একদা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন : যারা ভালো চিঠি লেখে তারা মনের জানালার ধারে বসে আলাপ করে যায় তার কোনো ভাব নেই, বেগও নেই, স্রোত আছে। ভাবহীন সহজের রসই হচ্ছে চিঠির রস। ব্যক্তিগত প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ চিঠি লিখলেও সে চিঠির মধ্যে যদি লেখকের অন্তরের রঙে রসে অনুরঞ্জিত সঞ্জীবিত হয়ে ওঠার ভাব পরিস্ফুট হয় তবে সেটি পত্রসাহিত্যে উত্তীর্ণ হয়। সর্বদা স্মরণ রাখা দরকার পত্র ও পত্রসাহিত্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। পত্র একেবারে বৈষয়িক, প্রয়োজনভিত্তিক, প্রাপক সেখানে পাঠক মাত্র, বিশেষ উদ্দেশ্য বা প্রয়োজনই সেখানে মুখ্য। পত্র যখন সাহিত্য হয়ে ওঠে সেখানে প্রয়োজন গৌণ মাত্র। মনের মানুষের কাছে লেখক যখন তাঁর অন্তরের আবেগকে উন্মোচিত করে সে তখন ব্যক্তিগত আলাপচারিতা সর্বকালের চিরকালের হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ইংরাজ সমালোচক পত্রের গৌরবে বিমুগ্ধ হয়ে মন্তব্য করেছেন : “Great letter writers are suppressed novelist, frustrated essayists born before their time.” সত্যকথা, আঁকা থেকে মানুষ যেদিন অক্ষর বা লিপি আবিষ্কার করতে শিখেছে, হয়তো সেদিন থেকেই পত্রসাহিত্যের জন্ম হয়েছে। তবে মহান ঔপন্যাসিক প্রাবন্ধিকের লেখনীর দ্বারা পত্রসাহিত্যের গৌরব বৃদ্ধি পেয়েছে।

ডায়েরিকে একাধিক নামে অভিহিত করা হয়, যেমন—দিনলিপি, দিনপঞ্জী, রোজনামচা ইত্যাদি। দিনপঞ্জী বা ডায়েরি বলতে বোঝায় একটি দিন কীভাবে অতিবাহিত হল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। অর্থাৎ বিস্মরণের বালুতটে দাঁড়িয়ে স্মরণের ডালি সাজিয়ে মানুষ আপন কথা আপন অভিজ্ঞতাকে স্মরণীয় করে তুলতে দিনের শেষে একাকী নির্জনে খাতার পাতা কলমের আঁচড়ে ভরিয়ে তোলে, যা প্রাত্যহিক দিনচর্যার দিনলিপি রূপেই চিহ্নিত হয়। এই দিনলিপি রচনায় প্রয়োজন ও অপ্রয়োজনের কোনো বিধিবদ্ধ নিয়ম নেই, মানুষের অন্তরের সকল কথাই এখানে ঠাঁই পেয়ে থাকে। হয়তো সাহিত্যের ক্ষেত্রে ডায়েরির অস্তিত্ব খুব একটা স্বীকৃত নয়, তবুও এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। দৈনন্দিন জীবনে মানুষকে নানা ধরনের কাজকর্মের দ্বারস্থ হতে হয়। কতটা কাজের কতটা অকাজের তা হিসাব করা ডায়েরির কর্ম নয়। ডায়েরি শুধু বহন করে চলে মানুষের প্রতিদিনের বড়ো থেকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়গুলি। প্রাথমিক পর্যায়ে ডায়েরির গুরুত্ব তেমন না থাকলেও সময়ের স্রোতে প্রতিটি দিন যখন একে একে গত হতে থাকে তখন ধীরে ধীরে প্রয়োজনের উচ্চ শিখরে এর ঘটে আরোহণ পর্ব। একটা অজানা অজ্ঞাত মানুষকে সম্যকরূপে চিনতে সাহায্য করে তাঁর স্বহস্ত রচিত ডায়েরি। তাই দেশ নয় মানুষ আবিষ্কারেই ডায়েরির ভূমিকা বড়ো বেশি।

পত্রসাহিত্য ও ডায়েরির তুলনামূলক আলোচনা:

(১) পত্রসাহিত্য মূলত দু’প্রকারের প্রণয় মূলক ও ভাবপ্রধান। প্রেরক ও প্রাপক এই দুজনকে ঘিরেই পত্রসাহিত্যের জন্ম। অন্তরের গোপনতম সত্তা একাগ্র চিত্তে প্রিয় ব্যক্তির নিকট উজার করে দেওয়াই পত্রের মূল লক্ষ্য।

ডায়েরি ব্যক্তি বিশেষের। কর্মক্লান্ত মনের অনুরণিত ধ্বনিই এর বর্ণিতব্য বিষয়। প্রতিদিন বা কয়েকদিন অন্তর তিন্তু ও মধুর অভিজ্ঞতাই এর মূল বিষয়। লেখক আপন মনে ডায়েরি রচনা করে আত্মার সন্তুষ্টি বিধান করে।

(২) পত্রসাহিত্যে ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা ঠাঁই পেলেও, অপরকে তা শুনিয়ে কোনো স্বস্তি নেই। কোনো তথ্যের প্রাধান্য নয়। ভাব ও মনন ক্রিয়াই এর মুখ্য বিষয়, ব্যক্তি জীবনের সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষাই পত্রাকারে আত্মপ্রকাশ করে প্রিয় ব্যক্তির নিকট হস্তান্তরিত হয়। 

কিন্তু ডায়েরির একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য হল তথ্য প্রাধান্য। দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি জীবনচর্যার তালিকা প্রকাশই এর বিশেষ প্রবণতা, যার দিনে কী পেলাম এবং কী হারালাম এমন একটি হিসাব নিকাশই ডায়েরির মুখ্য বিষয়।

(৩) পত্রসাহিত্যে লেখকের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ কামনা-বাসনা অনুভূতি প্রকাশ পাওয়ায় তা সর্বদাই সরস রচনায় অভিষিক্ত হয়। পত্রসাহিত্য পাঠ করতে যেমন ভালো লাগে তেমনি লেখকের কল্পনা রাজ্যের সন্ধান পেয়ে পাঠক আনন্দিত হয়।

ডায়েরি দৈনন্দিন জীবনের কড়চা। একটা সাংবাদিকমুলক রীতি এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে। সেখানে কেবলমাত্র ঘটনার বিবরণী সমগ্রকে গ্রাস করে ফেলে। তাই অনেক সময় ডায়েরি পাঠকের কাছে নীরস হয়ে পড়ে। 

(৪) সুপ্রাচীনকাল থেকে পত্রের সৃষ্টি। গ্রিক পুরাণে যেমন পত্রের ব্যবহার পাই, অনুরূপ ভারতীয় পুরাণে নলদময়ন্তী উপখ্যানে হাঁসের পায়ে বেঁধে পত্র প্রেরণের কাহিনিও পাই। ঐতিহাসিক দিক থেকে রাজা ভূস্বামীদের দ্বারা বিশেষ কার্যোপলক্ষ্যে পত্র রচিত হত। তা বিভিন্ন দেশের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি।

ডায়েরি রচনায় ব্যক্তি নিজেই নিজের কাছে দায়বদ্ধ। অনেক সময় সংকোচবশত অন্যের নিকট প্রকাশ পাওয়ায় লেখক নিজেকে আড়ালে রাখতে চায়। কিন্তু ডায়েরি রচনার মধ্যে দিয়ে গোপনে কিছু কিছু লেখার মধ্যে দিয়ে হাত পাকাতে সাহায্যে করে। তাই বলতে হয় স্বাতন্ত্র্য বোধে যখন থেকে মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে ঠিক তখন থেকেই ডায়েরির জন্ম।

(৫) পত্রের আকারটি কাজে লাগিয়ে অনেক সময় লেখক উপন্যাস রচনায় ব্রতী হয়েছেন। যেমন স্যামুয়েল রিচার্ডসনের ‘পামেলা’, মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা’, শৈলজানন্দের ‘ক্রৌঞ্চ মিথুন’। ডায়েরি পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দান করে বলে আকার ভঙ্গিতে ভ্রমণ কাহিনি। ধারায় এর অস্তিত্ব বিশেষ বিদ্যমান। যেমন—রবীন্দ্রনাথের ‘যুরোপ প্রবাসীর ডায়েরী’, ‘পশ্চিমযাত্রীর ডায়েরী’, নিছক চোখে দেখা সকল বিষয় এবং বর্ণনার উপকরণ, এখানে কল্পনার কোনো স্থান নেই।

তবে একথা ভুললে চলবে না, পত্র ও ডায়েরির উদ্দেশ্য যাই হোক, ব্যক্তিগত জীবনের দলিলরূপে দুজনের যাত্রা শুরু। একটা ভাবপ্রধান অন্যটি বস্তুপ্রধান হলেও সমস্তই অভিজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে সর্ব সমক্ষে নয় একজন কী দুজনের অথবা একাকী নিরালায় বসে মনের বীণার করুণ রাগিণী, বা সুখ স্মৃতিকে প্রজ্জ্বলিত রেখায় লিপিবদ্ধ করাই দুটির মূল লক্ষ্য। রচনাকার সত্যই যদি পত্র বা ডায়েরি রচনা করতে মনের সংযোগ ঘটাতে পারে, পরবর্তীকালে তা যে সাহিত্যের আকার ধারণ করতে পারে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ অজস্র ডায়েরি ও পত্র পরবর্তীকালে সাহিত্যে আপন আসন সংগ্রহ করে নিয়েছে তার ভুরিভুরি প্রমাণ রয়েছে।

একটি বাংলা পত্রসাহিত্য :

পত্রসাহিত্যের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত-রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ প্রকাশ কাল-১৯১২ খ্রিস্টাব্দে। এতে পত্র সংখ্যা মোট ১৫২ খানি। ছিন্নপত্রে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গ পরিচয়, রবীন্দ্র জীবন ও কাব্যের বিচিত্র উপাদান মিলেছে, এমনকি তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ এর কোনো কোনো গল্পের সূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে। ছিন্নপত্রে প্রবন্ধোচিত গাম্ভীর্য ও সতর্ক সচেতনতা নেই–আছে অনায়াস লঘুতা, আছে ব্যক্তি মানুষের পরিচয়, আছে পত্রলেখক ও প্রকাশের মধ্যে একটি সংযোগ ও উত্তাপের স্বাক্ষর। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের অন্তগূঢ় সাহিত্য জীবনের মহত্তর পরিচয় ছিন্নপত্রে বিবৃত রয়েছে এখানেই তার গৌরব।

পত্রসাহিত্যে, অনেক লেখক যেভাবে আত্মউন্মোচন করেন সে তুলনায় রবীন্দ্রনাথ বিশেষ প্রচ্ছন্ন মনে হলেও তাঁর আত্মপ্রকাশ যে ঘটেনি তা নয়। চিঠিতে শুধু আত্মকথাই থাকেনা, চিঠির রস জীবন রসও বটে। ফলে মর্ত্যপ্রীতি, নিসর্গ জিজ্ঞাসা, মানবচরিত্র, ব্যক্তিমানুষ, সব কিছুইতো ফুঠে ওঠে পত্র লেখকের কলমে। রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র তার ব্যতিক্রম নয়। ছিন্নপত্রের শতকরা আশিটি চিঠি পদ্মাবক্ষে বোটে বসে লেখা। সেখান থেকে কবির অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, প্রিয়জনের কাছে বা বন্ধুজনের কাছে লেখা চিঠিতে প্রকৃতি প্রেম যেমন অনায়াসে এসে যায়, তেমনি মন খুলে বলতে দ্বিধা করে না তাঁর মর্ত্যপৃথিবীর প্রতি অনুরাগের কথা জানাতে। চিঠিপত্র তো কেবল কেজো কথায় পূর্ণ থাকতে পারে না। তিনি লিখেছেন-“আমি এই পৃথিবীকে ভারি ভালোবাসি।” প্রকৃতি ও পৃথিবী, নিসর্গ ও মর্ত্য-উভয়ের প্রতি গভীর টানে কবির মনে হয়েছে, তিনি একসময় পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়েছিলেন।

কাছের মানুষের কাছে চিঠি লিখলেও শুধু ব্যক্তিগত পাঁচরকম কথা বলার স্পৃহা থাকে তা নয় কবি রবীন্দ্রনাথ জমিদার রবীন্দ্রনাথকে আত্মগত করেই মানবপ্রীতির কথা ভেবেছেন। পত্রসাহিত্যের বিষয়-বৈচিত্র্য পত্রলেখকের মনোজীবন, নানা জনের সঙ্গে সম্পর্ক এই মেঘ, রৌদ্র, আকাশ, বাতাস, নদী, জনপদ, কোলাহল, নিস্তব্ধতা সব কিছুই রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রে বিদ্যমান। সমালোচক চিঠিপত্র মাত্রই দলিল বিবেচনা করলেও এবং অনেক পত্রলেখকের ক্ষেত্রে সত্য হলেও রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে সত্য নয়। কেননা, রবীন্দ্রনাথের প্রায় যে-কোনো উক্তি তার নিজস্ব মূল্যে গ্রাহ্য হতে পারে। ছিন্নপত্রে ধৃত হয়েছে বিশ্ব প্রকৃতি, মানব প্রকৃতি, কৌতুক রসে স্নিগ্ধ হয়েছে জীবনরস, অনর্গল আলাপচারিতায় স্তব্ধ হয়েছে অনুভব নির্ভর পত্রলিখন। তদুপরি গদ্য সৌন্দর্যের আশ্চর্য অনন্যাতায় দোসরহীন ছিন্নপত্র।

সামগ্রিক বিচারে, পত্রসাহিত্যের ধারায়, কী বাংলা কী বিশ্ব সাহিত্যে, রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র অনন্য, অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথের কাছে চিঠি অবিন্যস্ত চিন্তার ফসল নয়, বাতিল হওয়া অভিব্যক্তি নয়। তিনি ‘ভানু সিংহের পত্রাবলী’র একটি চিঠিতে জানিয়েছেন–“চিঠি জিনিসটা ছোটো, মালতীফুলের মতো, কিন্তু সেই চিঠি যে আকাশের মধ্যে ফুটে ওঠে সেই আকাশ মালতীলতার মতোই বড়ো।” ‘ছিন্নপত্র’ এবং ছিন্নপত্রাবলীর পত্রপুটে সেই মহনীয় ব্যক্তিত্বের বিশ্বাকাশই ধরা দিয়েছে, এখানেই ছিন্নপত্রের বিশেষত্ব নিহিত।

একটি বাংলা ডায়েরি :

কালিদাস নাগের ‘ডায়েরি’ (১৯১৬-১৯) কে উপস্থাপন করা যেতে পারে। প্রথম যৌবন থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত দিনলিপি রেখেছেন অচ্যুত নিষ্ঠায়। এই ডায়েরির কেন্দ্রপুরুষ অবশ্যই তিনি। কিন্তু তাঁর পরিচিত বর্গের মধ্যে যেহেতু আছেন বর্তমান শতাব্দীর প্রথমার্ধের বাঙালি সংস্কৃতির প্রমুখ গুণীরা তাই এই ডায়েরি হয়ে উঠেছে সেই সময়ের সামাজিক ইতিহাসের আকর তথ্যপঞ্জী।”

১৯১৬ থেকে ১৯১৯-এর প্রতিটি দিন ধরে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বল্প পরিসরে কখনো বা চকিভাবে হলেও সামান্য দীর্ঘ আয়তনে তাঁর অভিজ্ঞতা, দৈনন্দিনতা মানস ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বিধৃত হয়েছে। তুচ্ছ তথ্যই নয়, সামাজিক ইতিহাস, শিল্প-কলা-বিজ্ঞান-ধর্ম দর্শন নিয়েও টুকরো টুকরো চিত্র পাওয়া যায়। এক স্থানে ১-১-১৯১৬য় দিনলিপিতে কালিদাস নাগ লিখেছেন : “আমাদের শহরে সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে, কত মহাপ্রাণ কী মহান দুঃখের মধ্যে সংগ্রাম করছেন তার আভাস পেয়ে মন ভরে উঠল নববর্ষের উন্মেষের সঙ্গে যেন এক নতুন দৃষ্টি খুলে গেল।” আবার ১০-৩-১৯১৭ “আজ প্রফুল্ল সেনের বিবাহে নিমন্ত্রণ খাওয়া গেল।” রবীন্দ্রনাথের কথাও উল্লেখিত হয়েছে ১৪-৩-১৭-তে “আজ কবির আহ্বানে সন্ধ্যায় সকলে হাজির হলুম-গান গল্প, ইত্যাদি হল। সাহিত্য পরিষৎ ও বঙ্গীয় ছাত্রবৃন্দ সম্বন্ধে কবির সঙ্গে কিছু কথা হল।” ১৪-৩-১৭তে আছে-“আজ কবিকে চিঠি লিখলুম।”

কিন্তু কখনো কখনো ডায়েরির ভেতর দিয়ে ঝল্‌সে উঠেছে দৈনন্দিনতার ঊর্ধ্বে অন্য দেশ অন্য সমাজের কথা এবং রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা, মূল্যায়ন। ২২-৪-১৭য় লেখা হয়েছে-“আজ রবীন্দ্র-ব্রজেন্দ্র পালা হবে। বেলা ১০টা পর্যন্ত জাপান আমেরিকা প্রসঙ্গে যা জমল তা অবর্ণনীয়।” ব্রজেন্দ্র শীল প্রশ্ন রেখেছেন—“জাপান কেমন দেখলেন ?” কালিদাস নাগের ডায়েরিতে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য জানা যাচ্ছে, জাপান সরকার তাঁর ইন্টারভিউ ও বক্তব্যগুলিতে এতই অপ্রসন্ন হলেন যে রবীন্দ্রনাথের সরকারি মহলের সমাদর শেষ হল। আর তখন থেকেই দেশকে এবং বেসরকারি দলকে ভালো করে দেখতে আরম্ভ করলেন।

ডায়েরি নিছক রোজনাম্‌ম্চা নয়, দৈনন্দিনতা নয়, তার বিস্তার যে নানামুখী এবং তা যে সমাজ ইতিহাস রাষ্ট্র শিল্পকলায় বিশিষ্ট হতে পারে তা কালিদাস নাগের ডায়েরিতে পাওয়া যায়। এই ডায়েরি যেমন ঐতিহাসিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ তেমনি চিন্তন মননের স্পর্শে বন্ধ। তুচ্ছ দিনযাপনও যেমন অবৃহৎ তাৎপর্যে মহিমা লাভ করে, তেমনি অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য লাভ করায় শ্রীনাগের ডায়েরি সাহিত্য মূল্য অর্জন করে। অর্থাৎ শ্রীনাগের ডায়েরিতে তাঁর সমকাল, বিদ্বজনেরা, বুদ্ধিজীবী, কবি, শিল্পী, গায়ক, অধ্যাপক, আত্মীয়জনেদের চলচ্ছবিও ধরা পড়েছে।

কাজেই সামগ্রিক বিচারে, কালিদাস নাগের ডায়েরি নিছক মামুলি ডায়েরি নয়, বরং সমাজ সাহিত্য বিজ্ঞান দর্শন ইতিহাস-শিল্পকলার চর্চায়, গুণীজনের রমণীয় সান্নিধ্যে ও উত্তাপে, ব্যক্তিমননের ব্যাপ্ত পরিধিতে দৈনিকতার ফ্রেমকে স্বীকার করেও বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় সার্থক ডায়েরি হয়ে উঠেছে।