বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে ছোটোগল্প রচনার আধিক্য, কিছুটা যুগপটভূমি ও পাশ্চাত্য প্রভাবে দীপ্র হলেও ছোটোগল্পের Content ও From শিক্ষিত মানসে সাড়া ফেলেছিল। এই ছোটোগল্প কী বস্তু তা নিয়ে সাহিত্য সমালোচকদের মাথাব্যথার অন্ত নেই। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই এর একটা সমাধান করে দিয়ে গেছেন, তা হল রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পগুলি বিশেষ এক আদর্শকে সামনে রেখে লেখা হলেও ছোটোগল্পের যে বিশেষ ঘরানা স্বীকৃত তা ব্যতীত হয়। পয়লা নম্বর গল্পের মূল্যবান বিষয় তা ভাষার বুদ্ধিদীপ্রতা এবং বিষয়মুখীনতা হলেও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে গঠনরীতি অনুসৃত তা ছোটেগল্পে’রই।

গল্পটি আত্মকথনের ভঙ্গীতে লেখা। লেখক নিজেকে একবার অদ্বৈতচরণ বলে পরিচয় দিয়েছেন। জীবনের একটি মূল্যবান ঘটনাকে বিবৃত করতে গিয়ে তিনি তাঁর মনস্তত্ত্বের এক সুনিপণ নিদর্শন দিয়েছেন। সামাজিক ক্রিয়াকলাপের বাইরে নারীমনস্তত্ত্বের যে স্থান থাকে তাকে চিনতে পারা অদ্বৈতচরণের ব্যর্থতা ; শেষ পর্যন্ত তাঁর কথাবার্তায় অনুশোচনাই প্রকাশিত।

‘মেঘরৌদ্র’, ‘একরাত্রি’ ইত্যাদি গল্পে নিরাশক্ত আদর্শকে আঁকড়ে থাকা এক পুরুষকে লক্ষ্য করি যে নারী হৃদয়ের চোরাকুঠুরিতে প্রবেশের ছাড়পত্র সংগ্রহ করতে পারনি, স্বভাবে উদাসীন থাকার কারণে। পয়লা নম্বর গল্পেও সেই পুরুষকেই দেখি যে, ‘তাঁর হাঁফ ধরানো ভাসা গুমোটটাকে উদার চিন্তার খোলা হাওয়ায় কাটিয়ে দেওয়ার জন্য স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখার সময় পায়নি। ব্যস্ত থেকেছে দ্বৈতাদ্বৈত সম্প্রদায়কে’ নিয়ে। শীতের প্রার্থনা করে আসা পরিযায়ী পাখির মতো সীতাংশু মৌলি অনিলার শূন্যতাকে চিনে, তার মনে বাসা বেঁধেছে। কিন্তু এসব বোঝার ক্ষমতা অদ্বৈতচরণের ছিল না। ফলত একদিকে সীতাংশুর আহ্বান অন্যদিকে নিরাসক্ত আদর্শকে আঁকড়ে থাকা অদ্বৈতচরণ কোন্‌টা ঠিক শেষ মুহূর্তে বুঝতে পারেনি তাই অমিমাংসিতভাবেই প্রস্থান করেছে ‘আমি চললুম, আমাকে খুঁজতে চেওনা’ এই বলে। ঘটনা ঘটার পর সম্বিত ফেরাটা ‘অদ্বৈতচরণে’র কাছে খুবই স্বাভাবিক। সীতাংশু ঔদ্ধত্য অথচ তার কর্ণেট বাজানো টেনিস খেলা সবকিছুই ঝাপসা দেখেছিল অদ্বৈতচরণ। অপরদিকে স্ত্রীকেও বুঝল না। তার আশোপোক্তি এইরকম—

‘সীতাংশু ক্ষণকালের ফাঁক দিয়ে দেখেছে আজ আট বছরের ঘনিষ্ঠতার পর এই বারের চিঠিগুলির ভিতর দিয়ে তাকে প্রথম দেখলুম’ গল্পের মধ্যে এই একমুখীনতা ছোটোগল্পের অন্যতম লক্ষণ বলা যায়।

সূচনা থেকে পরিসমাপ্তি পর্যন্ত পরিচ্ছন্ন ভাষাবুনোটে গল্পকার যে অদ্বৈতচরণ, অনিলা এবং সীতাংশু মৌলিকে এঁকেছেন তা বাস্তবানুগ। স্ত্রীর প্রতি সামাজিক দায়দায়িত্ব শুধু যে পালন করা নয় তার কামনা বাসনার মর্যাদা দেওয়াও সেটা ভুলে গেলে সব সংসারেই সীতাংশু মৌলি এসে বাসা বাঁধতে পারে। পুরুষের নিস্পৃহতাই অনেক ক্ষেত্রে সংসারে বিপদ হয়ে দাঁড়ায় এ বাস্তব সত্য। আবার নারীরাও নিস্পৃহ পুরুষকে জীবনসঙ্গী হিসাবে পেলে তাদের মনের খোরাক মেটে না তারা অনেকক্ষেত্রেই পর পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হতেই পারে। অনিলাও সীতাংশুর প্রতি দুর্বল হয়েছিল তার প্রমাণ পাই, সীতাংশুকে অনিলার শেষ দেওয়া চিঠির ভিত্তিতেই। অপরদিকে সীতাংশু সমাজ বহির্ভূত নয়। সে বাস্তব রক্তমাংসের মানুষ। পুরুষের যে ঔদ্ধত্য ও উন্নতশির শোভনিয়তার অধিকারী সে। ঘোড়ার লাগাম ছাড়া গতিতেও স্বচ্ছন্দ আবার মুহূর্তেই গতিরোধও করতে সক্ষম। সবমিলিয়ে চরিত্রগুলির বাস্তবতাই ছোটোগল্পের চাহিদা সম্পূর্ণ করেছে।

গঠন বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে দেখলে ক্লাইম্যাক্স-এ এসে গল্প চূড়ান্ত রূপ পেল। প্রথম থেকে অনিলার মনে জমে থাকা খেদ ধীরে ধীরে বিস্ফোরণ ঘটেছে। অনিলার পালানোই চূড়ান্ত পরিণতি। এরপর কাহিনিতে যে সন্দেহজনিত ভ্রান্তি ঘটতে চলেছিল তারও উন্মোচন হল। সীতাংশু স্বীকার করল যে অনিলা তার সঙ্গে নেই।

সীতাংশুকে আগ্রহভাবে অনিলার কথা জানার আগে পর্যন্ত গল্পটি ছিল অন্যরকম, কিন্তু সোনার কার্ডকেস খুলে বের করে দেওয়া চিঠি কাহিনিকে অন্য অভিমুখ দিল, যেখানে পাঠকের কল্পনা জাগিয়ে শেষ করা হল। অর্থাৎ ছোটোগল্পের যদি শেষ প্রাপ্তি অন্তরে অতৃপ্তি হয় তা এখানেও ঘটে গেল।

সবশেষে বলা যায় ‘পয়লানম্বর’ গল্পটি কাহিনির মৌলিকতা ও পরিবেশন নৈপুণ্য গল্পটিকে সার্থক ছোটোগল্পের মর্যাদা এনে দিয়েছে। সামাজিক সম্পর্কের ত্রুটি-বিচ্যুতিকে এমন অসামান্য ভাষা সহযোগে পাঠকের দরবারে নিয়ে আসা তার সাহিত্যিক দায়বদ্ধতার পরিচায়ক।