প্রশ্নঃ পদসোপান নীতির সুবিধাসমূহ বর্ণনা কর। 

পদসোপান নীতির সুবিধা (Advantages of the Principle of Hierarchy): প্রশাসন পরিচালনায় অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হিসেবে পদসোপান নীতি স্বীকৃত। অধ্যাপক মুনী (Mooney)-এর মতে, “পদসোপান নীতি হচ্ছে প্রশাসনিক সংগঠনের বিশ্বজনীন মূলনীতি।” প্রতিটি বৃহদায়তন সংগঠনে এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সংগঠনের কর্তৃত্ব এর কোন না কোন স্তরে অবশ্যই ন্যস্ত থাকবে। এ দিক হতে বিচার করলে দেখা যায় যে, পদসোপান নীতির কতিপয় বাস্তব সুবিধা রয়েছে। নিচে এর উল্লেখযোগ্য সুবিধাসমূহ আলোচনা করা হলোঃ

১। সুশৃঙ্খলভাবে কার্যসম্পাদনঃ পদসোপান নীতি অনুযায়ী সংগঠনের অফিসিয়াল যাবতীয় কার্যাবলি সুশৃঙ্খলভাবে সম্পাদিত হয়। এ ব্যবস্থার একজন অধস্তন কর্মচারী তার নিকটতম উপরস্থ কর্মচারীকে এড়িয়ে কোন প্রস্তাব ঊর্ধ্বতন অফিসারের নিকট বিবেচনার জন্য পাঠাতে পারেন না বরং এখানে যে কোন প্রস্তাব যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই বিবেচিত হয়ে থাকে। ফলে প্রতিটি কর্মচারীকে একটি নিয়মশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয়।

২। আদেশ-ঐক্য সুষ্ঠুভাবে পালিত হয়ঃ পদসোপান নীতির মাধ্যমে সংগঠনের আদেশ-ঐক্য সুষ্ঠুভাবে পালিত হয়। পিরামিড ধরনের সংগঠনের চূড়ায় থাকেন একজন কার্যনির্বাহী। এ কার্যনির্বাহীই সকল কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের উৎস। এ পদ্ধতিতে কর্তৃত্বের রেখা উপর থেকে নিচে গমন করে। এর ফলে প্রতিটি কর্মচারীই পর্যায়ক্রমে পরস্পরের কাছে তাদের কাজের জন্য দায়ী থাকেন। সে কারণে এ ব্যবস্থায় কর্মচারীগণ একটি আদেশ শৃঙ্খলার বন্ধনে কর্মব্যস্ত থাকেন।

৩। প্রশাসনে সুষ্ঠু যোগাযোগ প্রতিষ্ঠাঃ পদসোপান ভিত্তিক সংগঠনে সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। এর কর্মপদ্ধতিতে কোন সংক্ষিপ্ত পথ নেই বললেই চলে। নিম্নস্তর হতে কোন বিষয় মধ্যবর্তী স্তর পার না হয়ে সরাসরি উচ্চস্তরে পৌঁছতে পারে না। যে কোন বিষয়কে যথাযথ মাধ্যমের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। ফলে যোগাযোগ প্রক্রিয়া সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ হয়ে থাকে৷

৪। সংগঠনে সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাঃ পদসোপান নীতির মাধ্যমে সংগঠনে সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধমে সংগঠনের বিভিন্ন পদসোপানে নিয়োজিত কর্মচারীদের শুধু অভ্যন্তরীণভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা হয় না, বরং সাথে সাথে দেখা যায় অফিসারের অর্থসংশ্লিষ্ট ক্ষমতাকেও পদসোপানে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।

৫। শ্রম ও বিশেষীকরণ নীতির প্রতিফলনঃ পদসোপান নীতির ফলে শ্রম ও বিশেষীকরণ নীতির বাস্তব প্রতিফলন ঘটে। কেননা পদসোপানের বিভিন্ন স্তরে এরূপ নীতিবিষয়ক সিদ্ধান্ত প্ৰণয়ন, পরিচালনা ও সামগ্রিক নির্দেশনার ভার উচ্চ পর্যায়েই কেন্দ্রীভূত থাকে এবং পূর্ণ তদারকিকরণ ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব মধ্যস্তরে হস্তান্তর করা হয় এবং প্রকৃত কার্যকারণের ভার নিম্নস্থ কর্মচারীদের মধ্যে অর্পণ করা হয়।

৬। কার্যের পরিধি নির্ধারণঃ পদসোপানে প্রধান কার্যনির্বাহীর অধীন কর্মচারীদের তাদের কার্যের পরিধি সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে ধারণা দেয়া হয় এবং এ দায়িত্ব পালনের জন্য কার্যকরী ক্ষমতা ও কৰ্তৃত্বও দেয়া হয়।

৭। উদ্দেশ্য ও দায়িত্বে ঐক্য আনয়নঃ পদসোপান নীতি সংগঠনের উদ্দেশ্য ও দায়িত্বের ক্ষেত্রে ঐক্য আনয়ন করে। এ ব্যবস্থায় পদসমূহের বিভিন্ন স্তরবিন্যাস বিদ্যমান থাকে বলে সংগঠনের উচ্চ পর্যায় হতে নিম্ন পর্যায় এবং নিম্ন পর্যায় হতে উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষা করার উপায় লাভ করা যায়৷

৮। পদ দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতনঃ পদসোপান নীতি সংগঠনে কর্মরত প্রতিটি কর্মচারীকে ‘তার পদ দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন করে তোলে। পদসোপানের মধ্যেই একজন পদধারীর কাজ সুষ্ঠুভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। তাছাড়া উক্ত কর্মচারীকে কে নিয়ন্ত্রণ করবে, তার সাথে উপরস্থ অফিসারের কি সম্পর্ক থাকবে এবং তিনি কাকে কিভাবে কাজটি করার জন্য আদেশ বা নির্দেশ দেবেন এসব বিষয় স্পষ্ট করেই পদশ্রেণীকরণের মাধ্যমেই উল্লেখ করা হয়।

৯। সংগঠনের সুসমন্বয় সাধনঃ পদসোপান নীতি সমন্বয় সাধনের প্রক্রিয়াকে সহজ করে এবং কর্তৃত্ব বাস্তবায়নের পথকে সুগম করে তোলে। সংগঠনের শীর্ষতম অফিসার তার একক নির্দেশনার ভিত্তিতে বিভিন্ন মাধ্যমিক সংযোগের মাধ্যমে সংগঠনের নিম্নতম কর্মচারীদের পরস্পর সংযুক্ত করে থাকেন। ফলে তিনি পূর্ণ কর্তৃত্বের সাথে সংগঠনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারেন এবং পদসোপানের বিভিন্ন স্তরে নিয়োজিত দায়িত্বশীল অফিসারদের দ্বারা সমন্বয় সাধন করতে পারেন।

১০। সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিকেন্দ্রীকরণঃ পদসোপান নীতির মাধ্যমে সংগঠনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে। এ বিকেন্দ্রীকরণের ফলে প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং বিভিন্ন স্তরের কর্মচারীগণ প্রশাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করেন। এতে কর্মচারীগণ মনে করেন যে, তারাও প্রশাসন ব্যবস্থার এক সক্রিয় অংশ।

১১। শ্রমবিভাজন নীতির সুষ্ঠু প্রয়োগঃ পদসোপান নীতি সংগঠনের শ্রমবিভাজন প্রক্রিয়াকে অধিকতর কার্যকর করে তোলে। পদসোপানে সংগঠনের প্রতিটি স্তরে নিয়োজিত কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষমতা ও দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়। প্রতিটি স্তর তার উপর অর্পিত ক্ষমতা ও দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে। এর ফলে পদসোপানে কোন নির্দিষ্ট স্তরে নিয়োজিত কর্মচারীগণ অধিকতর দক্ষতা অর্জন করতে থাকে৷

পরিশেষঃ পরিশেষে অধ্যাপক হোয়াইট (White)-এর মতে, “পদসোপান হচ্ছে নির্দেশ গমনাগমনের পথ। তা ঊর্ধ্বমুখী এবং নিম্নমুখী সংযোগের প্রধান খাত যে খাতে বার্তা, নির্দেশ, বিশেষ সংবাদ- জ্ঞাপন, সতর্কীকরণ ও সমর্থন চলাচল করে। এটা হলো অন্যের উপর কার্যভার অর্পণের ব্যবস্থা। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এটি সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রগুলোর পর্যায়ক্রম প্রতিষ্ঠা করে এবং এভাবে তা নিম্নস্তরে কার্যভার অনেকখানি কমিয়ে ফেলে কিংবা কাজ স্তূপীকৃত হওয়া বন্ধ করে দেয়।