সূচনা: খােলাফায়ে রাশেদিন যুগের (৬৩২-৬৬১ খ্রি.) শাসনব্যবস্থা ছিল উদার প্রজাকল্যাণকারী ও ধর্মনিরপেক্ষ। মহানবি গণতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে যে ইসলামি প্রজাতন্ত্র স্থাপন করে যান তারই ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে ইসলামি শাসনব্যবস্থা।

[1] কেন্দ্রীয় শাসন

  • খলিফা: শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ ছিলেন খলিফা স্বয়ং। তিনি মহানবির প্রতিনিধি হিসেবে এবং কোরান ও হাদিসের অনুশাসন মেনে শাসনকাজ পরিচালনা করতেন। শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভােগ করলেও খলিফা কখনােই শাসন পরিচালনায় স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতেন না। খলিফারা শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা, শত্রুদের দমন এবং ইসলামি রাষ্ট্রকে সুরক্ষিত রাখা প্রধান কর্তব্য বলে মনে করতেন।

  • মজলিশ উশ শুরা বা মন্ত্রণা পরিষদ: মহানবি তাঁর জীবদ্দশায় শাসন পরিচালনার ব্যাপারে আবুবকর, ওমর ওসমান ও আলি-সহ অন্যান্য অভিজ্ঞ সাহাবিদের পরামর্শ নিতেন। এই পরামর্শ সভাই পরবর্তীকালে ‘মজলিশ উশ শুরা’ নামে পরিচিত হন। এই পরিষদটি ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানসূত্র ছাড়াও প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়ােগ, সৈন্যদের বেতন, রাজস্বব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে খলিফাকে পরামর্শ দান করত।

[2] প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা

  • বিভিন্ন প্রাদেশিক বিভাগ: শাসনকার্যের সুবিধার্থে সমগ্র ইসলামি প্রজাতন্ত্র ৮টি ভাগে বিভক্ত ছিল। যথা- (a) মক্কা, (b) মদিনা, (c) সিরিয়া, (d) বসরা, (e) কুফা, (f) প্যালেস্টাইন, (g) মিশর ও (h) জাজিরা।

    • ওয়ালি: প্রদেশগুলিতে সুষ্ঠুভাবে শাসনকাজ পরিচালনার জন্য ‘ওয়ালি’ বা গভর্নরদের নিয়োগ করা হত। ওয়ালি নামে প্রাদেশিক শাসকদের ওপর প্রদেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার ভার ছিল। প্রাদেশিক সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে যুদ্ধের সময় ওয়ালিকে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে হত। রাজস্ব আদায় এবং প্রাদেশিক কোশাগার সংরক্ষণের দায়িত্বও তাকে পালন করতে হত।

    • আমিল: প্রদেশগুলি আবার বিভিন্ন জেলায় বিভক্ত ছিল। জেলাগুলিতে শাসন পরিচালনায় সাহায্য করতেন ‘আমিল’ নামে কর্মচারীবৃন্দ। আমিলদের প্রধান কাজ ছিল খারাজ ও ‘জিজিয়া’ কর আদায় করা।

[3] বিচারব্যবস্থা: খােলাফায়ে রাশেদিন যুগের বিচারব্যবস্থা ছিল স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ। বিচারব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য ছিল সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। বিচারকাজ পরিচালনার জন্য প্রত্যেকটি প্রদেশে খলিফা কোরান ও হদিস সম্পর্কে অভিজ্ঞ ও সৎ ব্যক্তিদের প্রধান কাজি পদে নিয়ােগ করতেন। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা যেত।

[4] সামরিক সংগঠন: সামরিক দিক থেকে সমগ্র ইসলামি সাম্রাজ্য নটি ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রত্যেক ভাগে এক-একটি সামরিক কেন্দ্র ছিল যেখানে দশজন সেনাবিশিষ্ট এক ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী সামরিক দায়িত্ব পালন করতেন। প্রধান সেনাপতি বা কম্যান্ডার ইন চিফকে নিয়ােগ করতেন খলিফা স্বয়ং।

[5] জনকল্যাণমূলক কাজ: খােলাফায়ে রাশেদিন যুগে‌ জনকল্যাণের স্বার্থে পান্থশালা, সেতু ও সড়ক নির্মাণ, নদীতীরে বাঁধ নির্মাণ, খাল খনন ও নদনদী সংস্কার করা হত। প্রজাদের জলের কষ্ট দূর করার জন্য, কৃষিতে জলসেচের সুবিধার জন্য প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ উদ্যোগী ছিলেন। শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে মসজিদগুলিতে ব্যবস্থা থাকত। বায়তুলমাল’ থেকে দরিদ্র ও অসহায় প্রজাদের ভাতা ও অর্থ সাহায্য দেওয়া হত।

উপসংহার: ‘খােলাফায়ে রাশেদিন’ যুগের শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন দিকগুলি ছিল পবিত্র ইসলামি যুগের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। খলিফা যুগের শাসনব্যবস্থা এক দিকে যেমন ইসলামের উত্থান ও প্রসার ঘটায়, অন্যদিকে তেমন ইসলামিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে স্থায়ী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে।