পদ্মাবতী মধ্যযুগের বাঙালি কবি সৈয়দ আলাওল এর লেখা একটি কাব্য। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আলাওলের অনুবাদ কাব্য পদ্মাবতী। মালিক মুহাম্মদ জায়সী এর “পদুমাবৎ” কাব্যের অনুবাদ এটি। জায়সী তাঁর কাব্য রচনা করেন ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে। প্রায় ১০০ বছর পর আরাকানের বৌদ্ধ রাজার অমাত্য মাগন ঠাকুরের নির্দেশে আলাওল ১৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দে পদ্মাবতী রচনা করেন।

অন্ত মধ্যযুগের বাংলা রোমান্টিক কাব্যের ধারায় আলাওলের পদ্মাবতী

অন্ত মধ্যযুগের ভারতের অধিকাংশ ভাষার মত বাংলা ভাষার সাহিত্যও মূলতঃ ধর্মকেন্দ্রিক, হিন্দু দেবদেবীদের মাহাত্ম্য বা ইসলাম ধর্মের নবী ও খলিফাদের বর্ণনা। কিন্তু এই কালপর্বে বাংলা ভাষায় বেশ কয়েকটি মানবতাবাদী রোমান্টিক কাব্য রচিত হয়। এই ধারার রচনাসমূহ বহুলাংশে সমকালীন অবধী রোমান্টিক সাহিত্যের অনুসরণ। এই রোমান্টিক ধারার কাব্যগুলির উল্লেখনীয় অংশ রচিত হয়েছিল সপ্তদশ শতকে, বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তবর্তী রাজ্য, বর্তমানে মিয়ানমারের অন্তর্গত, আরাকানের মগ রাজাদের বাংলা ভাষাভাষী অমাত্যদের পৃষ্ঠপোষকতায়। অন্ত মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে মানবতাবাদী রোম্যান্টিক ভাবনার দুই অন্যতম উল্লেখনীয় ব্যক্তিত্ব, আলাওল অর্থাৎ সৈয়দ আলাওল শাহ (আনুমানিক ১৬০৭-১৬৮০ সাধারণাব্দ) এবং তাঁর পূর্বসুরী দৌলত কাজী (আনুমানিক ১৬০০-১৬৩৮ সাধারণাব্দ) দুজনেই আরাকানের অমাত্যদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। বাংলা রোমান্টিক কাব্যধারায় অন্ত মধ্যযুগে যে গ্রন্থমালার সন্ধান পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় রচনা সম্ভবতঃ দৌলত কাজীর ‘লোর-চন্দ্রাণী-সতীময়না’ ও আলাওলের ‘পদ্মাবতী’।

আধুনিক বিদ্বানদের মতে আনুমানিক ১৬০৭ সাধারণাব্দে আলাওল জন্মগ্রহণ করেন। আলাওল, তাঁর ‘পদ্মাবতী’ কাব্যগ্রন্থে একটি ‘আত্মবিবরণী’ সংযোজিত করেছেন। ঐ ‘আত্মবিবরণী’ থেকে তাঁর জীবন সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জানা যায়। আলাওল তৎকালীন ফতেহাবাদ ‘মুলুকে’র জালালপুর গ্রামে (বর্তমান বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় অবস্থিত) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ফতেহাবাদ ‘মুলুকে’র অধিপতি মজলিস কুতুবের একজন অমাত্য। তাঁর রচনাবলী থেকে অনুমান করা যায় তৎকালীন বাংলার অন্যান্য অভিজাত পরিবারের সন্তানদের মত আলাওলও তাঁর শৈশবে বা কৈশোরে আরবি, ফার্সী, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেছিলেন। তাঁর অবধী ভাষায় নিঃসন্দেহে যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। শস্ত্রচালনা ও সঙ্গীত বিষয়েও তাঁর জ্ঞানের প্রমাণ বিদ্যমান। প্রথম যৌবনে আলাওল পিতার সঙ্গে জলপথে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় হার্মাদ (পর্তুগিজ) জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হন। এই আক্রমণে তাঁর পিতা নিহত হন এবং আলাওল আহত ও বন্দী অবস্থায় রোসাঙ্গে (অর্থাৎ ম্রক ইউ, আরাকান রাজ্যের রাজধানী) উপস্থিত হন। আরাকানে প্রথমে তিনি একজন ‘রাজ-আসোয়ার’ (অশ্বারোহী দেহরক্ষী) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। আরাকানের রাজা থদো (রাজত্বকাল ১৬৪৫-১৬৫২ সাধারণাব্দ) ও তাঁর পুত্র শ্রীচন্দ্র সুধর্মের (রাজত্বকাল ১৬৫২-১৬৭৪ সাধারণাব্দ) আমলে থদোর মহারাণী ও শ্রীচন্দ্র সুধর্মের মা যশস্বিনীর প্রধান অমাত্য ছিলেন মাগন ঠাকুর (১৬৪৫-১৬৫৮ সাধারণাব্দ)। আলাওল মাগন ঠাকুরের অনুগ্রহলাভ করে দেহরক্ষীর কাজ ছেড়ে তাঁর গৃহে আরাকানের অমাত্যদের পুত্রদের সঙ্গীত শিক্ষকের কাজ নেন। এই সময় মাগন ঠাকুরের আনুকূল্যে তিনি তাঁর অমাত্যসভায়ও স্থান পান। আলাওল রোসাঙ্গে তাঁর বিদগ্ধতার কারণে ‘তালিব এলেম’ নামে পরিচিত হন। তিনি রোসাঙ্গের সুফী সাধক কাজী সৈয়দ মাসুদ শাহের কাছ থেকে ‘কাদেরী খিলাফত’ লাভ করেন। মাগন ঠাকুরের মৃত্যুর পর ক্রমান্বয়ে আরাকানের রাজ-অমাত্য সৈয়দ মুসা, প্রধান অমাত্য সোলেমান, সৈন্যমন্ত্রী সৈয়দ মুহাম্মদ খান ও রাজস্বমন্ত্রী নবরাজ মজলিস কবিকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। তিনি তাঁদের কাছ থেকে তাঁর বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ রচনার প্রেরণা পান। ১৬৬০ সালে বাংলার মুঘল সুবাদার রাজকুমার শাহ সুজা ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে মীরজুমলার নেতৃত্বাধীন আওরঙ্গজেবের বাহিনীর কাছে পরাস্ত হয়ে আরাকান রাজ্যে আশ্রয় নেন এবং কিছুদিন পর আরাকান রাজের বিরুদ্ধে এক অসফল বিদ্রোহের প্রয়াসের পর সপরিবারে নিহত হন। ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’ কাব্যগ্রন্থে আলাওল প্রদত্ত ‘আত্মবিবরণী’ অনুযায়ী এই বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত মীর্জা নামের এক ব্যক্তির মিথ্যা অভিযোগে আলাওল পঞ্চাশ দিন কারাবাস করেন। ‘সিকান্দরনামা’ কাব্যে বর্ণিত ‘আত্মবিবরণী’ অনুযায়ী তিনি এই কারাবাসের পর আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন, এবং স্ত্রীপুত্রসহ ভিক্ষাবৃত্তি দ্বারা প্রায় দশ বছর জীবিকা নির্বাহ করেন।

অন্ত মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের কবিদের মধ্যে আলাওল সম্ভবতঃ অন্যতম ফলপ্রসূ লেখক। তাঁর লেখা ৬টি কাব্যগ্রন্থ ও বেশ কিছুসংখ্যক পদাবলীর পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া গেছে। ‘পদ্মাবতী’ সম্ভবতঃ তাঁর প্রথম উল্লেখনীয় কাব্যগ্রন্থ। মাগন ঠাকুরের অনুরোধে আলাওল ১৬৫১ সালে (বা ১৬৪৮ সালে) এই কাব্য রচনা করেন। দৌলত কাজীর মৃত্যুর কারণে তাঁর ‘সতীময়না-লোর-চন্দ্রাণী’ কাব্য অসমাপ্ত রয়ে গেছিল। প্রধান অমাত্য সোলেমানের অনুরোধে আলাওল ১৬৫৯ সালে ‘সতীময়না-লোর-চন্দ্রাণী’ কাব্য সম্পূর্ণ করেন। আরাকানের সৈন্যমন্ত্রী সৈয়দ মুহাম্মদের অনুরোধে তিনি ‘সপ্তপয়কর’ কাব্য রচনা করেন। অনুমান করা হয় ১৬৬০ সালে তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৬৬৪ সালে আলাওল প্রধান অমাত্য সোলেমানের অনুরোধে রচনা করেন নৈতিকতা বিষয়ক কাব্য ‘তোহফা’। ১৬৫৮ সাল বা তার আগে তিনি মাগন ঠাকুরের অনুরোধে ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’ কাব্য লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু, মাগন ঠাকুরের মৃত্যুর ফলে তাঁর রচনা অসমাপ্ত থেকে যায়। রাজ-অমাত্য সৈয়দ মুসার প্রতিপোষণে তিনি আবার রচনা শুরু করে ১৬৬৯ সালে এই গ্রন্থ সম্পূর্ণ করেন। ১৬৭১ সালে আলাওল নবরাজ মজলিসের সভাসদ পদে নিযুক্ত হয়ে ‘সিকান্দরনামা’ রচনা শুরু করেন। সম্ভবতঃ ১৬৭৩ সালে তিনি এই গ্রন্থ রচনা সম্পূর্ণ করেন। আলাওলের রাগ ও তাল বিষয়ে রচিত বিভিন্ন পদ ও বৈষ্ণবপদের অনুরূপ তাঁর কিছু গীতিকবিতা তাঁর বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি থেকে সংগ্রহ করে ১৯৬৩ সালে ‘বাঙলা একাডেমী পত্রিকা’য় ‘রাগতালনামা ও পদাবলী’ নামে প্রকাশিত হয়।

‘রাগতালনামা ও পদাবলী’ সঙ্কলনে প্রকাশিত রচনা আলাওলের মৌলিকতার সাক্ষ্যবহন করে, অন্য ৬টি কাব্যগ্রন্থ অনুবাদমূলক। ‘রাগতালনামা ও পদাবলী’ সঙ্কলনের রচনাসমূহ সম্ভবতঃ তিনি রোসাঙ্গ প্রবাসের প্রথম দিকে সঙ্গীত শিক্ষকতার প্রয়োজনে রচনা করেছিলেন। তাঁর রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক পদগুলিতে বৈষ্ণব পদাবলীর প্রভাব লক্ষণীয়। বর্তমান উত্তরপ্রদেশের অধিবাসী মালিক মুহাম্মদ জায়সীর অবধী ভাষায় ১৫৪০ সালে লেখা ‘পদ্মাবত’ আলাওলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের উৎস। ১৩৭৮-৭৯ সালে মাওলানা দাউদ অবধী ভাষায় ‘চন্দায়ন’ কাব্য রচনা করেন। এরপর ষোড়শ শতকে একই ধারায় মিঁয়া সাধন ‘মৈনাসত’ কাব্য রচনা করেন। এই ধারা অনুসরণ করে বাংলায় দৌলত কাজী ‘সতীময়না-লোর-চন্দ্রানী’ কাব্যের রচনা শুরু করেন এবং আলাওল ঐ রচনা সমাপ্ত করেন। আলাওলের ‘সপ্তপয়কর’ কাব্য বর্তমান আজারবাইজানের অধিবাসী নিজামী গঞ্জবীর (১১৪১-১২০৯ সাধারণাব্দ) ফার্সী ভাষায় ১১৯৭ সালে লেখা ‘হাফত্ পায়কর’ কাব্যের অনুবাদ। নিজামী গঞ্জবীরই ফার্সী ভাষায় লেখা আরেকটি কাব্য ‘এস্কান্দরনামা’ আলাওলের ‘সিকান্দরনামা’ কাব্যের উৎস। দিল্লীর সুফী কবি ইউসুফ গদার চতুর্দশ শতকের শেষে ফার্সী ভাষায় লেখা ‘তুহুফা-ই-নসাইহ্’ কাব্যের অনুসরণ করে আলাওল তাঁর ‘তোহফা’ কাব্য রচনা করেছিলেন। আলাওলের ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’ আরবী ভাষায় লেখা ‘আলিফ লায়্লাহ্ ওয়া লায়্লাহ্’ (অর্থাৎ, এক সহস্র এক রজনী) লোককাহিনীসংগ্রহের একটি উপাখ্যান নিয়ে রচিত। ১৬২৪ সালে গোলকোণ্ডার কুতবশাহী রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গাওয়াসীর দখনী হিন্দীতে লেখা ‘সয়ফুলমুলুক ওয়া বদিউজ্জামাল’ কাব্য এই গ্রন্থের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল কিনা বলা কঠিন।

‘পদ্মাবতী’ নিঃসন্দেহে আলাওলের সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতি। পদ্মাবতী অনুবাদকাব্য হলেও নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। জায়সীর মূল কাব্যের অংশবিশেষের পরিবর্জন, স্বরচিত অংশের সংযোজন এবং বিভিন্ন পরিবর্তন এই কাব্যের মৌলিকতার সূচক। জায়সীর কাহিনীর মূল চরিত্রগুলি – চিতোরের রাজা রতনসেন (রত্নসেন), তাঁর দুই রাণী – নাগমতী ও সিংহলের রাজকুমারী পদ্মাবতী, শুকপাখী হিরামন (হীরামণি), রাজপণ্ডিত রাঘব চেতন, বাদশাহ আলাউদ্দীন (খলজী) এবং গোরা ও বাদল অবশ্য আলাওলের কাব্যে প্রায় একইরকম ভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। জায়সীর মত আলাওলও ছিলেন সুফী এবং তাঁর রচনায় সুফী মতের প্রভাব পরিস্ফুট। কিন্তু, জায়সীর রচনার দোঁহা অংশে প্রদত্ত কাহিনীর সুফী তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আলাওলের রচনায় পুনরাবৃত্তি করা হয় নি। সম্ভবতঃ আলাওল বাংলা পাঁচালী রীতিতে লেখা কাব্যে চৌপাই-দোঁহা কাব্যরীতির হুবহু অনুকরণ করা সমীচীন বোধ করেন নি। জায়সী ও আলাওলের কাহিনীর মূল পার্থক্য শেষ অংশে। জায়সীর মত আলাওল তাঁর কাব্য রত্নসেন, নাগমতী ও পদ্মাবতীর মৃত্যু ও আলাউদ্দীনের চিতোর জয়ে শেষ করেন নি। আলাওলের কাহিনীর শেষ হয়েছে রত্নসেনের মৃত্যুর পর পিতার নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর দুই পুত্র চন্দ্রসেন ও ইন্দ্র্সেনের দিল্লিতে গিয়ে আলাউদ্দীনের কাছে বশ্যতা স্বীকার ও আলাউদ্দীন কর্তৃক তাঁদের রাজ্য উপহারদানে।

আলাওল যেভাবে ঈশ্বর বা শাসকের পরিবর্তে মানবতার জয়গান করে ‘পদ্মাবতী’ কাব্য সমাপ্ত করেছেন, অন্ত মধ্যযুগে তা বেশ বিরল বলেই মনে হয়:
কোথা গেল দিল্লীশ্বর উমরার গণ।
একে একে গরাসিল দারুণ শমন।।
কোথা গেল পদ্মাবতী ত্রিলোকমোহিনী।
কোথা গেল অপ্সরী নাগমতী রাণী।।
দারুণ শমন কারে দয়া নাহি করে।
সুরূপ কুরূপ কেহ কাকে নাহি এড়ে।।
এতেক চাহিয়া মনে ভাবি বুদ্ধিজন।
সে সুখসম্পদ সুখ কি আছে এখন।।
কিছু না রহিব রৈব কীর্তির কথন।
পরিণাম হেতু কিছু করহ যতন।।