মানবতাবোধের চেতনা বিকাশের সৃষ্টি হয় শিল্প। প্রবন্ধ পর্বে লেখক যামিনী রায় শিল্পের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোকপাত করেছেন। শিল্পের প্রাণদাতা শিল্পীর দল নিজেদের আবেগ, কামনা-বাসনা প্রভৃতি উল্লেখ করে শিল্পমহলে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে। বাংলাদেশের চলিত চিত্রকলায় এই শিল্পের ছিল দুটি রূপ ঘরোয়া ও পোশাকি। দেশমাতাকে সঙ্গী করে দেশের মানুষের ওপর নির্ভর করে সৃষ্টি হল ঘরোয়া শিল্প ও পটের ছবি। সহজ, সরল, সাধারণ দেশজ পরিবেশের মধ্য দিয়ে একটা সুন্দর শিল্প সৃষ্টি হতে পারে তা লেখক দেখিয়েছেন। আর পোশাকি শিল্প হল পালিশ করার কাজ। অগোছাল মাপছাড়া ছবির ওপর কিছুটা রঙের তুলি বুলিয়ে পালিশ করে সৃষ্টি হল পোশাকি শিল্প।

‘পটুয়া শিল্প’ হল দেশজ শিল্প। ঘরোয়া পরিবেশ যেখানে প্রসাধনের প্রচেষ্টা নেই সেখানে সৃষ্টি হল পটুয়া শিল্প। ঘরোয়া শিল্পের উৎসমূলে গিয়ে লেখক শিল্পে প্রাণের প্রবাহকে আবিষ্কার করেছেন। প্রাগৈতিহাসিক পথের অনুকরণে পুরাণ নির্ভর পৌরাণিক ঘটনাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছিল পটুয়া শিল্প। নিজস্ব সরল গ্রাম্যতাকে অনুধাবন করে বাংলাদেশের শিল্পীদল যে চিত্রপট অঙ্কন করে চলেছে তা’হল ঘরোয়া শিল্প। শিল্পের কথা ও ভাষা ছিল সরল স্বাভাবিক। আর অনাড়ম্বর জীবন প্রণালীর মধ্য দিয়ে শিল্পে জগতে প্রকৃত শিল্পীর প্রাণপাত ঘটেছিল। তাই ঘরোয়া শিল্পের প্রাণ ও স্বরূপকে লেখক পটুয়া শিল্প বলেছেন। নগর সভ্যতার সংস্পর্শে এসে এই শিল্পের ওপর কিছু কারুকার্য করার ফলে যে শিল্প সৃষ্টি হল তা আটপৌরে শিল্পের জগৎ থেকে দূরে সরে গেল। তাই আসল ‘পটুয়া শিল্প’ হল গ্রাম্য সরলতার বৈচিত্র্য গঠিত মনের সমাজের প্রকৃত উপস্থাপনার শিল্প।

পটুয়া শিল্পের বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে দুটি দিকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তা হল বলবার কথা ও বলবার ভাষা। পটুয়া শিল্পের মধ্যে বলবার কথা হিসাবে রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের পৌরাণিক ঘটনার প্রভাব। পুরাণ নির্ভরতাকে আশ্রয় করে শিল্পের সত্য আবিষ্কৃত হয়েছে। শিল্প জীবনে প্রথমে গ্রাম্য ভাবধারাকে অনুধাবন করে মানুষ পাহাড়ের গায়ে কিংবা মাটির বুকে ছবি এঁকেছে তখন সৃষ্টি হয়েছে শিল্পের। সে শিল্পে ছিল নিজস্ব তাতে কোনো কৃত্রিমতার প্রভাব পড়েনি। নগর সভ্যতার পরিবর্তনে এসে শিল্পের মধ্যে এল বিলাসিতা। মানব সমাজের চাহিদা মেধা শিল্প মধ্যে সৃষ্টি হল চাকচিক্যের, সৌন্দর্যবোধ আর সরলতার প্রভাবে শিল্প অঙ্কনে এল জটিলতা। এগুলি ছিল শিল্পের কথা কিন্তু শিল্পে আঙ্গিক হ্রল ভাষা। পৌরাণিক জগতের কথা বাংলার পটুয়া শিল্পীরা বলতে শিখেছিল অদ্ভুত রকমে ঘরোয়া ভাষায়। সেই ভাষার মধ্যে ছিল না কোনো জটিলতা এমনকি কোনো বিলাসিতাও ছিল না। গ্রামের পালাপার্বণে গড়া প্রতিমার পরিবর্তে শহুরে মানুষে চাহিদা পুরাণে সৃষ্টি হল—“তার ভাষার গাম্ভীর্য, তার দৃষ্টি শৌখিন, তার ভঙ্গি অতি সংস্কৃত।” পটের ছবিতে ভাষা ভঙ্গিমার প্রবল তাড়নায় লেখকের নরম তুলিতে পালিশ হতে থাকলো মূল শিল্প গঠন।

পটুয়া শিল্পের মধ্যে সংস্কৃত প্রভাব বর্তমান। শিল্প সংস্কৃতির প্রাধান্যের মধ্যে দিয়ে আদিমতাকে দূরে সরিয়ে নতুন ব্যবস্থার সৃষ্টি হল। শিল্পীর দল পৌরাণিক সংহত জীবনের ভাষাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে আধুনিকতার আলোকে নিজেদের মেলে ধরতে থাকল। তারা আসল সত্যকে ভুলে পালিশ করার কাজে মেতে উঠল। কেবল উৎস অনুষ্ঠান ছাড়া প্রতিদিনের জীবনে এর মূল্য অনেক কমে গেল। “একমাত্র পালা-পার্বণেই মানুষ মেকি সাজতে পারে।” এই ভাবে লেখক পটের ছবির মধ্যে আঙ্গিককে প্রতিফলিত করে থাকেন। শিল্পের ভাষা হল তার প্রাণ। আর এই প্রাণের প্রকৃত স্ফুরণ ঘটানোর জন্য লেখক সৃষ্টি করেন আঙ্গিকের।

পটুয়া শিল্প মধ্যে যামিনী রায় শিল্পের বিশেষত্বকে সুন্দরভাবে প্রতিকায়িত করেছেন। শিল্পের বিশেষ রূপ ছিল পুরাণ। আর সেই পুরাণ ধীরে ধীরে আধুনিকতার আলোকে আলোকিত হয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পুরাণকে অবলম্বন করে লেখক জটায়ু ও হনুমানের কথা উল্লেখ করেছেন । জটায়ু ঘরলোকের কোনো পাখি নয়, প্রকৃতি পাখির মূল কথাটি তার মধ্যে বলা হয়েছে। পাখির দেহে প্রাণ সঞ্চারের মতো জেগে রইল পটুয়া শিল্প। আর হনুমানকে বানর বলে চিনতে কখন ভুল হয় না। বানর, জটায়ু, রাক্ষস সবের মধ্যে একটা সংহতি বর্তমান। আবার লেখক উদাহরণ স্বরূপ একটি গাছের কথাও উল্লেখ করেছেন।

শিল্প সাধনায় দীর্ঘ ইতিহাসের পরে ইউরোপীয় শিল্পী মহলে টনক নড়ে উঠল প্রথমাবস্থায় ইউরোপীয় শিল্পীরা খ্রিস্টের পুরাণে-নির্ভর করে শিল্প অঙ্কন করে গেছে। কোনো দিকে লক্ষ্য না রেখে শিল্প সাধনার অঙ্গ হিসাবে পৌরাণিক ক্রিয়াকলাপকে শিল্পীমহলে স্বীকার করে সৃষ্টির বীজ বুনে চলেছিল তাই তাদের মধ্যে কোনও ঝামেলা অনুভূত হয়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের দাবি মেটাতে শিল্প মধ্যে সৃষ্টি হল সৌন্দর্য চেতনা, দূরে চলে গেল পুরাণ নির্ভরতা। সাধারণ ভাষার পরিবর্তে এল পোশাকি ভাষা। পালিশ হতে শুরু হল সংস্কৃতির। বিপদের দোরগোড়ায় এসে হাজির হল ইউরোপীয় শিল্পীর দল। জীবনের যা কিছু ছিল সবকিছু হারিয়ে আজ তারা দাবা খেলার চাল তুলে নিতে থাকলো। আধুনিকতার কাছে হেরে গিয়ে ইউরোপীয় শিল্পে ভাঙার রূপ লক্ষিত হল।

পটুয়া ছবিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শিল্পের বিশেষ রূপ প্রত্যক্ষ করেছেন লেখক যামিনী রায়। শিল্পের রূপকে প্রতিকায়িত করতে পটুয়া শিল্পে পাশাপাশি ইউরোপীয় শিল্পও প্রাণদান করেছিল প্রকৃত শিল্পের রূপ জগতে দুটি দিক প্রকাশের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা কামী মানুষ সভ্যতার চাকচিক্যের অন্ধকারে ডুবে গেল এবং সৃষ্টি করল পালিশ করা ছবি। প্রাগৈতিহাসিক ছবির প্লটকে হারিয়ে পটুয়া ছবির মধ্যে এল পোশাকি শিল্প। এই ভাবে ‘পটুয়া শিল্প’ প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে লেখক শিল্পের বিশেষ রূপকে আলোকিত করেছে যার ফলে বিবর্তন জগতে ইউরোপীয় শিল্পীর মহলে গতানুগতিক পট অঙ্কিত হয়েছে অভ্যাসের অন্ধকারে। তাই শিল্পের বিশেষত্ব এখানেই বিকশিত।