বাংলার চলিত চিত্রকলার ইতিহাসে এক অভিনব মৌলিকত্বের স্রষ্টা হলেন যামিনী রায়। ‘পটুয়া শিল্প’ প্রবন্ধ অবলম্বনে বাংলাদেশের চলিত চিত্রকলাকে দুটি ভাগে বিশ্লেষণ করে পটুয়া ছবিকে এক অভিনবত্ব দান করেন। অনেকের মতে পটুয়া ছবি আর কালিঘাটের ছবি সমর্থক মনে হলেও এই সত্য নামমাত্র। তাই লেখক স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন যে কালিঘাটের পটের ছবি আর পটুয়া শিল্প এক নয়। এ প্রসঙ্গে ক্রমে বলা যায় কলকাতা শহর যখন গড়ে উঠল তখন একদল লোক কালিঘাটে এসে বাসা বাঁধল এবং ছবি এঁকে চলল। এরা ছিল গ্রামের শিল্পী সেখানে প্রতিমা গড়ত। কিন্তু শহরে এসে শহুরে আদব কায়দায় তাদের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন আসতে বাধ্য হল। কারণ শহরতলীর মানুষের চাহিদা মেটাতে এবং আঁকতে শুরু করল এবং শহরের মেলায় সেই ছবি বিক্রি করল। এইভাবে জীবনের ছাপ লাগল গ্রাম্য শিল্পীর ছবিতে। লেখকের মতে—“এ ছবি তাই আসল পটুয়া ছবি নয়।” এর ভাষার মধ্যে গ্রাম্যতা থাকলেও বক্তব্যে আদর্শ বিচ্যুত হল। তাই এ ছবি হয়ে উঠল কালিঘাটের পটের ছবি, আসল পটুয়া ছবি নয়।

পটুয়া ছবি বলতে লেখক দেশজ শিল্প বা ঘরোয়া শিল্পের উল্লেখ করেছেন, পটুয়া শিল্প সহজ, সরল ও স্বাভাবিক এবং তাতে প্রসাধনের প্রচেষ্টা নেই, আছে কেবল ঘরোয়া ঐতিহ্যের স্বরূপ। বাংলা দেশের আদি শিল্প হিসাবে যামিনী রায় পটুয়া শিল্পকে এক অভিনবত্ব দান করলে বলা যায় ইংরেজ আগমনের পূর্বে কলকাতা শহর গড়ে ওঠার অনেক আগে বাংলায় তার প্রচলন ছিল। বিদেশিদের আগমনের আগেই তার দেহে প্রাণ ছিল। তাদের কথা ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে বহুদিনের প্রচেষ্টায় আদি শিল্পীদল ছবির মূল গড়ন বক্তব্য খুঁজে পেয়েছিল, ছবির প্রকৃত প্রাণকে তারা ধরতে পেরেছিল। ছবির জগতে ধ্রুব সত্যের সন্ধান পেয়েছিল এই আদিম শিল্পীদল। পরবর্তীকালে বাংলাদেশে পটের ছবি চলিত রইল পটুয়া মহলের অভ্যাস এবং শিল্পীরা ছিল অজ্ঞানের অন্ধকারে।

বাংলার লোকশিল্পে প্রথম যে বোধ এসেছিল আজ পটুয়ারা তা ভুলে গেছে। এই বোধ যারা প্রথম পেয়েছিল তারা আজ অভ্যাস ও প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে এক পাকা ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছিল তা বলার অন্ত রাখে না। তাই পটুয়া শিল্পের মূল তথ্যকে বাংলাদেশের ছবির ইতিহাসের একটি বিশিষ্ট প্রতিফলন বললে অদ্ভুক্তি হয় না। শিল্পের মূল সত্যকে জানতে হলে কোনো না কোনো দেশের প্রাগৈতিহাসিক ছবি বা বাংলা দেশের পটুয়া ছবিকে বিশ্লেষণ করতে হবে। প্রকৃতি পটুয়া শিল্পকে লেখক ‘আটপৌরে শিল্প’ বা ঘরোয়া শিল্প হিসাবে অনুধাবন করেছেন। প্রকৃতির মূল কথাকে পৌঁছে দিতে ঘরোয়া শিল্পের প্রাণ ও স্বরূপকে তিনি ‘পটুয়া শিল্প’ বলেছেন।

নাগরীকতার আলোকে পৌঁছে পটুয়া ছবির জগতে গ্রাম্য ভাবধারার এক আমূল পরিবর্তন সাধিত হতে থাকে। গ্রাম্য জীবনে মানুষ দেবমূর্তি গড়ত প্রতিমা তৈরি করত কিন্তু শহর কলকাতায় এসে সেই গ্রাম্য ভাবধারার পরিবর্তে শহুরে সভ্যতার চাহিদা মেটাতে গ্রাম্য শিল্পীরা ছবি আঁকতে শুরু করল এবং সেই ছবি বাজারে বিক্রি করে রোজগার করতে শুরু করল। পটুয়া শিল্পীর জীবনে এলো কৃত্রিমতা, তাদের আসল ঐতিহ্যকে লুকিয়ে রেখে শুরু করল মানুষের মনোরঞ্জনের কাজ। তাই কালিঘাটের ছবির সঙ্গে প্রকৃত গ্রাম্য শিল্পীর ছবিতে এল পটপরিবর্তন। সমালোচক মহলের উদ্দেশ্যে লেখক জানিয়েছেন—“তাঁরা যে কালিঘাটের ছবির সঙ্গে পটের ছবিকে ভিন্ন মনে করবেন তাতে বিস্ময়ের অবকাশ অল্প।”

পটুয়া ছবি হল সহজ, সরল ও স্বাভাবিক, তার মধ্যে নেই কোনো কৃত্রিমতার প্রভাব, আছে কেবল মূল সত্যকে জানবার ঐকান্তিক ইচ্ছা। ছবির মধ্যে সত্যের সন্ধানের জন্য দুটি প্রকটিত, যা হল বলবার কথা আর বলবার ভাষা বা আঙ্গিক। এই দুই দিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে পটুয়া ছবিতে পরিবর্তন লক্ষিত হয়। ছবির মধ্যে বলবার যে ভাবধারা প্রকাশ পায় তা মূলত বিশ্বপ্রকৃতির নিখুঁত প্রতিলিপি নয়, প্রকৃতির মূল কথাটুকু বলার ভঙ্গিমা। পটের ছবিতে একটা গাছ দেখলে মনে হয় এটা এমন একটা গাছ যার মধ্যে কোনো মিল নেই অন্য গাছের সঙ্গে কেবল আকারগত সামান্য মিল থেকে গেছে। কিন্তু বিশেষ গ্লানিটা নেই। তাই পটুয়া ছবিতে বলবার কথার মধ্যে সামান্য মিল থাকলেও প্রাগৈতিহাসিক ছবির সঙ্গে শিল্পের পাশাপাশি তফাতও বর্তমান। তাই লেখক জানিয়েছেন—“মূল পটুয়া ছবির দানা বেঁধেছিল একটা পুরাণের ওপর।”

প্রাগৈতিহাসিক চিত্রে শিল্পী সকল পুরাণের ওপর নির্ভর করে পৌরাণিক ঘটনাকে অবলম্বন করে নাচের ছন্দ এঁকেছে, মানুষের ছবি এঁকেছে, হরিণের ছবি এঁকেছে, কিন্তু তার মধ্যে কোনো সৌন্দর্যতা ছিল না সবকিছু যেন এলোমেলো ভাবে গড়া। পুরাণের বিষয়কে নিয়ে লেখক পটুয়া ছবির মধ্যে বলবার কথা হিসাবে জটায়ু পাখি এবং হনুমানের স্বরূপকে প্রত্যক্ষ করেছেন। এগুলি কোনো কিছু মরলোকের জগত নয় সবকিছু পৌরাণিক জগৎ। আর শিল্পীর বিশ্বাস এই জগতে দানা বেঁধেছিল। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়—“ইউরোপের সংস্কৃত শিল্প বহুদিন খ্রিস্টের পুরাণে বিশ্বাস অটুট রাখতে পেরেছিল।” এরপর সামাজিক অবস্থার প্রভাবে এই বিশ্বাস শিল্পীরা টিকিয়ে রাখতে পারল না। আধুনিকতার আলোকে পৌঁছে শিল্পীর দল পুরাণ নির্ভরতা ছেড়ে অভ্যাসের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে গতানুগতিক পট এঁকে চলল। তার ফলে ও ছবির মধ্যে ঘটল দিক পরিবর্তন।

পটুয়া ছবির মধ্যে প্রসঙ্গের পাশাপাশি ভাষার ও দিক পরিবর্তন হতে থাকে। শিল্পীর দল গ্রাম্য জগৎ থেকে ঘরোয়া ভাষায় তাদের জগৎকে তুলে ধরেছিল। সেই ভাষার মধ্যে কেবল ঘোর প্যাচ ছিল না, সহজ সরলতার মধ্য দিয়ে তারা প্রকাশ করেছিল শিল্পীর বিশেষ রূপক। এই আটপৌরে ভাষার পাশাপাশি মানুষের চাহিদা পুরাণে শহর অঞ্চলে গড়ে উঠল মৌলিক ভাষা বা সাধু ভাষার প্রচলন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে উঠল অতি সংস্কৃতমূলক। গ্রাম্য স্মৃতিতে তৈরি ছবির উপর যেমন রং পড়তে থাকল, তার পাশাপাশি ভাষার ওপর একটা স্তর পড়তে শুরু করল। জন্ম হতে থাকল পোশাকি ভাষার। এরপর প্রাগৈতিহাসিক ছবি লুপ্ত হতে শুরু করল কিন্তু সামান্য আলোর শিখায় জ্বলতে থাকল পটুয়া ছবি। সভ্যতার চাকচিক্যের প্রবল আকর্ষণে শিল্প ভেঙে পড়ল চোখে লাগল ধাঁধা। লেখকের ভাষায় “শিল্পীর দল কোমর বেঁধে নেমে পড়ল পালিশ করার কাজে।”

শিল্পের জগতে শৌখিনতার পাশাপাশি এল সংস্কৃতের প্রভাব। শিল্প সাধনায় বহু দিনের এই পরিবর্তনের পর শিল্পজগতে এক দাবা মেলা শুরু হল। ইউরোপীয় শিল্পীরা বুঝতে পারল ভাঙনের রূপকে। বহুদিন ধরে কেবল তারা মেলায় মত্ত ছিল। প্রকৃত শিল্পীর পথ যে কবে রুদ্ধ হয়ে গেছে তা তারা প্রত্যক্ষ করেনি। তারা এই মেলা থেকে তাদের চেতনাকে সরিয়ে এনে পুরাণ নির্ভরতার দিকে দৃষ্টি রেখে তারা এদেশের জন্য যা করেছে তার সবকিছু তারা ফিরিয়ে দিতে চায়। ইউরোপীয় শিল্পীরা তাদের প্রকৃত স্বরূপকে প্রকাশ করতে বদ্ধপরিকর। তাই লেখক শিল্পীর জগৎকে প্রত্যক্ষ করে শিল্পের জগতে এ পরিবর্তন সাধন করে যার ফলে ইউরোপীয় শিল্পের মধ্যে এক আমূল চেতনা বোধ প্রকাশিত হয়। ‘পটুয়া শিল্প’ প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে লেখক শিল্পের পাশাপাশি জনজীবনের সৃজনশীল শিল্পসাধনার মূল রহস্যকে উদ্ঘাটন করেছেন।