‘যে শোনে এবং যে বলে এই দুজনে মিলে তবে রচনা হয়— পত্রসাহিত্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি ‘ছিন্নপত্র’ সম্বন্ধে কতটা যথার্থ হয়ে উঠেছে আলোচনা করো।
ভাষা সাহিত্যের এক অন্যতম প্রকাশ-মাধ্যম চিঠিপত্র। রবীন্দ্রনাথ চিঠিপত্রের এই অসামান্যতা সম্পর্কে লিখেছেন— “পৃথিবীতে অনেক মহামূল্য উপহার আছে তার মধ্যে সামান্য চিঠিখানি কম জিনিস নয়।”
চিঠিপত্রের এই অসামান্যতা শুধুমাত্র পত্র লেখকের অন্তরঙ্গ আত্মউন্মোচনে, তাঁর সাহিত্যজীবন-কর্মজীবনের গূঢ় ভাবগম্ভীর পরিচয়ে যা তাঁর জীবনের লঘু, অকিঞ্চিৎকর, আপাত গুরুত্বহীন ঘটনা-অভিজ্ঞতা-অনুভূতির প্রকাশের কারণেই নয়, এই অসামান্যতা যৌথ হৃদয়ের সংযোগ ও পরিচয়ের মধ্যেই নিহিত। ডায়ারি রচয়িতার আত্মকথন বা স্বগতোক্তি মাত্র, কিন্তু পত্র বিশেষ একজনের প্রতি রচয়িতার লিখিত উচ্চারণ। সাহিত্যের উদ্দেশ্য সহৃদয় পাঠক সাধারণ। ‘সহৃদয় হৃদয় সংবাদী’ হয়ে ওঠার প্রয়োজনে সাহিত্যে ভাববস্তু রচয়িতার ব্যক্তি অনুভবের সীমানা অতিক্রম করে বিশ্ব মানবিক হৃদয়-সত্যকে প্রকাশ করতে উন্মুখ। সাহিত্য তাই ‘অপ্রাকৃত’ ‘অলৌকিক’ ‘উর্দ্ধচারী। এই উর্দ্ধচারিতা বা ‘আশমানদারি’তে আশৈশব দক্ষ রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের এই লক্ষণটিকে জানতেন বলেই চিঠিপত্রের মধ্যে ব্যক্তি অনুভবের পৃথক স্বাদটির অনন্যতাও তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে স্বীকার করেছেন— “আমরা মানুষকে দেখে যতটা লাভ করি, তার সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে যতটা লাভ করি, চিঠিপত্র দ্বারা তার চেয়ে আরও একটা বেশি কিছু পেয়ে থাকি। …মানুষ মুখের কথায় আপনাকে যতখানি ও যে রকম করে প্রকাশ করে লেখার কথায় ঠিক ততখানি করতে পারে না। …এই চার পৃষ্ঠা চিঠি মনের ঠিক যে রস দোহন করতে পারে, কথা কিম্বা প্রবন্ধে কখনোই তা পারে না।”
রবীন্দ্রনাথের এই পর্যালোচনা যথার্থ। চিঠিপত্রের মধ্যে পত্রলেখকের যে অন্তরঙ্গতা ফুটে ওঠে তা অস্বীকার করা যাবে না। ভাই জর্জকে লেখা কীটসের চিঠিপত্রে, অ্যালেককে লেখা কার্লাইলের চিঠিতে, বায়রনের পত্রাবলিতে তাঁদের কবি-ব্যক্তিত্ব, অনুভবের পাশাপাশি তাঁদের পারিবারিক জীবন, জীবনের ব্যক্তিগত একাত্ত গোপন কোনো অধ্যায় বা সমকাল যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে, তা তাঁদের সাহিত্যকর্মের মধ্যেও হয়তো দুর্লভ। রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রগুলি সম্পর্কেও একই কথা। ‘ছিন্নপত্রাবলী’, ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’ এবং জীবনের বিভিন্ন পর্বে বহু বন্ধু-ভক্ত-স্নেহাস্পদ-সম্পাদক-প্রকাশক বা খ্যাত-অখ্যাতজনকে লেখা পত্রাবলিতে উন্মোচিত হয় যে রবীন্দ্রনাথ, তিনি কবি-গল্পকার-ঔপন্যাসিক-নাট্যকার-গীতিকার-চিত্রকর বা বিশ্বভারতীর স্থপতি তো বটেই, তা ছাড়াও তিনি বাৎসল্যস্নেহে উন্মুখ পিতা, মধুর প্রেমময় স্বামী, সৌন্দর্যসভোগে বিমুগ্ধপ্রাণ রসিক, কর্তব্যকর্মে সচেতন জমিদার, লঘু কৌতুকে উজ্জ্বল পরিহাসপ্রিয়, শোকে ব্যথিত গৃহী, অর্থকষ্টে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অভিভাবক।
‘ছিন্নপত্র’র পৃষ্ঠাতেও ১৮৮৭ থেকে ১৮৮৪ কালপর্বে পূর্ববঙ্গে জমিদারিকর্মে নিযুক্ত কবি ও ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গ পরিচয় আমরা পেয়ে যাই। পল্লিবাংলার অবাধ উন্মুক্ত প্রকৃতি ও সাধারণ-দরিদ্র মানুষের সান্নিধ্য যে বিচিত্র তাৎক্ষণিক অনুভব ও গভীর দার্শনিক ভাবতরঙ্গে তাঁকে গ্লাবিত করেছিল, ‘ছিন্নপত্র’তে তার ধারাবাহিক পরিচয় আছে। এ ছাড়াও আছে একান্ত সাধারণ ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের মুখ, যেখানে স্বভাবসিদ্ধ ‘আশমানদারি’র পরিবর্তে স্বভাববিরুদ্ধ ‘জমিদারি’র দায় বহন করতে গিয়ে তিনি ক্লান্ত-বিরক্ত; যেখানে কন্যা বেলা, পুত্র রথী বা কনিষ্ঠা কন্যা রাণীর জন্য তাঁর পিতৃহৃদয় বাৎসল্যস্নেহে ব্যাকুল, অথবা যেখানে বিসদৃশ পরিস্থিতিতে তিনি হাস্যমুখর। ‘ছিন্নপত্র’-র চিঠিগুলিতে নিজ হৃদয়ের এই অসংকোচ প্রকাশের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ইন্দিরা দেবীকে লিখেছেন— ‘‘আমিও জানি (বব), তোকে আমি যেসব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনো লেখায় হয় নি।”
কিন্তু এই আত্ম-উন্মোচনের স্বীকৃতি ছাড়াও এই পত্রগুচ্ছ রচনার অন্তরালে স্নেহাস্পদা ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার সহমর্মী ও সহধর্মী মনের ভূমিকাটি সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথ অকুণ্ঠ স্বীকৃতি জানিয়েছেন। ‘ছিন্নপত্র’তেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— “আমি তো আরও অনেক লোককে চিঠি লিখেছি, কিন্তু কেউ আমার সমস্ত লেখাটা আকর্ষণ করে নিতে পারে নি।… তোর অকৃত্রিম স্বভাবের মধ্যে একটি সরল স্বচ্ছতা আছে, সত্যের প্রতিবিম্ব তোর ভিতরে বেশ অব্যাহতভাবে প্রতিফলিত হয়।”
এই যে মনের উন্মুক্ত অবাধ উন্মোচন, তার কারণ এই নয় যে ইন্দিরা দেবী রবীন্দ্রনাথের নিকট আত্মীয়া এবং তাঁর নিকট সান্নিধ্যধন্যা। আসলে শৈশবাবধি উন্নত মানসিক বোধ ও রসবোধের অধিকারিণী, সাহিত্য সংগীত-অভিনয়ে সুনিপুণা এই ভ্রাতুষ্পুত্রীটি যথার্থই ছিলেন রবীন্দ্র মানসের অনুভব প্রতিফলনের যোগ্য দর্পণ। চিরকাল প্রকাশোন্মুখ রবীন্দ্রপ্রতিভার সৃষ্টিশীল শিখাকে যে ক-জন অসাধারণ নারীব্যক্তিত্ব প্রখর ঔজ্জ্বল্যে দীপ্যমান করে তুলতে পেরেছিলেন, তাঁর ‘সাঁঝ-সকালের গানের দীপে’ আলো জ্বালাতে পেরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতমা এই ইন্দিরা দেবী, রবীন্দ্রনাথের মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের কন্যা, পরবর্তীকালে সবুজপত্র-সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীর পত্নী। এই কারণেই প্রখ্যাত সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে— “ইন্দিরা যেন তাঁহার দ্বিতীয় সত্তা, তাহাকে পত্র লেখা মানে যেন নিজেরই স্বগতোক্তি।… পত্রলেখক ও পত্রপ্রাপক উভয়ের মধ্যে এমন একটি সূক্ষ্ম, অদৃশ্য বন্ধনের যোগসূত্র থাকে যাহাতে উৎকৃষ্ট পত্রসাহিত্যকে একপ্রকারের যৌথ রচনা বলিয়া অভিহিত করা যায়।”
কিন্তু ‘ছিন্নপত্র’র অসামান্যতা, ইন্দিরার সহধর্মী, স্বচ্ছ হৃদয়ে কবিহৃদয়ের অকৃত্রিম প্রতিফলন, পত্রপ্রাপকের সহৃদয় গ্রহণশীলতা ইত্যাদির সত্যতা স্বীকার করেও একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ‘ছিন্নপত্র’তে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে যতখানি আছেন, পত্রপ্রাপক সে তুলনায় কণামাত্র আছেন কি না সন্দেহ। ইন্দিরা দেবীর বিস্তৃত পরিচয়, তাঁর রুচি, পছন্দ, সুখ-বেদনা, কবিত্ব বা ব্যক্তিত্বের কোনো স্পষ্ট ধারণা এই পত্রাবলি থেকে আমরা পাই না।
রবীন্দ্রনাথ পত্র-রচনার ক্ষেত্রে উভয়ের সংযোগ প্রসঙ্গে বায়রনের চিঠিপত্রের উল্লেখ করেছেন— “বায়রন মুরকে যে সমস্ত চিঠিপত্র লিখেছিল তাতে কেবল বায়রনের স্বভাব প্রকাশ পায়নি, মুরের স্বভাবও প্রকাশ পেয়েছে।”
যথার্থই বায়রনের Letters and Journals of Lord Byron…’ নামক ২ খণ্ডের গ্রন্থে টমাস মুরকে লেখা যে সমস্ত চিঠিপত্র প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে বায়রনকে যে পরিমাণে পাওয়া যায়, টমাস মুরকে তার থেকে কম পরিমাণে পাওয়া যায় না। টমাস মুরকে জানার ক্ষেত্রে বায়রনের এই চিঠিগুলি তাই মূল্যবান উপকরণ হিসাবে স্বীকৃত। কিন্তু ‘ছিন্নপত্র’-র চিঠিগুলি রবীন্দ্রনাথকে অন্তরঙ্গভাবে উন্মোচিত করলেও ইন্দিরা দেবী প্রায় সেই রবিকিরণদীপ্ত পত্রাকাশের নেপথ্যেই রয়ে গেছেন। তবে রবীন্দ্রপ্রতিভার ভাবরসে আপ্লুত ইন্দিরা দেবীর ‘সহৃদয় হৃদয় সংবেদ্য’ মনের অপ্রগল্ভ মনের দর্শনে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে প্রতিফলিত করতে পেরেছিলেন, একথা অস্বীকার করা যায় না। তাই যৌথ সৃষ্টি বলে পুরোপুরি স্বীকার করা না গেলেও রবীন্দ্রনাথের স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে ‘ছিন্নপত্র’র পত্রপ্রাপকেরও ব্যক্তিত্বের একটি প্রতিফলন গুরুত্বপূর্ণ ছিল সন্দেহ নেই।
Leave a comment