাছে পেয়েও অনিলার নারীত্বের প্রতি কোন মর্যাদা দেয়নি অদ্বৈত। অন্যদিকে অনিলার অবহেলিত নারীত্বের প্রতি সে দৃষ্টিপাত করে সিতাংশু তাকে কাছে পেতে চেয়েছে তা অনিলার জীবনের অবমাননার পরিমাণকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই জীবনের খণ্ডাংশের মধ্যে বা পূর্ণতার মধ্যে কেউই অনিলাকে ধরতে পারেনি।

সামাজিক শোষণ, নিগ্রহ, অবমাননা যুগযুগ ধরেই নারীজাতির প্রাপ্তি যোগে বর্তমান। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পুরুষ শাসিত সমাজে নারকে লাঞ্ছিতা করেই রাখেননি। তাই দেখি ‘দেনাপাওনা’ গল্পে সামাজিক শোষণ ও নিগ্রহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বাবার কাছে নিরুপমাকে মুখ খুলতে দেখি। ‘ত্যাগ’ গল্পে ও দেখি অসবর্ণ বিবাহকে কেন্দ্র করে নববধূর প্রতি শ্বশুর বাড়ির অমানবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবশ্য নায়ক সোচ্চার হওয়ার নববধূর পরিণাম নিরুপমার মতো করুণ হয়নি। আবার ‘শাস্তি’ গল্পে চন্দরা স্বামীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে মৃত্যুকে যেভাবে বেছে নিয়েছে, বাংলা সাহিত্যে এরকম দৃষ্টান্ত বিরল। আলোচ্য ‘পয়লা নম্বরেও দেখি পুরুষ শাসিত সমাজে নারী কেবল পুরুষের অধিকারের সামগ্রী—এ বিশ্বাসে অনিলা নিজেকে সংসার ও স্বামীর গণ্ডীর চারপাশে নিজেকে আটকে রেখে অপমান সহ্য করেনি। নারীমর্যাদা রক্ষার অভিপ্রায়ে সে যেভাবে প্রতিবাদের পথ বেছে নিয়েছে, তা সমাজের কাছে ব্যতিক্রমী ও দৃষ্টান্তমূলক প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেই উচ্চারিত।