প্রশ্নঃ পদসোপান বা হায়ারার্কী নীতি কি? পদসোপান পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা কর। 

পদসোপান বা হায়ারার্কী নীতি (Principle of Hierarchy): পদসোপান নীতি ব্যতীত কোন সংগঠনের কথা চিন্তা করা কঠিন। ‘হায়ারার্কী’ বা ‘পদসোপান’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো উচ্চতর স্তর কর্তৃক নিম্নতর স্তরকে নিয়ন্ত্রণকরণ। প্রশাসনে পদসোপান বলতে কতকগুলো পর্যায়ক্রমিক স্তর-বিশিষ্ট কোন সংগঠনকেই বুঝায়, যেখানে প্রত্যেক নিম্নস্তরে কার্যরত ব্যক্তিগণ তাদের ঠিক ঊর্ধ্বস্তরের ব্যক্তিগণের অধীন। প্রশাসনিক কার্যাবলিকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোকে একটি বৃহত্তর ইউনিটে একত্র করা হয়। কোন বড় বাস্তব উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই সংগঠন গড়ে তোলা হয় এবং এটির ভিতর কার্যকরী বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে কাজ বণ্টন করে দেয়া হয়। এ সকল ইউনিটগুলোকেও কতকগুলো সাব-ইউনিটে বিভক্ত করা হয়৷ এ সকল সাব-ইউনিটগুলোকে আবার বহুধারায় বিভক্ত করা হয়, যে পর্যন্ত না আমরা সংগঠনের একেবারে নিম্নতম পর্যায় বা ভিত্তিতে উপনীত হই। সংগঠনের এ পর্যায়নুক্রমিক ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ পর্যায় হতেই সকল কর্তৃত্ব, আদেশ ও নিয়ন্ত্রণ স্তরে স্তরে একেবারে নিম্নস্তরে নিঃসৃত হয়ে আসে। একেই সংগঠনের পদসোপান বা হায়ারার্কী নীতি বলা হয়।

পদসোপান পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তাঃ দুটি কারণে সংগঠনে পদসোপান পদ্ধতির প্রয়োজন হয়। কারণ দু’টি নিম্নরূপঃ

(ক) শ্রম ও সম্পদের সর্বাধিক সাশ্রয়কর পন্থায় কর্মবিভাজন। অর্থাৎ দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজের জন্য বিশেষায়ন বা উৎকর্ষতার নীতি অনুসরণ করা। কারণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষীকরণ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ।

(খ) বিপুল ব্যাপ্তির কর্ম-আচরণসমূহ সংহতকরণের রীতি এবং বুৎপত্তিশীল কর্মনিচয়কে একটি সমন্বিত প্রয়াসে গ্রথিত করা।

নিচে একটি রেখাচিত্রের সাহায্য পদসোপান বা হায়ারার্কী নীতিটি ব্যাখ্যা করা হলোঃ 

উপরোক্ত রেখাচিত্রে দেখানো হয়েছে; এ প্রশাসনিক কাঠামোর প্রধান হলো ‘ক’ এবং সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্তৃত্ব তার হাতে ন্যস্ত। ‘খ’ হলো ‘ক’ এর ঠিক পরবর্তী অধস্তন কর্মকর্তা। ‘খ’ এর অব্যবহিত পরবর্তী কর্মকর্তা হলো ‘গ’, কিন্তু ‘গ’ আবার প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে ‘খ’ এর মাধ্যমে ‘ক’ এর অধস্তন। কিন্তু ‘খ’ ও ‘ক’ ও ‘খ’ এর নিকটও পরোক্ষভাবে অধস্তন। একইভাবে ‘ক’ প্রত্যক্ষ ভাবে ‘খ’ এর অধস্তন এবং পরোক্ষভাবে ‘খ’ এর মাধ্যমে ‘গ’ ‘খ’ ও ‘ক’ এরও অধস্তন। সংগঠন কাঠামোর শেষ স্তরের ‘ প্রত্যক্ষভাবে ‘ক’ এর অধস্তন এবং ‘চ’ এবং মাধ্যমে পরোক্ষভাবে ‘ঘ’ ‘গ’, ‘খ’ ও ‘ক’ এর অধস্তন। অনুরূপভাবে ‘ক’ থেকে ‘ট’ পর্যন্ত পদসোপানের মধ্যেও একইরূপ সম্পর্ক বিদ্যমান। 

এখন, সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্তত্বের অধিকারী ‘ক’ যদি ‘গ’ এর প্রতি কোন আদেশ জারি করেন বা ‘গ’ কে কোন কর্তৃত্ব প্রদান করেন তাহলে ‘ক’ কে তা মধ্যবর্তী কর্মকর্তা ‘খ’ এর মাধ্যমেই করতে হবে। ‘ক’ যদি সর্বনিম্ন স্তরের কর্মচারী চ’ এর প্রতি কোন আদশ জারি করেন বা তাকে কোন কর্তৃত্ব দান করেন তাহলে ‘ক’ কে মধ্যবর্তী পর্যায়ের ‘খ’ ‘গ’ ‘ঘ’ ও ‘ঙ’-এর মাধ্যমেই তা করতে হবে। পক্ষান্তরে যদি ‘চ’ কোন প্রশাসনিক বিষয় সম্পর্কে ‘ক’-এর সাথে যোগাযোগ করতে চায়, তাহলে তাকে তার ঊর্ধ্বতন ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ ও ‘ঘ’-এর মাধ্যমেই তা করতে হবে। একই নিয়ম ‘ক’ থেকে ‘ট’ পর্যন্ত পদসোপানের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।

এভাবে প্রশাসনিক কার্যাবলির সুষ্ঠু ও যথাযথ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সংগঠনের অভ্যন্তরীণ ইউনিটগুলোর মধ্যে কাজ ভাগ করে দেয়া হয়। এ ইউনিটগুলোকে আবার কতকগুলো সাব-ইউনিটে বিভক্ত করা হয় এবং এ বিভক্তিকরণের ধারা ক্রমশ চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না সংগঠনের একেবারে নিম্নতম পর্যায়ে এসে পৌঁছায়। পদসোপানভিত্তিক সংগঠনের সর্বোচ্চ পর্যায় হতে সকল কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা এবং আদেশ বিভিন্ন স্তরে এসে পৌঁছে। এতে কিছু সংখ্যক পদ থাকে। এ পদগুলো বিভিন্ন এবং সুস্পষ্ট শিরোনামে কথিত হয়। কর্মচারীগণ প্রতি স্তরেই অধস্তন কর্মচারীদের উপর আদেশ জারি করেন এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিকট হতে আদেশ লাভ করেন। এ কর্তৃত্ব সাধারণত আইন, সাংগঠনিক পদমর্যাদা, নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা এবং সর্বোপরি উৎকৃষ্ট জ্ঞান ও কর্মক্ষমতা হতে উৎসারিত হয়।

সচিবালয়ের সংগঠন থেকে পদসোপানের একটি বাস্তব উদাহরণ নিচে দেয়া হলোঃ

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, পদসোপান বা স্কেলার পদ্ধতিতে কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ উপর থেকে ধাপে ধাপে নিচের দিকে নেমে আসে। কোন দফতরের সচিব সরাসরি যুগ্মসচিবের সাথে যোগাযোগ করবেন, নির্দেশ ও পরামর্শ দেবেন। যুগ্মসচিব যোগাযোগ করবেন উপসবিচের সাথে। উপসচিব অধস্তন-সচিবের সাথে যোগাযোগ করেন। অধস্তন-সচিব শাখা-প্রধানদের সাথে যোগাযোগ করবেন। শাখা-প্রধান যোগাযোগ করবেন সহকারী ও করণিকদের সাথে। সেকশন অফিসার যখন উচ্চতর অফিসারদের সাথে যোগাযোগ করবেন, তখন হুবহু একই পর্যায়গুলোর মাধ্যমে তা করবেন।

তাই বলা যায়, পদসোপানের নিজস্ব নীতি ও প্রক্রিয়া রয়েছে। অধ্যাপক মুনী (Mooney)-র মতে, এ নীতি ও প্রক্রিয়া হচ্ছে সর্বমোট তিনটি। যথাঃ নেতৃত্ব (Leadership), কৰ্তৃত্ব অর্পণ (Delegation of Authority) এবং কর্ম-নির্দিষ্টকরণ (Functional Definition) পদসোপানভিত্তিক সংগঠনে নেতৃত্ব কর্তৃত্বের প্রতিনিধিত্ব করে। কর্তৃত্ব নেতৃত্বের রূপ লাভ করে। সমগ্র সংগঠন জুড়ে নেতৃত্ব বিরাজ করে এবং তা সুদৃঢ় সমন্বয় (Co-ordination) সাধনে সাহায্য করে। নেতাকে কেবল সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন কার্যের সমন্বয় করলেই চলবে না, তাকে বিভিন্ন কার্যে নিয়োজিত কর্মচারীদের মধ্যেও সমন্বয় আনয়ন করতে হবে। তাছাড়া পদসোপানভিত্তিক সংগঠনে কর্তৃত্ব অর্পণ নীতিও বিদ্যমান থাকে এবং এর অর্থ হচ্ছে কোন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সুনির্দিষ্ট কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা অধস্তন কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা।

সংগঠনে কর্তৃত্ব হস্তান্তর বা অর্পণে দ্বৈত দায়িত্ব দেখতে পাওয়া যায়। যথাঃ (১) অধস্তন কর্মচারীগণ ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের নিকট দায়ী থাকেন এবং (২) ঊর্ধ্বতন কর্মচারীগণ অধস্তন কর্মচারীদের নিকট হতে কাজ আদায় করে নিবেন। উপরন্তু কর্ম-নির্দিষ্টকরণ পদসোপানভিত্তিক সংগঠনের অপর একটি উল্লেখযোগ্য নীতি। যখন কোন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অধস্তন কর্তৃপক্ষের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তখন তিনি সে ক্ষমতাকে যথাযথভাবে নির্দিষ্ট করে দেন। কেবল পদসোপানের মাধ্যমেই তা সম্ভব হতে পারে। সংগঠন ক্ষুদ্র হলে এতে কর্ম-নির্দিষ্টকরণ সহজসাধ্য এবং প্রত্যক্ষ রূপ ধারণ করে। পক্ষান্তরে, সংগঠনের আকার বৃহৎ হলে তাতে কর্ম-নির্দিষ্টকরণ অপেক্ষাকৃত জটিল ও পরোক্ষ হয়ে থাকে।