এই প্রকার ন্যায়ের ধারণা একটি উগ্র ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী ধারণা। এখানে ন্যায়কে দেখা হয়েছে সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। সামাজিক প্রেক্ষিত এখানে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। ন্যায় সম্পর্কে পদ্ধতিগত ধারণায় উৎপাদন ও বণ্টনের মধ্যে কোনরকম পার্থক্য করা হয় নি। এই ধারণা অনুসারে প্রতিটি ব্যক্তি নারী বা পুরুষ হিসাবে স্বতন্ত্র এবং তাদের সত্ত্বাধিকারের (entitlement) বিষয়টিও সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত যার সঙ্গে সমাজের কোন যোগ নেই বা কোন বিমূর্ত বণ্টনের ধারণা/নীতি এক্ষেত্রে প্রযুক্ত/কার্যকরী হবে না। এর অন্তর্নিহিত বক্তব্য হল ব্যক্তিগত সত্ত্বাধিকারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোনরকম হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না, শুধু তাই নয় পদ্ধতিগত ন্যায় তত্ত্বে মনে করা হয় রাষ্ট্র যদি এক্ষেত্রে অযথা হস্তক্ষেপ করে তবে তা হবে ভয়ঙ্কর অন্যায্য (unjust)। এই তত্ত্বের প্রবক্তারা বিশ্বাস করেন না যে রাষ্ট্র বা সমাজের কোন লক্ষ্য (end) আছে যা যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। এই তত্ত্ব মানুষকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ক্ষমতাশালী এক একটি একক হিসাবে দেখে যে সম্পূর্ণভাবে তার সফলতা বা ব্যর্থতার জন্য দায়ী এবং যার প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব বা সমাজের কোন প্রয়োজন নেই।
পদ্ধতিগত ন্যায়তত্ত্বের সঙ্গে বাজার অর্থনীতির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। বাজার অর্থনীতির প্রবক্তাদের মত এই তত্ত্বেও বিশ্বাস করা হয় কোন রকম বহিরাগত হস্তক্ষেপ (রাষ্ট্র বা সরকারের) না হলে বাজার সম্পদের সর্বোৎকৃষ্ট ও দক্ষতাপূর্ণ ব্যবহার করতে পারবে। আর যদি এক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করা হয় বা হস্তক্ষেপ করা হয় তবে তা হবে অন্যায্য ও সকলেই এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরা আরও মনে করেন রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ তখনই সম্ভব যদি তা সর্বসম্মত নীতির ভিত্তিতে হয়। কিন্তু কোন মুক্ত সমাজে যেখানে সবাই স্বাধীন সেখানে এইরকম কোন সর্বসম্মতিতে পৌঁছানো সম্ভব নয়। ফলে পদ্ধতিগত ন্যায়ের প্রবক্তারা ব্যক্তি জীবনে বা অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের সম্পূর্ণ বিরোধী। এদের দৃঢ় মত হল কোন ব্যক্তি যদি ব্যবসায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে রাষ্ট্র তাকে আর্থিক সাহায্য করতে পারে, তবে এর সঙ্গে ন্যায়ের কোন সম্পর্ক আছে বলে তারা মানতে রাজী নন।
রবার্ট নজিক হলেন পদ্ধতিগত ন্যায়ের একজন উল্লেখযোগ্য প্রবক্তা। তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ Anarchy, State and Utopia-তে ন্যায় সম্পর্কে তার ধারণা ব্যক্ত করেছেন। এই ধারণাকে বুঝতে হলে তিনি ন্যায় সম্পর্কে ঐতিহাসিক নীতি ও রাষ্ট্রীয় ন্যায়ের নীতির মধ্যে যে পার্থক্য করেছেন তা বুঝতে হবে। ন্যায় সম্পর্কে ঐতিহাসিক নীতির মূলকথা হল প্রতিটি ব্যক্তির কাজ যেমন হবে সে তেমন ফলভোগের অধিকারী হবে এবং যেহেতু প্রতিটি ব্যক্তির কর্ম আলাদা তাই তার/তাদের ফলভোগের দাবী/অধিকারও আলাদা হবে। অন্যদিকে ন্যায় সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় নীতিতে মনে করা হয় সমাজে একগুচ্ছ স্বীকৃত লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকবে এবং সামাজিক বণ্টন সেই লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশে পরিচালিত হবে।
নজিকের মতে একজন ব্যক্তি যত খুশি সম্ভব ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন, ভোগ দখল করতে পারবে যদি তা বৈধ/ন্যায্য পথে অর্জিত হয়। অর্থাৎ সম্পত্তি বেআইনি বা বলপূর্বকভাবে অর্জন করা চলবে না। যদি বৈধ আইনসম্মত পথে সম্পত্তি অর্জিত হয় তাহলে একজন ব্যক্তি যত খুশি সম্ভব সম্পত্তি অর্জন বা ভোগ দখল করলেও রাষ্ট্র তাতে কোন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারবে না, একমাত্র যদি বলপূর্বক বা বেআইনি পথে সম্পত্তি অর্জিত হয় তখন রাষ্ট্র তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। অর্থাৎ সামাজিক বণ্টন বা পুনর্বণ্টনের ক্ষেত্রে নজিক রাষ্ট্রকে অত্যন্ত সীমিত ভূমিকা প্রদান করেছেন। তার মতে রাষ্ট্রের ভূমিকা সামাজিক ক্ষেত্রে যত কম হবে ততই ব্যক্তি স্বাধীনতা সুনিশ্চিত হবে/বৃদ্ধি পাবে। এককথায় নজিকের ন্যায়ের তত্ত্ব ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ স্থান দেয় এবং এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়/সামাজিক নিয়ন্ত্রণ অবাঞ্ছিত বলে মনে করে।
বন্টনমূলক ন্যায়: বণ্টনমূলক ন্যায়ের ধারণা পদ্ধতিগত ন্যায়ের ধারণা থেকে মৌলিকভাবে পৃথক। ন্যায়ের এই ধারণায় সামাজিক মূল্যবান বস্তু বা সেবাসমূহ বণ্টন বা পুণর্বণ্টনে রাষ্ট্র বা সরকারের ইতিবাচক ভূমিকাকে স্বীকার করা হয়। এই মতবাদ বিশ্বাস করে না যে কোন ব্যক্তির সাফল্য বা ব্যর্থতা শুধু তার ব্যক্তিগত বিষয়, সামাজিক পরিস্থিতি, পরিবেশ, ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান, তার সাফল্য বা ব্যর্থতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। একথা বলা যায় সব সমাজেই মূল্যবান বস্তু চাহিদার তুলনায় কম। সুতরাং রাজনীতির মূলকথা হল কে/কারা এবং কেন পেল? সাধারণভাবে মূল্যবান বস্তু বা সেবাসমূহ বণ্টনের ক্ষেত্রে যে সমস্ত মাপকাঠি ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— যোগ্যতা, গুণসম্পন্নতা এবং চাহিদা।
যোগ্যতা হল সেই ক্ষমতা বা দক্ষতা যার দ্বারা একজন ব্যক্তি (পুরুষ বা মহিলা) মূল্যবান বস্তু বা সেবা পাবার অধিকারী হয়। সমাজে ভাল কাজের জন্য পুরস্কার বা মন্দ কাজের জন্য শাস্তি প্রদান করা হয়। কে পুরস্কৃত হবে বা তিরস্কৃত হবে তা নির্ধারিত হয় তার কাজ ও প্রচেষ্টাকে বিচার করে। গুণসম্পন্নতা যোগ্যতার মত অনেকটা একই রকম বিষয়। সাধারণভাবে সমাজে গুণী ব্যক্তিরা পুরস্কৃত হয় আর ব্যর্থরা তিরস্কৃত হয়। কিন্তু একটু ভাল করে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে সাফল্য ও ব্যর্থতার জন্য শুধু ব্যক্তিগত গুণাবলীই যথেষ্ট নয়, সমাজ, পরিবেশ, পরিস্থিতি এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। সামাজিক স্তরবিন্যাসে যারা নীচের দিকে অবস্থিত তাদের ব্যর্থতার জন্য অনেক সময়ই পরিবেশ/পরিস্থিতি দ্বায়ী। যে ছেলেটি বা মেয়েটি পরীক্ষায় সফল হয়েছে সে নিশ্চয়ই যোগ্য, কিন্তু যে ব্যর্থ হয়েছে সে কি সফলদের মত সমান সামাজিক অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে? সুতরাং বলা যেতে পারে সাফল্য-ব্যর্থতা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত গুণাবলীর উপর নির্ভর করে না। আবার কোন কাজ মূল্যবান কি না তা অনেকাংশে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে। যেমন ভারতে কায়িক পরিশ্রমের তুলনায় বৌদ্ধিক মানসিক শ্রমকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বা মূল্যবান বলে মনে করা হয়। তাই একজন সাফাই কর্মীর কাজের তুলনায় শিক্ষকের কাজকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বা মূল্যবান বলে মনে করা হয়। কিন্তু সঠিকভাবে বিচার করলে বোঝা যাবে শিক্ষালাভ না করলেও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু সাফাই ঠিকমত না হলে সুস্থভাবে বেঁচে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। আবার চাহিদার প্রশ্নে বলা যায় যে, সমাজে মানুষের যোগ্যতা আলাদা হলেও মানুষ হিসাবে প্রত্যেকের চাহিদা/দাবী পূরণ করা প্রয়োজন। এখানে যোগ্যতা বা গুণসম্পন্নতার থেকে মানবিক দাবী/চাহিদার প্রশ্নটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। যেমন একজন অশিক্ষিত গরিব মানুষ যার বাড়ীতে অনেক সদস্যসংখ্যা তার প্রয়োজন/দাবী একজন উচ্চশিক্ষিত নিঃসন্তান দম্পতির থেকে বেশী। যদি আমরা এমন পৃথিবীতে বাস করতাম যেখানে সম্পদের প্রাচুর্য আছে তাহলে সম্পদলাভের ক্ষেত্রে ন্যায়ের প্রশ্নটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ত কিন্তু পরিস্থিতি এর বিপরীত হওয়ায় কে পায়? কেন? এই প্রশ্নগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক তাত্ত্বিকরা এই প্রশ্নে যা উত্তর দিয়েছেন সেগুলিকে দুটি ভাগ করা যায়— পদ্ধতিগত ও সামাজিক (বণ্টনমূলক)। এই দুই ন্যায়সংক্রান্ত তত্ত্বের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিভিন্ন ধরনের পার্থক্য থাকলেও এদের মূল পার্থক্যটি হল এইরকম—
(ক) পদ্ধতিগত ন্যায়ের তত্ত্বে মনে করা হয় কতকগুলি নিয়মকানুন পদ্ধতি অনুসরণ করলেই ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে এবং এই পদ্ধতিগুলির ফলাফল ন্যায়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখানে আরও মনে করা হয় ব্যক্তিগত আচরণের ক্ষেত্রেই কেবলমাত্র ন্যায়ের ধারণাটি প্রাসঙ্গিক, সমাজের ক্ষেত্রে নয়। ব্যক্তিকে এখানে স্বাধীন এবং যুক্তিবাদী প্রাণী হিসাবে দেখা হয় যে তার আচরণ ও কাজকর্মের জন্য নিজেই দায়ী।
(খ) অন্যদিকে সামাজিক ন্যায়ের ধারণায় ন্যায়কে একটি সামাজিক বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সুতরাং এখানে কোন একজন ব্যক্তি কি পেল বা পেল না সেইভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। এখানে রাষ্ট্র বা সমাজব্যবস্থাকে ন্যায়সঙ্গত/কি ন্যায়সঙ্গত নয় তা বিচার করা হয় কিছু নির্দিষ্ট নীতি বা মানদণ্ডের ভিত্তিতে (যে বিষয়ে সমাজে একটি ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়)। এই তত্ত্বে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। মনে করা হয়, সমাজের দূর্বলতর অংশের মানুষদের মধ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র একটি বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। এই রকম ন্যায়ের তত্ত্বে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হল রাষ্ট্রদার্শনিক জন রলসের ন্যায় তত্ত্ব।
Leave a comment