উত্তর : পদাবলী সাহিত্য বৈষ্ণবতত্ত্বের রসভাস্য। বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণবসমাজে মহাজন পদাবলী এবং বৈষ্ণব পদকর্তাগণ মহাজন নামে পরিচিত। বৈষ্ণবমতে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক বিদ্যমান। এই প্রেম সম্পর্ককে বৈষ্ণব মতাবলম্বীগণ রাধাকৃষ্ণের রূপকের মাধ্যমে উপলব্ধি করেছেন। রাধা ও কৃষ্ণের রূপাশ্রয়ে ভক্ত ও ভগবানের নিত্যবিরহ ও নিত্য মিলনের অপরূপ আধ্যাত্মিক লীলা কীর্তিত হয়েছে। বৈষ্ণবদের উপাস্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর আনন্দময় তথা প্রেমময় প্রকাশ ঘটেছে রাধার মাধ্যমে। রাধা মানবী নয়, শ্রীকৃষ্ণরূপ পূর্ণ ভগবৎ-তত্ত্বের অংশ। ভগবানের লীলা চলে তাঁর স্বরূপভূতা শক্তি রাধার সঙ্গে। বৈষ্ণবেরা ভগবান ও ভক্তের সম্পর্কের স্বরূপ নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণকে পরমাত্মা বা ভগবান এবং রাধাকে জীবাত্মা বা সৃষ্টির রূপক মনে করে তাঁদের বিচিত্র প্রেমলীলার মধ্যেই ধর্মীয় তাৎপর্য উপলব্ধি করেছেন। ফলে এক প্রাচীন গোপজাতির লোকগাথার নায়ক প্রেমিক কৃষ্ণ এবং মহাভারতের নায়ক অবতার কৃষ্ণ কালে লোকস্মৃতিতে অভিন্ন হয়ে উঠেন। গোপী প্রধানা রাধার সঙ্গে তাঁর প্রণয়ই জীবাত্মা-পরমাত্মার প্রণয়লীলার রূপক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে ধর্ম দর্শনের ও সাধন-ভজনের অবলম্বন হয়েছে। নীলরতন সেন মন্তব্য করেছেন:
“পদাবলীর কাহিনি, তথ্য উপকরণ, এবং ভক্তি-ভাবাশ্রিত সৌন্দর্য চিত্রায়ণে বৈষ্ণব কবিরা উপনিষদ, হালের গাথাসপ্তসতী, আভির ও অন্যান্য জাতির মৌলিক প্রেমগাথা, ভাগবতসহ বিবিধ পুরাণ, বাৎস্যায়নের কামসূত্র, অমরুশতক, আনন্দবর্ধনের ধ্বন্যালোক, কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়, সদুক্তিকর্ণামৃত, সুভাষিতাবলী, সৃক্তিমুক্তাবলী প্রভৃতি প্রাচীন শাস্ত্র, পুরাণ, লোকধর্ম ও প্রেমগীতিকে আশ্রয় করে ভারতের পূর্বাচার্যদের অনুসৃত পথেই অগ্রসর হয়েছেন।”
পদাবলীর নায়ক অনন্তশক্তিমান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর প্রধান তিন শক্তি: চিৎশক্তি, মায়াশক্তি ও জীবশক্তি। এই তিনশক্তিকে অন্ত রঙ্গা, বহিরঙ্গা এবং তটস্থা বলা হয়। অন্তরঙ্গা স্বরূপশক্তি এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। স্বরূপশক্তি তিন রূপে শ্রীকৃষ্ণ সচ্চিদানন্দময় পুরুষ। ভাগবতপুরাণের দশম স্কন্ধে রাসলীলায় শ্রীকৃষ্ণের নায়করূপের বর্ণনা রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ আপন প্রেম রসাস্বাদনের জন্যই ব্রজলীলায় আপনশক্তি অংশে গোপীদের এবং গোপীশ্রেষ্ঠা শ্রীরাধার আবির্ভাব ঘটিয়েছিলেন। দ্বাপরে মর্তলীলায় সেই লীলারসাস্বাদ ও কৌতূহলের পূর্ণ নিবৃত্তি না ঘটায় আবার বহিরঙ্গে রাধার রূপলাবণ্য নিয়ে এই যুগে নবদ্বীপে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যরূপে এসেছিলেন।
শ্রীরাধাকে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণই প্রেমসুখাস্বাদনের জন্য হ্লাদিনী শক্তি অংশে সৃষ্টি করেছেন। রাধার প্রেমে আত্মসুখের লেশমাত্র ছিল না, কৃষ্ণসুখেই তাঁর জীবন উৎসর্গিত।
Leave a comment