শেকসপিয়র বলেছিলেন ‘What is a name’ অর্থাৎ নামে কি আসে যায় ? কিন্তু এ বক্তব্য সর্বত্র গ্রহণীয় নয়। বাস্তব জগৎকে বাদ দিলে সাহিত্য জগতে নামকরণই মুখ্য বিষয়, নামের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে তার কাহিনি বা ঘটনার ধারাবাহিকতা। অর্থাৎ নামকরণকে বাদ দিয়ে কোনো সাহিত্য এবং সম্পূর্ণ হতে পারে না। আলোচ্য গল্পের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা চলে। গল্পের নায়ক তথা লেখক জানিয়েছেন, তিনি ও তাঁর স্ত্রী অনিলা শহরের কোনো এক গলিতে অবস্থিত যে বাড়িতে ছিলেন সেটা দ্বিতীয় নম্বর, পয়লা নম্বরের বাড়িতে দীর্ঘদিন যেন ভাড়াটিয়া নেই। এই পয়লা নম্বরের বাড়িটাই ছিল তৎকালী বিখ্যাত ধনী মহাজন উদ্ভব বড়াঙ্গের, বংশের অধিকাংশের অকাল প্রয়াণে বাড়িতে আর বসতি গড়েনি।
লেখকের বিদ্যার তেজ ততখানি না থাকলেও সাহিত্যের তেজ বিশেষ ছিল। শুধু কি সাহিত্য ? বিশ্বের নানাকরম তত্ত্ব, তথ্য, বিষয় নিয়ে তিনি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা মগ্ন থাকতেন। বিজ্ঞান থেকে শুরু করে রাজনীতি পর্যন্ত মাঝে মাঝে মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াত। আড্ডা বসত লেখকের এই দুই নম্বর ভাড়াটে বাড়িতে। রাতে আড্ডা শেষে সকল বন্ধুরা একসাথে আহার সমাধা করে তবে বাড়িতে ফিরতো, এই দিয়ে অনিলাকে কম ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হত না। কিন্তু অনিলা স্বামীর বিরুদ্ধে কোনোদিন প্রতিবাদ করেনি কেবল কলুর বলদের মতো নীরবে সব করেছে।
সাহিত্য বিজ্ঞান বিষয়কে প্রভৃতি আলোচনা নিয়ে মগ্ন থেকে লেখকের দিনগুলো বেশ ভালো কাটছিল। হঠাৎ একদিন শুরু হল নতুন উপদ্রব পয়লা নম্বরের ভাড়াটিয়া হয়ে এসে হাজির নরোত্তম পুরের জমিদার রাজা সীতাংশু মৌলি। দিন দুয়েক না কাটতেই ‘সীতাংশু মৌলির উদ্ভট আচরণে লেখক বিরক্তবোধ করতে থাকলেন, এবং বন্ধু মহলে তাকে নিয়ে বিরাট সমালোচনার ঝড় তুললেন। শুধু কি তাই সীতাংশু মৌলির মধ্যে বহু গুণের পরিচয় পেয়ে মনে মনে তাঁকে ঈর্ষা করতে থাকলেন।
আলো যেমন পতঙ্গকে আকর্ষণ করে, ঠিক তেমনি সীতাংশু মৌলি ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আকর্ষণের ফাঁদ পাতলেন,—কোনো দিন লেখকের চাকাবাটী বল জুড়িয়ে দেবার জন্য সীতাংশু মৌলির নিকট তন্ত্ত বখশিষ পায়। ইয়ার দেব তথা আড্ডার বন্ধুরা সীতাংশু মৌলির সংগীত প্রিয় মুগ্ধ হয়ে একে একে তাঁর আসরে জমায়েত হতে থাকে। এমনকি গানবাজনার শেষে সেখানে আহার সমাধা করেই তবে তারা বাড়িতে ফেরে।
লেখক প্রত্যক্ষ করলেন তাঁর সাহিত্যের ক্রমশ ভাঙতে শুরু করেছে, বন্ধুরা কদাচ তাঁর কাছে ত্রাসে এলেও আসর জমে না, প্রত্যেক একে একে সীতাংশু মৌলির নিকট গিয়ে আড্ডা দিতে থাকে। লেখক মনে মনে সীতাংশু মৌলির প্রতি ঈর্ষা অনুভব করলেন এবং পয়লা নম্বরের এই অহেতুক উৎপাতকে মন থেকে মেনে নিতে পারলেন। তাঁর স্ত্রী অমিলা ও ক্রমশ পয়লা নম্বরের অকারণ উৎপাত এবং উল্লাসে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। সে অবিলম্বে বাসা বদল করতে চায়। লেখকের ও অভিমত। তবে এই ঘিঞ্জি শহরের বুকে তাড়াতাড়িতো বাসা মেলানো সম্ভব নয়। কাজের যতদিন না হচ্ছে ততদিন অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।
পয়লা নম্বরের প্রতি লেখক ও স্ত্রী অনিলা যখন ক্ষুদ্ধতায় ঈর্ষার বিরক্তিতে তুঙ্গে। তখন লেখকের অজান্তে ঘটে গেল এক চরম অঘটন। অনিলার ভাই পরীক্ষাতে ফেল করে আত্মহত্যা করেছে, সেই মৃতদেহ সীতাংশু মৌলির তৎপরতায় থানা পুলিশকে এড়িয়ে দাহ করা হয়। লেখক এসবের ঘুণাক্ষর জানতেন না পরে বন্ধুদের কাছ থেকে শুনে মনে মনে বিব্রত বোধ করেন সে কাজ তাঁরই কথার কথাগুলি সেই কাজ সীতাংশু মৌলি করেছেন স্ত্রীর কাছে নিজেকে অপরাধী এবং ছোটো বলে মনে হল।
ভায়ের মৃতদেহ সৎকার করে ফিরে সেইদিন রাত্রে পরম আদরে স্বামীকে খাইয়ে অনিলা রাতের অন্ধকারে চিরদিনের জন্য ঘরছেড়ে নিরুদ্দেশের প্রতি পা বাড়ায়, যাওয়ার সময় একটুকরো কাগজে লিখে গেছে—“আমি চললুম। আমাকে খুঁজতে চেষ্টা কোরো না। লেখক ভালোভাবে মেনে নিতে পারেননি। খবর নিয়ে জানলেন গতকাল বিকালেই সীতাংশু মৌলি ও বলে গেছেন, তখন বুঝলেন—“আমি যখন একমনে নব্যতম ন্যায়ের আলোচনা করছিলুম তখন মানব সমাজের পুরাতনতম একটি অন্যায় আমার ঘরে জাল বিস্তার করছিল।” ধারণা বদ্ধমূল হয় সীতাংশু মৌলির সঙ্গে অনিলা ঘর ছেড়েছে। এই সত্যে পরিণত হয়, একদিন পঁচিশটি প্রণয়পূর্ণ চিঠি আবিষ্কৃত হওয়ার পর। মানসিক দিক থেকে ভেঙে পড়লেন এবং নিজের অবহেলা অনাদরের কথা স্বীকার করে আজ আটবছরের ঘনিষ্ঠতার পর এই পরের চিঠিগুলির ভিতর দিয়ে তাকে দেখলুম।…..পুরোহিতের হাত থেকে অনিলাকে পেয়েছিলুম, কিন্তু তার বিধাতার হাত থেকে তাকে গ্রহণ করবার মূল্য আমি কিছুই দিইনি।”
অনিলাকে একবার শেষবারের মতো চোখের দেখা দেখতে সীতাংশু মৌলির সন্ধান পেয়ে মসূরি পাহাড়ে গিয়ে জানলেন অনিল তাঁর সঙ্গে নেই। এবং তিনি পঁচিশটি প্রণয়মূলক চিঠি লিখতেও অনিলা তাঁকে একটিমাত্র চিঠি শিখেছে—“আমি চললুম, আমাকে খুঁজতে চেষ্টা করো না, করলেও খোঁজ পাবে না।” লেখক বুঝলেন—“সেই অক্ষর সেই লেখা, সেই তারিখ এবং যে নীল রঙের চিঠির কাগজের অর্ধেকখানা আমার কাছে এই দুকরোটি তারই বাকি অর্ধেক।” এর মর্মাত্মা কি তা সহজ বোধ্য।
সবমিলিয়ে বলতে হয় পয়লা নম্বরের বাসিন্দা সীতাংশু মৌজির জন্যেই—চাকর থেকে শুরু করে বন্ধু। বান্ধব এমনকি তাঁর স্ত্রী অনিলা ও পর্যন্ত মানসিক দিক দিয়ে লেখকের বিপরীত পথে চলতে শুরু করেছিল। শেষ পর্যন্ত লেখক নিজেও বুঝলেন সীতাংশু অনিলকে চিঠিতে যা লিখেছেন তা লেখকেরই স্বভাবগণ হওয়া উচিত ছিল। একার্থে তিনিও সীতাংশুর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন, অর্থাৎ পয়লা নম্বরই সমগ্র গল্পটির ধারক ও বাহক হওয়ার নামকরণের দিক দিয়ে সার্থকতায় পর্যবসিত হয়েছে।
Leave a comment