‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থে ‘পতঙ্গ’ প্রবন্ধের মধ্যে জীবন সম্পর্কিত একটি দার্শনিক তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে। কমলাকান্ত আফিম খেয়ে জগৎ ও জীবনের সত্যস্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন। নসীরামবাবুর বৈঠকখানায় সেজবাতির কাচের চারদিকে একটি পতঙ্গকে বারবার ঘুরতে দেখে তার মনে হয়েছে, মানুষ মাত্রেই পতঙ্গ। প্রতিটি মানুষেরও এক একটা আগুন আছে—সকলেই সেই আগুনে পুড়ে মরার জন্য ছুটে চলেছে। সকলেই মনে করে, সেই আগুনে পুড়ে মরার অধিকার তাদের আছে। কেউ মনের জোরে সেই আগুনে পুড়ে মরে, কেউ আবার কাচে বাধা পেয়ে ফিরে আসে।
কমলাকান্ত জ্ঞান, ধন, মান, রূপ, ধর্ম, ইন্দ্রিয় প্রভৃতি বিষয়কেই আগুনরূপে দেখেছেন। জ্ঞান-বহ্নি, ধন-বহ্নি, মান-বহ্নি, রূপ-বহ্নি, ধর্ম-বহ্নি, ইন্দ্ৰিয়-বহ্নি, সংসার বহ্নিময়।
যে সকল মানুষ জ্ঞানের আগুনে পুড়ে মরতে চায়, তারা দিনরাত জ্ঞানের দিকে ছুটে চলে। যারা ধন লাভ করতে চায়, তারা দিনরাত শুধু ধনের কথাই চিন্তা করে। ধর্মের আগুনে নিজেদের দগ্ধ করাই তাদের কাম্য। যারা জীবনে মান-সম্মান পাবার জন্য ব্যগ্র, তারা মানের আগুনে নিজেদের পুড়িয়ে ফেলতে চায়। যারা রূপের সন্ধানে ফেরে, তারা রূপের আগুনে নিজেদের পুড়িয়ে ফেলতে চায়। যারা ধর্মের জন্য জীবনপাত করে, তারা ধর্মের আগুনে দগ্ধ হয়। যারা ইন্দ্রিয়পরায়ণ, তারা ইন্দ্রিয়তৃপ্তির আগুনে নিজেদের পুড়িয়ে ফেলে।
কমলাকান্ত সংসারকে ‘কাচময়’ রূপেও দেখেছেন। মানুষ-পতঙ্গ নিজেদের পুড়িয়ে ফেলবার জন্য আগুনের দিকে ছুটে চলে, কিন্তু কাচে বাধা পেয়ে ফিরে আসে। এই কাচের দেয়াল না থাকলে সংসারের মানুষ এতদিনে পুড়ে শেষ হয়ে যেত। যদি সকলে চৈতন্যদেবের মতো, ধর্ম-বহ্নির দিকে ছুটে যেত, তবে কজন বাঁচতো। সক্রেটিশ, গ্যালিলিয়ো জ্ঞান-বহ্নিতে নিজেদের পুড়িয়েছেন। অধিকাংশই জ্ঞান-বহ্নির কাচে ঠেকে ফিরে আসে। এই বহ্নির দাহ যাতে বর্ণিত হয় তাকে বলা হয় কাব্য। মহাভারত রচয়িতা দুর্যোধনকে মান-বহ্নির দিকে ছুটিয়ে মেরে ফেললেন। জ্ঞান-বহ্নিজাত দাহের নীতি হল Paradise Lost ধর্ম-বহ্নির অদ্বিতীয় কবি সেন্ট পল, আর ভোগ-বহ্নির পতঙ্গ—অ্যান্টনি ক্লিওপেট্রা। রূপ-বহ্নির পতঙ্গ ‘রোমিও জুলিয়েট’ স্নেহ-বহ্নিতে পতঙ্গের দাহকার্যে নাম রামায়ণ। সংসারের সকল মানুষ নানারূপ বহ্নিতে পুড়ে মরার জন্য নিরন্তন ধাবমান।
Leave a comment